Select Page

আমাদের বনলতা সেন

আমাদের বনলতা সেন

পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার
ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন

অলিভিয়া যেন আমাদের চলচ্চিত্রের বনলতা সেন। কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতাটি যেন অলিভিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলা যায় অনায়াসে। সৌন্দর্য আর অভিনয়গুণের সমষ্টিতে তিনি কবিতার মতোই সুন্দর।

জন্ম করাচি, পাকিস্তান, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩। তাঁরা চার বোন।পড়াশোনা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। মডেলিং শুরু করেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। চাকরির প্রয়োজনে পূর্বাণী হোটেলে রিসিপশনিস্ট ছিলেন কিছুদিন। সেখানে থাকার সময় কয়েকটি বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন।

১৯৭২ সালে পরিচালক এস এম শফি-র ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। জহির রায়হান তা-র ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এ তাঁকে নেয়ার কথা বলেছিলেন এমনকি পরিচয়ও করিয়ে দেন সবার সাথে। তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতও কামনা করেন কিন্তু পরে অজানা কারণে অলিভিয়াকে বাদ দিয়ে ববিতাকে নেয়া হয়।

১৯৭২ সালে পরিচালক এস এম শফিকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এস এম শফি ১৯৯৫ সালে মারা গেলে সে বছরই অলিভিয়া চলচ্চিত্র ছেড়ে দেন। দ্বিতীয় বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মুনলাইট টেক্সটাইল মিলের কর্ণধার হাসানকে। থাকেন বনানীর ডিওএইচএস-এর বাসায়।

প্রায় ৫৩ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শেষ চলচ্চিত্র ‘দুশমনি’। মুক্তি না পাওয়া চলচ্চিত্র মেইল ট্রেন, প্রেম তুই সর্বনাশী।

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : মাসুদ রানা, দি রেইন, ছন্দ হারিয়ে গেল, বহ্নিশিখা, যাদুর বাঁশি, পাগলা রাজা, বাহাদুর, শাহজাদী, গুলবাহার, বেদ্বীন, শ্রীমতি ৪২০, চন্দ্রলেখা, টক্কর, হিম্মতওয়ালী, ডার্লিং, রাস্তার রাজা, বন্ধু, লাল মেমসাহেব, তকদিরের খেলা, সতীনাথ কন্যা, ভাইবোন, নাগ নাগিনী, জংলি রাণী, জামানা, জীবন সঙ্গীত, শপথ নিলাম, টাকার খেলা, দূর থেকে বলছি, সেয়ানা, তীর ভাঙা ঢেউ, শাপমুক্তি, একালের নায়ক, কুয়াশা, আগুনের আলো, কালা খুন, আগুন পানি, দুশমনি ইত্যাদি।

১৯৭৩ সালে ঢাকাই ছবিতে বোম্বের ধারা শুরু হলে ‘মাসুদ রানা’তে অলিভিয়া সে ধারা তুলে ধরেন। নেগেটিভ রোলে অভিনয় করেন। ‘ও রানা ও সোনা’ গানের গেটআপে তখনকার প্রজন্ম ওয়েস্টার্ন প্রচলন পেয়েছিল এবং জনপ্রিয় হয় গানটি। পরিচালক অশোক ঘোষ মন্তব্য করেছিলেন-‘অলিভিয়ার মধ্যে গ্ল্যামারাস ও সেক্স সিম্বলটাই বেশি।’ সমস্যাটা হচ্ছে এরপর তাঁকে সে ধরনের চটুল ছবির প্রস্তাবই বেশি দেয়া হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬-এ ‘বাহাদুর’ ছবিতে তাঁকে ‘সেক্স বম্ব’ খেতাব দেয়া হয়। ১৯৭৬-এ ‘সেয়ানা’ ছবিতে খোলা পিঠে ‘সেয়ানা অলিভিয়া’ লেখা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। এরপর নাচ-গান-ফোক-ফ্যান্টাসি নিয়ে তখন তাঁর ছবির ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।

পরদেশী মেঘ রে আর কোথা যাস নে
বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দে ছায়া তারে
বন্ধু ঘুমায় রে
আয় রে মেঘ আয় রে

রুনা লায়লার মধুর কণ্ঠের এ গানটি ছিল অলিভিয়ার লিপে সেরা গান। ছবির নাম ‘দি রেইন’ বা ‘যখন বৃষ্টি এল।’ আলোড়ন তৈরি করা ছবি। নায়ক ছিল ওয়াসিম। এ ছবির ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয় ছিল।

১৯৭৬-এ উত্তম কুমারের সাথে ‘বহ্নিশিখা’ ছবিতে অভিনয় করেন। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের আর কোনো অভিনেত্রীর এ সুযোগ ঘটেনি। ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর থেকে অলিভিয়ার চরিত্রের গুরুত্ব ছিল বেশি। এতে দেখা যায়, প্রেমে প্রতারিত হয়ে উত্তম কুমার প্রেমিকার মেয়েকে চুরি করে নিজের কাছে রেখে বড় করে। তারপর নিজে হয়ে ওঠে নেতিবাচক চরিত্র। অলিভিয়া বহ্নি চরিত্রে অসাধারণ পারফর্ম করেছিল। কলকাতায় ববিতার পর অলিভিয়াই দ্বিতীয় অভিনেত্রী ছিল তখন। সে বছরই লাক্সের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন।

১৯৮৪ সালে অশোক ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন অলিভিয়া। ‘হিম্মতওয়ালী’ চলচ্চিত্রে শাবানা ও অঞ্জনার সাথে তাকে সমান্তরাল চরিত্রে রাখার কথা বললেও দর্শক তাঁকে জাভেদের সাথে কিছু সময় দেখতে পায়। তিনি বলেন-‘অশোক আমার সাথে চিট করেছে।’ বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল তখন।

রাস্তার রাজা’ চলচ্চিত্রে মাহমুদ কলির সাথে তাঁর বেশকিছু দৃশ্য সেন্সর বোর্ড কেটে দেয়। তিনি একমাত্র অভিনেত্রী তখন যিনি চরিত্রের প্রয়োজনে যে কোনো গেটআপ নিতে রাজি ছিলেন। সেজন্য তখনকার বিনোদন সাংবাদিকরা তাঁকে ‘সেক্স সিম্বল’ হিশাবে তুলে ধরে হেয় করতেন।

অলিভিয়ার নায়করা ছিলেন রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, জাভেদ, ওয়াসিম, বুলবুল অাহমেদ, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল, মাহমুদ কলি।

রোজিনা ও অঞ্জু ঘোষের আগমনের পর অলিভিয়ার ক্যারিয়ারে ধ্বস নামে। দুজনেরই রোমান্টিক ও ফোক-ফ্যান্টাসির চাহিদা ছিল আর সেখানেই পিছিয়ে পড়তে হয় অলিভিয়াকে।

নায়করাজ রাজ্জাক বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘চিত্রালী’তে আফসোস করে বলেছিলেন-‘অলিভিয়ার গুণকে আমরা ঠিকমতো বিচার করিনি।’ কথাটি সত্য ছিল। তাঁর মেধা অনুযায়ী যতটা কাজে লাগানো উচিত ছিল তা করা হয়নি।

অলিভিয়া বনলতা সেনের মতোই কালজয়ী হয়ে থাকবেন। তাঁর নামটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথে চোখের সামনে সৌন্দর্য ও অভিনয়ের অপূর্ব বন্ধন ভেসে উঠবে।

কিছু তথ্যের ঋণস্বীকার. অনুপম হায়াৎ


মন্তব্য করুন