আমি দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারিনি: আবু সাইয়ীদ
‘কীর্তনখোলা‘, ‘শঙ্খনাদ’, ‘নিরন্তর’,‘ বাঁশী’, ‘রুপান্তর’, ‘অপেক্ষা’ ছবিগুলো নির্মাণ করে এরই মাঝে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন আবু সাইয়ীদ। সম্প্রতি চলচ্চিত্র নিয়ে তার ভাবনা, বাংলাদেশের বর্তমান চলচ্চিত্রের হালচালসহ নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন কামরুজ্জামান মিলু। বাংলানিউজ২৪.কম-র সৌজন্যে বিএমডিবি-র পাঠকদের জন্য সে আলোচনা তুলে ধরা হল-
অনেক দিন আপনার নির্মিত নতুন কোন কাজ দেখা যাচ্ছে না…
আমি এখন কোনো নতুন কাজ করছি না। ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রের পর সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এটিএনবাংলার জন্য একটি নাটক নির্মাণ করেছিলাম।
আপনার পরিচালিত সর্বশেষ ছবি ‘অপেক্ষা’র সাড়া কেমন ছিল?
সাড়া ছিল মোটামুটি। আমার ছবির কিছু দর্শক আছে, তারাই মূলত ছবিটি দেখেছে।
এই ছবির কাহিনী-তে বাংলাদেশের ধর্ম, জঙ্গীবাদ, রাজনীতির বিষয় ছিল- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ ধরনের ছবি তৈরির যৌক্তিকতা কতটুকু ?
সেই অর্থে কোন সমস্যা নেই। কারণ, এই ছবিতে জঙ্গীবাদের বিষয়ের পাশাপাশি একটি পরিবারের কিছু সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এসব কর্মকান্ডের সাথে বিদেশী সন্ত্রাসী দলেরও যোগসূত্র রয়েছে, তা দেখানো হয়েছে। যারা এসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা মূলত দূরেই থেকে যাচ্ছে- এরকম একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আর এর আগেও এই বিষয়ে বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস ও প্রতিবেদন বেরিয়েছে।
এর আগে প্রয়াত তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রেও এ বিষয় তুলে ধরা হয়েছিলো- সে বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
হ্যাঁ। আমার এ চলচ্চিত্রের আগে তারেক মাসুদ রানওয়ের শুটিং শুরু করেছিলেন। কিন্তু আমি তখন জানতাম না, তার ছবিটির কাহিনী কি ? জানলে তখন আমি অপেক্ষা ছবিটি নির্মাণ করতাম- কি করতাম না, তখন সিদ্ধান্ত নিতাম। তবে রানওয়ের সাথে আমার গল্পের ওই রকম কোনো মিল ছিল না। তবে বিষয়ের একটা মিল ছিল। সেটা যে কোনো চলচ্চিত্রে থাকতেই পারে।
বর্তমানের বাংলা ছবির হাল সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই?
আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ছবিগুলোর বাজে অবস্থা তো বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। মাঝে মাঝে একটু ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দেয়। যেমন, এই ছবিটি বোধহয় ভালো হবে, অনেকটা আশার আলো বলা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু হয়নি। সত্যি বলতে বাংলা ছবির প্রদর্শনী ও নির্মাণের (চিত্রনাট্য, গল্প, অভিনয়, চিত্রগ্রহণ) সব ক্ষেত্রে বাংলাছবির একটি বড় বিপর্যয় ঘটেছে। আমরা তো এগিয়ে যেতে পারি নাই বরং পিছিয়ে পড়েছি। এটা অনেক বড় একটা সংকট।
এই সংকট কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে আপনি মনে করেন?
এই সংকট আমরা খুব তাড়াতাড়ি কাটিয়ে উঠতে পারব বলে মনে হয় না। এটা সরকারি পর্যায়ে বা বেশি সময় নিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমাদের সরকার এই চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে কখনই দীর্ঘমেয়াদী বা সুপরিকল্পিত কোনো কাজ করছেন না। কিন্তু এটা হওয়া বর্তমানে খুব জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাহলে কি আমাদের দেশে ভালো কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে না?
এ বিষয় নিয়ে আমি একটু বাংলাদেশের ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের কথা বলতে চাই। ভিন্ন গল্প নিয়ে তারা ছবি নির্মাণ করছেন, ভালো ছবি নির্মাণে এটা এক ধরনের উদ্যোগ ও ভালো একটা দিক। এই চেষ্টা দিয়ে একটা ভালো ফলাফল আনার সম্ভাবনাও রয়েছে। কারণ এই শেষ ২-৩ বছরে এই ধরনের ভালো গল্প নিয়ে বেশ কিছু ছবি নির্মাণ হয়েছে। এর আগের ১০ থেকে ১৫ বছরে হয়ত এই পরিমাণ ভালো ছবি নির্মাণ হয়নি। কারণ এই ধরনের ছবিগুলো শুধু দেশে না আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে গিয়েছে এবং বিভিন্ন শাখায় পুরস্কারও জিতেছে।
পরিচালক হিসেবে আপনি নিজে কতটা সফল?
দর্শকের কাছে পৌঁছানো এবং সফলতা দুটি আলাদা বিষয়। সংগত কিছু কারণেই আমি দর্শকের কাছে খুব একটা পৌঁছাতে পারিনি। কারণ, আমি যে ধরণের ছবি নির্মাণ করি, সে অর্থে সব দর্শকের কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। এ ছবিগুলোর একটা ছোট দর্শকমহল আছে। আর সাফল্যের কথায় যদি আসি, সেখানেই ভালো কিছু করতে পারি নাই। কারণ, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। আর আমার ভাবনারও হয়ত একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। বেশ ভালো ছবি এখনও নির্মাণ করা হয়নি। দেখি সামনে হয়তো যদি কোনো ছবি নির্মাণ করি, সেখানে যদি কোনো উত্তরণ বা সফলতা ঘটে।
আপনার কী ধরনের সীমবাবদ্ধতা ছিল বলে মনে করেন?
সীমাবদ্ধতার নানা বিষয় থাকে। তারপরও বলব আমার ভাবনার একটি সীমবাদ্ধতা ছিল। এছাড়া কারিগরী সহযোগিতা, আর্থিক সংকট (স্বল্প বাজেট) একটা বড় কারণ ছিল। আর একটা ছবির জন্য গোটা বছর ভাববো বা কাজ করব, সেটা তো একবারেই ঘটে নাই। এখানে তাই মনোযোগেরও একটা ব্যাঘাত ঘটেছে। বিশেষ করে আর্থিক সীমাবদ্ধতার জন্য আমাদের বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সবসময় স্বল্প বাজেটের জন্য দ্রুত শুটিং শেষ করতে হয়েছে।
তাহলে কি এখন ভালো চলচ্চিত্র কি নির্মাণ হচ্ছে না?
হয়েছে, এই যেমন গোলাম রব্বানী বিপ্লবের ছবি (স্বপ্নডানা), এনামুল করিম নির্ঝরের (আহা), মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর (থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার), মোরশেদুল ইসলামের (আমার বন্ধু রাশেদ, প্রিয়তমেষু), নাসির উদ্দিন ইউসুফের (গেরিলা)- এসব চলচ্চিত্র তো আমাদের ভালো অর্জন। এগুলো তো আর্ন্তজাতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে।
বাইরের চলচ্চিত্রগুলোর নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি হয়েছে, আমাদের চলচ্চিত্রে কি তেমন কিছু তৈরি হয়েছে?
পূর্ণাঙ্গ ভাষার রুপ তৈরি হয়নি। তামিল ছবি, হিন্দি, চাইনিজ, জাপানীজ, ইরানি ছবিগুলোর পরিবেশ, ভাষাগত দিক থেকে আলাদা একটি রুপ রয়েছে। যেটা আমাদের দেশের ছবিতে কম আছে।
ধর্ম, রাজনীতি, দারিদ্রতা নিয়ে তৈরি গল্পের ছবিতে বিদেশী অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। তাহলে কি আমরা আমাদের দেশের ধর্ম, রাজনীতি, বা আমাদের নানা সংকট বিক্রি করছি অনুদানের লোভে?
আমার মনে হয় বিষয়টা সেরকম কিছু না। কারণ আমার পরিচালিত (রুপান্তর এবং বাঁশী) দুটি ছবিই বিদেশী অনুদানে নির্মিত। এই ছবি দুটির মধ্যে ‘রপান্তর’ মহাভারত নিয়ে এবং ‘বাঁশী’ ছবিটি পারিবারিক একটি কমিউনিটিকে ঘিরে গল্প। এখানে কিন্তু ধর্ম, রাজনীতি বা দারিদ্রতার কিছু ছিল না। পৃথিবীর সব জায়গাতেই রাজনীতি বা এমন ঘটনার গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ হতে পারে। তারা যে অর্থটা দেয় বা ছবির পৃষ্ঠপোষকতা করেন তা গল্পের উপর বা ভাবনার উপর একটা সন্মাননা বা অনুদান দেন।
ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে কি আপনি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গল্প নির্বাচন করেন?
এরকম নির্দিষ্ট কোন বিষয় থাকে না। আমি আমার ছবি দিয়ে যেন মানুষের কাছাকাছি বা দেশ ও মানুষের কথা বলতে পারি, সেই চিন্তা থেকেই ছবি নির্মাণ করি।
সর্বশেষ বাংলা ছবি কোনটা দেখা হয়েছে?
সর্বশেষ ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিটি দেখলাম। অনেকদিন তেমন কোনো বাংলা ছবি দেখা হয় না। গত দুই বছর ধরে আমি চলচ্চিত্র থেকে দূরে।
আপনি কি তাহলে সামনে কোনো কাজ করবেন না, আপনার আগামী পরিকল্পনা জানতে চাই…
কাজ করতে চাই। তবে ছবির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আর কোনো ছবি নির্মাণ করতে চাই না। কম বাজেটের কোনো ছবিতে কাজ করব না। এবার কাজ করলে একটু গুছিয়ে কাজ করতে চাই। আর নির্মাণের ক্ষেত্রে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামতে চাই। আর তা যদি না হয় জীবিকার তাগিদে নাটক নির্মাণ করব।
সূত্র: বাংলানিউজ২৪.কম
আবু সাইয়িদ স্যারের নিরন্তর আমার খুব প্রিয় একটা ছবি ।স্যারের মত মানুষ যদি প্রযোজক না পান তবে সেটা খুব দুঃখজনক ।আশা করি আগামিতে স্যারের কাছ থেকে অনেক ভাল ভাল ছবি পাব ।