Select Page

আজীবন স্পেশাল হয়ে থাকবে ‘মনের মাঝে তুমি’

আজীবন স্পেশাল হয়ে থাকবে ‘মনের মাঝে তুমি’

১.
২০০৩ সাল। তখন আমি বেশ ছোট, আমার নানাবাড়ির নকুলশাহ (ইন্দেরহাট) সিনেমা হলে এই সিনেমাটি আসে সম্ভবত ঈদুল ফিতরে। যদিও ছবিটি এর অনেক আগেই সারাদেশব্যাপী মুক্তি পেয়ে গেছে, উপজেলা পর্যায়ের হল হওয়ায় নতুন ছবি সাধারণত এসব হলে আগেভাগে সরাসরি মুক্তি পেতো না। মুক্তির পর সিনেমার হাইপ ভালো থাকলে তবেই সেগুলো কে পরবর্তীতে আনা হতো।

বলে রাখা ভালো, এর আগে আমার কখনোই হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়নি। তবে এবার শেষমেশ এই সিনেমার মাধ্যমে মা এবং মামার হাত ধরে আমার হলে বসে সিনেমা দেখার অভিষেক টা হয়েই গেলো।

২.
হলের সামনে গিয়ে তো দেখি বিশাল ভীড়! আমরা ছিলাম তিনজন কিন্তু মামা খুব কষ্টে দুইটা টিকেট ম্যানেজ করতে পেরেছিল। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও, দোতলায় (ড্রেস সার্কেল বা ডিসি) উঠে আমার বসার জায়গা হলো আম্মার কোলে।

৩.
সিনেমা শুরুর আগে আরেকটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম। এতো বড় টিভি তো জীবনেও দেখিনি! (তখন বুঝতাম না এটা জাস্ট একটা সাদা পর্দা)
মা কে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের ঘরের টিভির সাইজ কত?
মা বললো, ২১”।
“তাহলে তো এই টিভির সাইজ ১০০” হবেই!!”

আশেপাশে যারা শুনেছিল সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। আমি অবশ্য তখন এর কারণ ধরতে পারিনি। এখন বড় হয়ে সেই ঘটনা মনে পড়লে বেশ লজ্জা লাগে।

৪.
সিনেমা চলছে। আমি একবার পর্দায় তাকাই তো ২-৩ বার চারদিকের মানুষগুলোর দিকে তাকাই। আশেপাশে যারা ছিল তারা বেশিরভাগই ফ্যামিলি অডিয়েন্স, পরিবার, ভাই-ব্রাদার মিলে উপভোগ করতেই সবাই এখানে একত্র হয়েছে। পর্দায় তাকাতে তাকাতে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। এখানে ভিজুয়াল গুলো যতটা ক্লিয়ার, আমাদের ঘরের টিভির ভিজ্যুয়াল ততটা ক্লিয়ার না। একে তো সাদাকালো টিভি, তার ওপর ঝিরঝির করে। যথারীতি আমার মাথায় আবারো উদ্ভট চিন্তা। মা কে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা এতো বড় টিভি কোত্থেকে নিয়ে আসে? দোকানে তো দেখি না!

৫.
সিনেমার ক্লাইম্যাক্স সিন, রিয়াজ ছুরিকাঘাতে হাসপাতালে ভর্তি। এতোক্ষণ হই-হুল্লোড় করতে থাকা পুরো হল তখন নিশ্চুপ, সবাই একদৃষ্টে আমার বড় টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। একেকজনের চেহারা দেখে তখন মনে হচ্ছিল তারা সবাই হাউমাউ করে কাঁদার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু দেখলাম.. নাহ, নায়ক বাবাজি চোখ মেলেছে! সবাই আবার হই হুল্লোড় করা শুরু করলো। তখন থেকে বুঝতে শুরু করলাম, হ্যাপি এন্ডিং হয়তো ইহাকেই বলে!

৬.
হলে বসে ঠিকঠাক সিনেমা দেখিনি, তাই তখন গল্পের কোনোকিছুই আমার মাথায় ঢুকেনি। তবে এরপর দেখলাম এছবির গানগুলি হাটবাজার, ঘরেবাইরে সর্বত্র ফুল সাউন্ডে বাজা শুরু করলো। আস্তে আস্তে সিনেমাটাও আমাদের হল থেকেই পাইরেসি হয়ে গেলো এবং লোকাল ডিসলাইনে প্রতিদিন এছবিটির হলপ্রিন্ট দেখানো শুরু করলো। সবাই ঘরে বসেই সিনেমাহলের আনন্দ নেওয়া শুরু করলো। আমিও সবার কানে কানে গিয়ে স্পয়লার দিচ্ছিলাম, সবার মজা নষ্ট করে দেওয়ার জন্যে। দিবোই বা না কেন, এছবিটা যে বড় টিভিতে দেখেছি!

৭.
সিনেমাটি ব্যাপকভা‌বে ব্যবসায়িক সফলতা পেয়েছে। পরবর্তীতে কতবার যে এছবি দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। ধীরে ধীরে কালার টিভি আসার পর খেয়াল করলাম ভারতীয় চ্যানেল স্টার গোল্ডে একটা হিন্দি সিনেমা দেখাচ্ছে যেটার গল্প একদম হুবহু আমার দেখা বড় টিভির ঐ সিনেমাটার সাথে মিলে যায়।

৮.
পরবর্তীতে স্মার্টফোন হাতে আসার পর বুঝতে পারলাম, যে সিনেমা দেখে আমার বড়পর্দার হাতেখড়ি হয়েছে সেটা ২০০১ এর ব্লকবাস্টার হিট তেলেগু ছবি “মানাসান্তা নুভে” এর আন অফিসিয়াল রিমেক। এটা দেখে অবশ্য আমার অতটা খারাপ লাগেনি, কারণ গল্পকার এম.এস রাজুকে “মনের মাঝে তুমি” তে ক্রেডিট দেওয়া হয়েছে।

খারাপ টা তখন বেশি লেগেছে যখন দেখলাম, “মনের মাঝে তুমি” তে থাকা ৮ টি হিট গানের সবগুলোর সুর এই তেলেগু ছবি থেকে নেওয়া, কোলকাতার প্রিয় চট্টোপাধ্যায় শুরুমাত্র গানের লিরিক্স তেলেগু থেকে বাংলায় পরিবর্তন করে বসিয়ে দিয়েছেন মাত্র! অবশ্য রিমেক ছবির গানগুলো সেইম হওয়া তেমন বড় কোনো ফ্যাক্ট না। কিন্তু কেমন জানি নিজের মন কে ততটা মানিয়ে নিতে পারছিলাম না; কুমার শানু, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, উদিত নারায়ণ, সাধনা সর্গামের মতো তুমুল জনপ্রিয় ভারতীয় গায়কেরা এমন কাজে সায় দিয়েছেন। এখন অবশ্য তাদের দেশের অনু মালিক, প্রীতমদের অতীত কান্ডকারখানা দেখে এগুলো সয়ে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে।

৯.
ছবিটা নিয়ে এতো এতো স্মৃতি আছে যা বলে শেষ করা যাবে না, এক নিঃশ্বাসে যতটুক মনে পড়ে সেগুলোই বললাম। তেলেগু এই ছবিটি পরবর্তীতে আমাদের বাংলা ভাষার পাশাপাশি হিন্দি, কন্নড়, তামিল এবং ওরিয়া ভাষায় রিমেক হয়। এর মধ্যে তামিল বাদে বাকি সবগুলো ভার্সন ভালো ব্যবসা করেছে। সামনে এর উর্দু রিমেকের কাজ চলছে।

১০.
আজ এছবির ১৬ বছর পূর্ণ হলো। আমার মতো অনেক বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী আছে যাদের সিনেমা দেখার হাতেখড়ি হয়েছে এই সিনেমার মাধ্যমে। তাই আমাদের কাছে এই ছবির আজীবন স্পেশাল ওয়ান হয়ে থাকবে।


মন্তব্য করুন