Select Page

আমাদের জীবন রঙিন করে দেয়া সেই শাবনূর

আমাদের জীবন রঙিন করে দেয়া সেই শাবনূর

সিনেমা দেখার শুরুটা আশির দশকের শেষের দিকে হলেও আমাদের প্রিয় নায়িকা হিসেবে যারা ঘুম হারাম করেছিল, সেটা নব্বই দশকের শুরুর দিকে। মা খালাদের প্রিয় নায়িকা কবরী, শাবানা, ববিতা কিংবা মামা চাচাদের কাছে অলিভিয়া, রোজিনা থাকলেও সেটা আমাদের ওই সিলসিলা হিসেবে প্রিয়।

কিন্তু যখন আমরা একা একা সিনেমা দেখতে শুরু করলাম, তখন আমাদের ঘুম হারাম করতে এগিয়ে আসেন শাবনাজ, মৌসুমী, শাবনূর। এদের মধ্যে শুরুতে মৌসুম আমাদের পাগল করে দিয়েছিল তার রুপে, আর অভিনয়ের মাধ্যমে আমাদের জীবনের বড় অংশ দখলে নিয়েছিল শাবনূর। সেদিক থেকে শাবনূর আমাদের দেশীয় প্রথম প্রেম। দেশীয় এজন্য বলছি, আসলে আমাদের জীবন তো ছিল দিব্যা ভারতী, জুহি চাওলা আর মাধুরী দীক্ষিতের দখলে। তো দেশীয় যে নায়িকা হৃদয়ের সবচেয়ে বড় জায়গাটা নিজের করে নিয়েছিল সেটা শাবনূর।

শাবনূরের ওই যে ভুবন বিখ্যাত তাকানোটা, সেটা প্রথম দেখেছিলাম ‘দুনিয়ার বাদশাহ’ সিনেমায়। সেই উনিশশ চুরানব্বই সালে। গোপালপুরের কাকলী সিনেমায়। আমীন খানের নায়িকা ছিল সে। ছিপছিপে তন্বী তরুণীকে দেখে আমরা কিছুটা নড়ে উঠেছিলাম। সেই নড়ে ওঠাটা ঝড়ে পরিণত হয় তারপরের ঈদে। ঈদুল আজহা ছিল সম্ভবত। বিস্তৃত গোপদের ধানক্ষেত পেরিয়ে বাইসাইকেলে ঝনঝন আমরা ছুটে গিয়েছিলাম মধুপুর। মাধবী হলে ক্যাপস্টান সিগারেট খেতে খেতে ঢুকেছিলাম। সিনেমার নাম ‘তুমি আমার’। সালমান শাহ নায়ক। নায়িকা শাবনূর। সে কী যে অভিনয়। মেয়েটার ফুঁপিয়ে কান্না দেখলে মনে হচ্ছিল আমার প্রেমিকাই কাঁদছে। ওর জন্য আমার কিছু করা দরকার। রাতে বাড়ি ফিরে অংক খাতার পাতা ছিঁড়ে সেই গল্প লিখে রেখেছিলাম। লিখেছিলাম প্রথম প্রেমের তীব্র অনুভূতি।

শাবনূর ঝড় তুলে দেয় মূলত ‘সুজন সখি’ সিনেমায়। সেটা রঙিন সুজন সখি। গ্রামের মেয়ে। একদম নদী তীরে যার ঘর। সেও আবার আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের যে গ্রাম, সেই গ্রামের মেয়ে। মনে হচ্ছিল আমাদের গ্রামের ইসমত আরা কিংবা আমাদের অর্চনা রায়। শাবনূরের চোখ কথা বলতো। ঠোঁট না নড়লেও তা কথা বলতে জানতো। আর তার কণ্ঠটা সারাক্ষণ ভিজে থাকতো। টিনের চাল থেকে চুয়ে পড়া বৃষ্টির জলে ভেজা কণ্ঠ।

এই ঘোর কাটতে না কাটতেই তাকে দেখি হাফপ্যান্ট পরা তরুণী হিসেবে। সেটা ‘বিক্ষোভ’ সিনেমায়। তার গটগট করে হেঁটে যাবার শব্দটা এখনও কানে বাজে। কান পাতলে স্পষ্ট শুনি সেই হৃদয় ভাঙার আওয়াজ। বিক্ষোভ আমাদের ভাঙচুর করে দিয়েছিল। তারপরের এক ঈদ। আগুনটা এবার দীর্ঘ মেয়াদী। নেভার হিসেব নেই। সিনেমাটাও সালমান শাহ্র সঙ্গেই। নাম ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। শাবনূর শাড়িতে। হালকা মেদের মসৃণ পেট। ঠোঁট বাঁকা করে একশ একটা ঢং। মনে হচ্ছিল মরে গেলাম। আমরা সত্যিই শাবনূরের প্রেমে পড়লাম এবার। তারপর ‘তোমাকে চাই’। তারপর ‘স্বপ্নের পৃথিবী’। স্বপ্নের পৃথিবী এমন এক সিনেমা, যেখানে সালমান শাহ’র অভিনয়ের প্রতিটি সংলাপ, আর এক্সপ্রেশন এখনও মনে আছে। স্বপ্নের পৃথিবী সিনেমার কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভাসে কাঁদতে কাঁদতে গাল ফুলিয়ে ফেলা সেই অভিমানী শাবনূরের মুখ। সেই দৃশ্য ভুলতেই পারি না।

উনিশশ পঁচানব্বই। আমরা আঠারো ছুঁয়ে দিচ্ছি। জীবন যাচ্ছে পূর্ণ যৌবনে। শুনলাম সালমান শাহ্ আর শাবনূর এসেছে শুটিং করতে। সেটা মধুপুরে। বাড়ির কাছেই তো। ছুটলাম বাইসাইকেলে। আমরা সকলে। সিনেমার নাম ‘আনন্দ অশ্রু। সারাদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মধুপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে পড়ে থাকি। চোখের সামনে শাবনূরকে দেখি। বুক ব্যথা করে আমাদের। তারচেয়ে তুলনামূলক দেখতে সুন্দর নায়িকা কাঞ্চির দিকে ভুলেও তাকাই না। শুধু তাকেই দেখি। তারা মাইক্রোবাসে আরেক জায়গায় পরের শট নিতে চলে যায়, আমরাও ছুটে যাই তাদের পেছনে। সালমান শাবনূর কিংবা হুমায়ূন ফরিদি ও দিলদারকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া সেই পঁচানব্বই সালে গ্রাম দেশে বিরাট এক অলৌকিক ঘটনা। সেই ঘোর নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি অনেকদিন।

তারপর সালমান শাহ্ আমাদের হৃদয় ভেঙে দিয়ে চলে গেলেন। আমরা সিনেমা দেখা কমিয়ে দিলাম। তবুও সালমান ছাড়া শাবনূর কেমন, তা দেখতে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ সেনানিবাস সিনেমায় ‘মন মানে না’। রিয়াজের সাথে শাবনূর। দেখতে গেলাম মধুপুরের কল্লোল সিনেমায় ‘রঙিন উজান ভাটি। অমিত হাসানের সাথে শাবনূর। আরও পরে মনে হয় গিয়েছিলাম ভুয়াপুরে রেখা সিনেমায় ‘মধুর মিলন’। সেখানে তার নায়ক ওমর সানী। কেন যেন সালমানের সাথে শাবনূরকে দেখে অভ্যস্ত আমরা শাবনূরের পাশে অন্য কাউকে নিতে পারলাম না। ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। হিন্দি সিনেমায় শতভাগ ঝুঁকে গিয়ে বাংলা সিনেমার নেশাটাই ছেড়ে দিই।

বিনোদন জগতে বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে গিয়ে শাবনূরের সাথে দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে অনেকবার। ছবিও আছে একসাথে। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে আমাদের সেই ঘুম হারানোর অনেকগুলো রাতের কথা বলা হয় নাই। সে হয়তো শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা মনে করি, আমরা তো তাকে সেই অনেক বছর আগে সামনে থেকে দেখেছিলাম। তাকে নিয়ে কতকিছু ডায়রিতে লিখে রেখেছিলাম। তার ভিউকার্ড বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। এই যে আজকের শাবনূর, তার সাথে যে ছবিটা আছে, সেটা হিজাবী শাবনুর। কালো বোরকা পরা শাবনুর। এই শাবনূরকে চিনি না। চিনতে চাই না।

আমাদের জীবন রঙিন করে দেয়া সেই শাবনূর। সুন্দরীতমা আমাদের। আমরা এখনও তোমাকে ভালোবাসি।

  • ‘নক্ষত্রের দেশ’ বই থেকে


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লুৎফর হাসান

কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও লেখক

মন্তব্য করুন