Select Page

আবহমান জীবনছবি

আবহমান জীবনছবি

 

পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি – শ্রাবণ মেঘের দিন
পরিচালক – হুমায়ূন আহমেদ
শ্রেষ্ঠাংশে – জাহিদ হাসান, শাওন, মাহফুজ আহমেদ, মুক্তি, নীরা, তানিশা, দিহান, আনোয়ারা, সালেহ আহমেদ প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, একটা ছিল সোনার কন্যা, পূবালী বাতাসে, ওলো ভাবীজান, আইজ আমরার কুসুম রানির।
মুক্তি – ৩১ মার্চ ২০০০

শ্রাবণের বারিধারার মতো জীবনে বেদনা আসে। বেদনার স্মৃতি ভোলা যায় না। বাস্তব জীবনে কখনো বেদনা আসে তো পর্দাতেও তার ছোঁয়া মেলে। পর্দার জীবনটাকে আজও ভোলা যায় না, ভোলা যায় না সেই ছবির কথা। স্মৃতি বলে ওঠে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ নামে একটা ছবি ছিল। ছবিটি কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, জীবনের কথা বলেছে। সেই জীবনশিল্পীর নাম হুমায়ূন অাহমেদ।

পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী জমিদারপ্রথার মেজাজ নিয়ে বসে থাকা গোলাম মোস্তফার দুই নাতনী মুক্তি ও নীরা আসে তাকে দেখতে। বাবার সাথে ছেলের আদর্শগত বিরোধ থেকে দূরত্ব তারপর ২৪ বছরের ব্যবধানে দূরত্ব বেড়েছে কমেনি। নাতনীরা বেড়াতে এসে বুঝতে পারে গ্রাম অার গ্রামের মানুষগুলো সরল আর সেই সরলতা তারা পছন্দ করে।

গ্রাম ঘুরে দেখতে বের হলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা পেছনে ঘোরে মুক্তি ও নীরার। তারা অবাক হয়। পথ চলতে গিয়ে নীরার পায়ে গোবর লেগে গেলে পরিষ্কার করে দেয় এজাজুল ইসলামের বউ শামীমা নাজনীন। শাওনের সাথে দেখা হবার পর গায়েন জাহিদ হাসানের বাড়িটা দেখাতে বলে। মুক্তির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল জাহিদের নৌকায় যখন তারা দাদাবাড়িতে অাসে। জাহিদের গানের গলা ভালো হওয়ায় মুক্তি পছন্দ করেছিল এটা জানার পর শাওন খুব মন খারাপ করে। জাহিদকে জমিদারবাড়িতে দাওয়াত দিলে গোলাম মোস্তফা জাহিদকে অপমান করে। একদিকে গ্রামের মানুষের সরলতার সাথে অন্যদিকে জমিদারের অহংকার পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। মুক্তি অার নীরা জমিদারপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান করা চরিত্র তাই মোস্তফার নিয়ম-কানুন তারা মানে না। মুক্তি সম্মান করে সবাইকে। গ্রামের পায়ে চলার পথে হাঁটতে গিয়ে গ্রামবাসীর একজনকে যখন ‘আপনি কেমন আছেন’ বলে লোকটি নিজে নিজে বলে-‘মাবুদে এলাহী, রাজবাড়ির মেয়ে আমারে বলে আপনি কেমন আছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি।’

রাজপরিবারের দম্ভের বিষয়টি চিরন্তন। এটি রেওয়াজ হিসেবে চলমান ছিল তাই মোস্তফা ছাড়তে পারেনি। সেসব মুক্তিকে শোনায় মোস্তফা। এজাজের বউ শামীমা নাজনীনের বাচ্চা হবার সময় সমস্যা দেখা দেয়ায় মুক্তির সাহায্য নিতে আসে সে কারণ মুক্তি ডাক্তার। মুক্তি সরাসরি চলে যায় মোস্তফার অমতের বিরুদ্ধে। বাচ্চা হতে সাহায্য করে। এ সাফল্য তাকে জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাই খোলা প্রকৃতিতে নিজে নিজে সে আনন্দ উপভোগ করে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে। নীরাকে সাপুড়ে মেয়েরা সাপ দেখিয়ে ভয় দেখালে তাদের ধরে এনে মাথার চুল কেটে দেয়, তাদের নৌকাও জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তি প্রতিবাদ করে। মুক্তির কথায় আবারো তাদের নৌকা কিনে দিতে বলে। মোস্তফার রাজপরিবারের মেজাজের বিপরীতে মুক্তি ছিল তারই কাউন্টার ক্যারেক্টার। নিজের রক্তই নিজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। হুমায়ূন আহমেদ সামাজিক বিভেদ ও সামাজিক প্রতিবাদকে একসাথে দেখিয়েছেন।

সামাজিক বিভেদের মধ্যে শান্তির পরশ আনে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতির ধারক জাহিদ হাসান। গায়েনের জীবন দিয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয় ত্যাগী হয়ে। সংসার, বিয়ে এসব সে করবে না। তার ওস্তাদের মানা আছে। শাওন বলে-‘তোমার ওস্তাদ কিন্তু বিবাহ করেছিল।’ জাহিদের উত্তর-‘এইজন্য ওস্তাদের গলায় গান বসে নাই। আমার বসছে।’ তার জীবনটা অন্যের খুশির জন্য। নিজে একটু সম্মান পেলেই খুশি কিন্তু চাইলেই কি তা মেলে! মেলে না তাইতো মোস্তফার রাজপ্রাসাদে তার দুই নাতনীর মেহমান হয়ে খেতে গেলে তাকে বাইরে বসে খেতে বলে। মনটা খারাপ হয় তার। গান ধরে-‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়।’ শাওনের যত রাগ, অভিমান সব জাহিদকে ঘিরে। জাহিদ সেগুলো ছেলেমানুষির চোখেই দেখে। জাহিদ জমিদারের নাতনীদের গান শুনিয়েছে জানলে শাওন রাগ করে। কথা হয় এভাবে-
– কোন গানটা শুনাইছ? আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে?
– হ। এমন কইরা কইলো গান শুনাইতে আর না গাইয়া পারলাম না।
– এই গান শুধুই আমার। এই গান আমারে ছাড়া আর কাউরে শোনাইবা না।
জাহিদের প্রতি শাওনের গভীর প্রেমটা জাহিদ ছেলেমানুষি ভেবেছে সবসময়।

শাওনের সাথে বিয়ে দেবার জন্য তার বাবা সালেহ আহমেদ সাথে করে নিয়ে আসে মাহফুজকে। তার বাবা উজানে যায় ব্যবসার কাজে। সেখানে গিয়ে বিয়ে করেছে বলে গ্রামে বলাবলি করে লোকে। শাওন তার মা আনোয়ারার সাথে এ নিয়ে মজা করে। হাতের দুই আঙুলের যেকোনো একটা ধরতে বলে বিয়ে করেছে কি করেনি সেটা প্রমাণ করতে। মাহফুজের সাথে নিজে কথা বলতে যায় শাওন-
– আমার বাপজান আপনারে আনছে আমার সাথে বিবাহ দেওনের জন্য। আপনার কি আমারে পছন্দ হইছে?
মাহফুজ লজ্জা পায়।
এই সেন্স অফ হিউমার হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব। জাহিদ মাহফুজকে গান শোনানোর কথা বলে কারণ সে জানে মাহফুজ গান করে। মাহফুজ যে গানে গানে শাওনের কথাই শোনায় জাহিদকে জাহিদ তা জানে না। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানে সরল সুন্দর বাঙালি পল্লীগাঁয়ের এক সাধারণ মেয়ের গল্প শোনায় মাহফুজ। জাহিদ খুশি হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে। বিয়ের আগে জাহিদকে শাওন যে কথা বলতে আসে জাহিদ তা বুঝতে পারে না। শাওনের চোখে সে ভাষা ছিল। জাহিদ তার ভালোবাসার মানুষ যে তারই বাড়ির পাশে আরশীনগরের বাসিন্দা।

জমিদার মোস্তফার অহংকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রক্তের টান বলে যে চিরন্তন বিষয় আছে তার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়। মুক্তির ইচ্ছামতো মোস্তফা তার রাজপ্রাসাদটি হাসপাতালের জন্য দান করে আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মিলিটারিদের জায়গা করে দেবার জন্য গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চায়। হুমায়ূন আহমেদ ছবির এ জায়গায় এমনভাবে দৃশ্যায়ন করেছেন যে রাজা ও প্রজা এক কাতারে নেমে আসে। ঘুচে যায় বিভেদ। নদীর ঘাটে নৌকায় ওঠার আগে মোস্তফা গ্রামবাসীদের কাছে এসব বলে। নদীর ঘাটে তার কথায় খুশি হয়ে হাততালি দেয় গ্রামবাসী। ব্যবধান আর থাকে না।

গ্রামীন সংস্কৃতির গানের দল, যাত্রাশিল্পের দ্য নিউ কুইন অপেরা এগুলো রাখা হয়েছে ছবিতে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ছবিতে আবহমান সংস্তৃতি তুলে ধরেন এবং সেটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। গ্রামে ঘুরে ঘুরে জাহিদ হাসান গান ধরে-‘ওলো ভাবীজান নাও বাওয়া মদ্দলোকের কাম।’ রাজবাড়িতে জাহিদ গানের দ এনে গান শোনায়, যাত্রা দেখানো হয়। যাত্রার সময় পেছনে বসে থাকা জাহিদকে মুক্তি তাদের সাথে বসায়। সংস্কৃতি মানুষে মানুষে ব্যবধান কমিয়ে দেয়। নীরার সাথে শাওনের যে ছোটবোনটি থাকত তাকে নীরার সাথে ঘুরতে দেখে মোস্তফা রেগে গিয়ে বের করে দেয় বাড়ি থেকে। নীরার মন খারাপ দেখে মোস্তফর তাকে ডাকে।
-‘মেয়েটি কি তোর সাথে তোর খাটে ঘুমাত?’
– না, মেঝেতে ঘুমাত।
– তাহলে তো মানুষে মানুষে প্রভেদ তুইও করে ফেলেছিস। একজনের ভুলের জন্য আর একজনের একই ভুল করাতে কি শুধু একজনকে শাস্তি দেয়া যায়?
-না।
এরপর মোস্তফা জানায় মেয়েটিকে অানতে লোক পাঠিয়েছি। তুই খেতে যা। নাতনীর কপালে চুমু দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসাটা খাঁটি। হুমায়ূন আহমেদের কমনসেন্স এত নিখুঁত যে নীরাকে মুক্তির থেকে আলাদা করে দুই বোনের দুইরকম অ্যাটিচিউড তুলে ধরেছেন। শাওনের বিয়ের দিন ‘আইজ আমরার কুসুম রানির বিবাহ হইব’ গানটি আঞ্চলিক আনন্দ দেয়। ছবিতে ব্যবহৃত গান, মানুষ, মানুষের অভ্যাস, বদনায় পারি নিয়ে হাতমুখ ধুতে দেয়া, শাওনের হাতে মাহফুজকে তরকারি উঠিয়ে দেয়া, মাটির জানালা দিয়ে শাওনের তাকানো এসব হুমায়ূন আহমেদের নিখুঁত সচেতনতা।

গ্রামের প্রকৃতিতে বড় বড় গাছের সৌন্দর্য দেখে মুক্তি ও নীরা ক্রিস্টাল গেইলের ‘top of the world’ গানের লাইনগুলো ধরে-
everything i want the world to be
is now com’in true especially for me
and the reason is clear, its because you are here
you have the nearest thing to heaven that I’ve seen.
– top of the world
গানের মধ্যে প্রকৃতির বুকে অবগাহন যেমন আছে মুক্ত স্বাধীনতার সৌন্দর্যও আছে। হুমায়ূন আহমেদ গোটা বিশ্বের সেরা জিনিসগুলোকে এক করতে পারতেন তাঁর সিলেকশনে।

ছবির শেষটায় সেই ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ এর দেখা মিলল। শাওন যে জাহিদ হাসানকে ভালোবাসে কেউ বুঝল না বিয়ের দিন নিজের আত্মহত্যার পরিণতি নিজেই ডেকে আনল। চিকিৎসার জন্য গণ্জে নৌকায় করে নিয়ে যাবার সময় মাঝপথে আনোয়ারা বলে-‘মতি, নাও ঘোরাও।’ ততক্ষণে হাত পরীক্ষা করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে গেছে আনোয়ারা। মায়ের চোখে সন্তানের মৃত্যুর সে ছবি মর্মান্তিক। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ আকাশের মেঘে চেয়ে নৌকার দাঁড় তখন হাতছাড়া জাহিদের, মা ফুজ নির্বাক। দাঁড় ভেসে যাচ্ছে ঢেউয়ে। তখন জাহিদ গান ধরে-‘পূবালী বাতাসে…আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে’..শাওন বলেছিল গানটা শুধুই তার জন্য।

সিডি কার্টেসি – শফিউল আলম বাবলু


মন্তব্য করুন