Select Page

আলম খানের কয়েকটি গানের পেছনের গল্প

আলম খানের কয়েকটি গানের পেছনের গল্প

১৯৬৩ সালে রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে ‘তালাশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সংগীত পরিচালনায় আসেন আলম খান। ১৯৭০ সালে প্রথমবার চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার সুযোগ পান। ছবির নাম ‘কাঁচ কাটা হীরে’, পরিচালক আবদুল জাব্বার খান। কিন্তু ছবির কাজ করতে করতেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। তবে তার প্রথম শ্রোতাপ্রিয় গান ‘স্লোগান’ ছবির; মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের গাওয়া ‘তবলার তেড়ে কেটে তেড়ে কেটে তাক’ ও আবদুল জাব্বারের গাওয়া ‘কী সুখ পাও তুমি আমাকে ধুঁকে ধুঁকে পুড়িয়ে’। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি এই সংগীত কিংবদন্তিকে। নিচে তার কয়েকটি গান তৈরির গল্প—

সুরের সাত বছর পর লেখা হয় ‘ওরে নীল দরিয়া’র কথা

‘সারেং বউ’ ছবির আবদুল জাব্বারের গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া’ গানটির সুর ১৯৬৯ সালে করা। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি।

আলম খান বলেন, আমি মনের মতো কোনো দৃশ্য পাইনি বলে কোনো ছবিতে সুরটি ব্যবহার করতে পারিনি। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে যখন আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর ‘সারেং বউ’ ছবির গান নিয়ে বসলেন, তখন গল্প শুনে মনে হলো, এই ছবির সারেংয়ের বাড়ি ফেরার দৃশ্যে সুরটি ব্যবহার করা যায়। গীতিকার মুকুল চৌধুরী ও আমি দুজনই এই ছবির পুরো গল্প পড়ে নিই। এরপর মুকুল চৌধুরীকে এই সুরটা দিয়ে বললাম গান লিখতে। তিনি দুই দিন পর অন্তরাসহ লিখে নিয়ে এলেন। আমি মামুন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করলাম। এই গানে ১২ জন রিদম প্লেয়ারসহ ২৪ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী বাজিয়েছিলেন।

রজনীগন্ধা পছন্দ হয়নি পরিচালকের

‘রজনীগন্ধা’ ছবিতে আলম খানের সুরে ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’ হানে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমিন।

আলম খান বলেন, পরিচালক কামাল আহমেদের সঙ্গে এটাই প্রথম কাজ। দৃশ্য শুনে প্রথমে সুর করলাম। সুরের ওপর গীতিকার মাসুদ করিম কথা লেখার পর পরিচালককে গেয়ে শোনালাম। তিনি সুর শুনে বাইরে গিয়ে অন্যদের বললেন, তাঁর গানটি পছন্দ হয়নি। এই সুর তিনি নেবেন না। শুনে বললাম, এই সুর না নিলে আমিও গান করব না। পরে তিনি রাজি হলেন। কিন্তু গান রেকর্ডিংয়ের দিন এলেন না। গানটি রেকর্ডের পর তিনি শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

তুমি যেখানে আমি সেখানের পর সাতদিন গান গাইতে পারেননি অ্যান্ড্রু কিশোর

‘নাগ পূর্ণিমা’ ফোক ফ্যান্টাসি ছবি। কিন্তু পরিচালক ও প্রযোজক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা বললেন, ‘আমি একটা রক গান করতে চাই এ ছবিতে।’ সিকোয়েন্স শুনে আলম খান বলেন, রক গান ছবির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। কিন্তু নাছোড় সোহেল রানা বললেন, ‘আপনি ম্যাচ করাতে পারবেন বলেই তো গানটা করতে চেয়েছি।’ গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, ‘ছবির পেক্ষাপট অনুযায়ী একটা লাইন পেয়েছি; “তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না”।’ তখনই মুখ সুর করের আলম খান। অন্তরার সুর পরে করা। গানটি গাওয়ার পর শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের গলা বসে যায়। সাত দিন সে আর কোনো গান গাইতে পারেনি।

গোসল করতে গিয়ে মাথায় আসে হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস-এর সুর

‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানটি ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির। এই ছবির সবগুলো গানই লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

আলম খান বলেন, মনে আছে, গানের প্রথম চারটি লাইন একটা ছোট কাগজে লিখে হক ভাই আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ছবির স্ক্রিপ্ট লিখছি। আপনি মুখটা সুর করতে থাকেন।

স্ক্রিপ্ট শেষ হলে বসে গানটা শেষ করব।’ আমি কাগজটা মানিব্যাগে রেখে দিলাম। সময় পেলে মাঝেমধ্যে সুর করতাম। প্রায় ১৫টা সুর করেছিলাম। এখন সে সুরটা পরে এটাই মনে ধরল। তিন মাস পর হক ভাই একসকালে তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। মুখের সুর শোনার পর তিনি অন্তরা লিখে দিলেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও মনমতো অন্তরার সুর করতে পারলাম না। মন খারাপ করে আমার সহকারী গোপীসহ বাড়ি ফিরলাম। বাসায় ফিরে গোসল করতে তোয়ালে কাঁধে যখন বাথরুমে ঢুকব, তখনই সুরটা মাথায় এল। দ্রুত বেরিয়ে সুরটা রেকর্ড করলাম। পরদিন গিয়ে শোনালাম। হক ভাই শুনেই বললেন, ‘আপনি “পূর্ণিমাতে ভাইস্যা গেছে” বলে যে টান দিয়েছেন, তাতেই মন ভরে গেছে।’ এরপর আমরা গানটির রেকর্ডিংয়ে যাই।

কুমার শানুকে বাদ দিয়ে অ্যান্ড্রু কিশোরের হাতে এক চোর যায় চলে

১৯৭৮ সাল। আলম খানের সুরে ‘প্রতীক্ষা’ সিনেমার গান এটি। অ্যান্ড্রু কিশোরের রেকর্ড করা তৃতীয় গান।  কিন্তু রিলিজ হওয়া প্রথম গান। গানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আর যেটা অ্যান্ড্রু কিশোর প্রথমে গেয়েছিলেন, সেটা রিলিজই হয়নি। এদিকে, শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ‘তিন কন্যা’  সিনেমাটিতে যখন গান হয়, তখন কলকাতায় বাংলাদেশের তিন সংগীত পরিচালক— আলাউদ্দিন আলী, সুজেয় শ্যাম আর আলম খান কাজ করছিলেন। অ্যান্ড্রু কিশোরেরও সেখানে গান গাওয়ার কথা, কিন্তু  মধ্যপ্রাচ্যে একটা শো করতে গিয়ে পাসপোর্ট জটিলতায় সেখানে প্রায় ২০/২৫ দিন আটকে গেলেন। পরে  দেশে এসে বাসায় একটি চিঠি পেয়ে ইন্ডিয়ান ভিসা করে কলকাতায় গেলেন। সেখানে গান নিয়ে তাঁর জন্য তিনটি পার্টি অপেক্ষা করছিলো। যেতে দেরি হওয়ায় কেদার ভট্টাচার্য নামের এক শিল্পী এরই মধ্যে  ‘তিন কন্যা’ ছবির গান গেয়ে ফেলেছেন, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘কুমার শানু’ নামে পরিচিতি পান। সুজেয় শ্যামদার একটা-দুটা গান গাওয়ার পর তৃতীয় গানটা গাওয়ার জন্য যখনই শানু প্রস্তুত, তখন অ্যান্ড্রু কিশোর গিয়ে স্টুডিওতে হাজির হলেন। অ্যান্ড্রু কিশোরকে দেখে একজন বললেন, ‘আমাদের শিল্পী  অ্যান্ড্রু চলে এসেছে, ওই ছেলেরে বের করে দাও।’ কিশোর বললেন, ‘না, এটা হতে পারে না। উনি একজন  শিল্পী। আমি তো এটা করতে পারি না।’ কুমার শানু তখন বাইরে এসে বলল, ‘তোমারই গান দাদা, প্রডিউসার চাইছে, তুমি গান গাইবে না কেন? আমি তোমার তিন-চারটা গান গেয়ে ফেলেছি দাদা। আমার আর দরকার নেই। আমার জীবনে রেডিওতে গান গাইনি, কোথাও গান গাইনি। তোমার দেরি হওয়ায় সিনেমায় প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ব্যস, মেরে দিলাম।’ এই কথা কিন্তু কুমার শানু আজো মনে রেখেছে। পৃথিবীর যে জায়গাতেই অ্যান্ড্রু কিশোর গিয়েছেন, শানু নিজে থেকে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন।


Leave a reply