Select Page

আলীবাবা: লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

আলীবাবা: লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

সুবিধাবঞ্চিত আলী বাবা, লোভী কাসেম বাবা ও বুদ্ধিমতী মর্জিনার গল্প নিয়ে আরব্য রজনীর একটি বিখ্যাত গল্প ‘আলী বাবা ৪০ চোর’, যে গল্প আমাদের শেখায়— লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

আরব্য রজনী বা আলিফ লায়লার গল্পগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ কমবেশি পরিচিত। যার অনেক গল্প-ই প্রাপ্তবয়স্কদের। আমরা ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত কাটছাঁট করা গল্প পড়ি বা শুনি, কারণ গল্পের মাঝে যা যৌনতা আছে তা বর্জন করা হয়েছে। তবুও গল্পগুলো আমাদের মাঝে জনপ্রিয়।

জিনাত ও জাভেদ

আশি দশকে আমরা যখন গল্প শোনার আবদার করতাম, তখন মা বা দাদি-নানিরা আরব্য রজনীর গল্প শোনাতো। শুধু যে আশি দশক তা নয়, এর শত শত বছর আগেও শোনানো হতো এই সব গল্প।

বিশেষ করে ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘আলী বাবা ৪০ চোর’, ‘সিন্দাবাদের সাত অভিযান’, ‘বাগদাদের চোর’ ও  ‘একদিনের খলিফা আবুল হাসান’ এই সব গল্প।

আরব্য রজনীর প্রতিটি গল্প শিক্ষামূলক। সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিকসহ সকলপ্রকার শিক্ষামূলক বিষয় আছে গল্পে।

আরব্য রজনীর গল্পের লেখকেরা বা লেখক নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিল। তাই আরব্য রজনীর লেখক কে বা কারা জানা যায়নি।

কেন নিজদের পরিচয় গোপন রেখেছে, তা গল্প পড়লে আমরা অনুমান করতে পারি। গল্পের মাঝে উঠে এসেছে, সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার রূপ। অনেক গল্পে শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে। তাই লেখক নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে অনুমান করা যায়।

আরব্য রজনীর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গল্পের মাঝে একটি ‘আলী বাবা ৪০ চোর’, যার মূল শিক্ষা— লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

পূর্ণাঙ্গ গল্প নিয়ে বাংলাদেশে সম্ভবত দুটি ছবি নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত জাভেদ, জিনাত, নিশাত, মতি, রওশন জামিল, মায়া হাজারিকা, এটিএম শামসুজ্জামান ও রাজ অভিনীত ‘আলী বাবা ৪০ চোর’ মুক্তি পায়।

আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুল ছুটির পর রঙ্গমে সিনেমাটি দেখি।

কাহিনি সংক্ষেপ: কাসেম বাবা ( এটিএম শামসুজ্জামান) ও  আলীবাবা ( জাভেদ) তারা দুই ভাই। কাসেম বাবা লোভী, ঠগ, স্বার্থপর ও  অসৎ। আলীবাবা সৎ, মানবতাবাদী ও বেকার।

বাবার ব্যবসা বড়ভাই কাসেম বাবা দেখাশোনা করে। সে ছোট ভাইকে বাবার অর্থসম্পদ থেকে সুবিধাবঞ্চিত রেখে নিজের আখের গোছাতে থাকে।

আলীবাবাকে একদিন কাসেম বাবা দোকানের মালামাল ক্রয় করার জন্য পাঠায়। পথে দাসবাজারে অসহায় দাসী মর্জিনাকে ক্রয় করে নিয়ে আসে। আলীবাবার ইচ্ছে ছিল মর্জিনাকে মুক্ত করে দেবে।

ব্যবসার দুই হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে মর্জিনাকে ক্রয় করা হয়েছিল। কাসেম বাবা অসন্তোষ হয়ে, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে আলীবাবাকে বাবার সকল সম্পত্তি থেকে বে-দখল করে।

বাকি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে মর্জিনাকে দাসী করে রাখে। শর্ত দেয় যদি আলীবাবা বাকি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধ করে, তাহলে মর্জিনাকে মুক্ত করে দেবে।

আলীবাবার মা জানতো কাসেম বাবা লোভী, স্বার্থপর, ঠগবাজ। তাই কাসেম বাবার সঙ্গ ত্যাগ করে, নিঃস্ব আলীবাবার সঙ্গে চলে আসে। এরপর সে সারা দিন বনজঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে কাঠ কুড়ায়। কাঠুরিয়া আলীবাবা তার মাকে নিয়ে দুঃখকষ্টে দিনযাপন করতে থাকে।

একদিন পাহাড়ের পাদদেশে আলীবাবা কাঠ কুড়াচ্ছিলো। হঠাৎ দেখে রাজ্যের ত্রাস চোর চল্লিশ চোরের সর্দার আবু হুসেন তার দলবলসহ ঘোড়ায় চড়ে আসছে। আলীবাবা আড়ালে লুকিয়ে, তাদের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করে। আবু হুসেন তার দলবলসহ পাহাড়ি একটি ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে বলতে থাকে, ‘খুলে যাহ ঝমঝম!’

পাহাড়ের গা থেকে ঝরনা সরে গেলে গুহার পথ দেখা যায়। আবু হুসেন দলবলসহ গুহায় প্রবেশ করে বলে, ‘বন্ধ হয়ে যাহ ঝমঝম!’ গুহার মুখ বন্ধ হয়ে ঝর্ণার পানি ঝরতে থাকে!

কিছুক্ষণ পর আবু হুসেন দলবলসহ বাহির হয়ে চলে যায়। আলীবাবা ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘খুলে যাহ ঝমঝম!’ গুহার পথ তৈরি হয়।

আলীবাবা গুহায় প্রবেশ করে দেখে, আবু হুসেন ও তার চল্লিশ চোর তাদের লুটের ধনসম্পদ জমিয়ে রেখেছে। স্বর্ণমুদ্রা, মণিমুক্তা, হিরা-জহরত এ যেন ধনসম্পদের পাহাড়।

আলীবাবা এক বস্তা স্বর্ণমুদ্রা (সাগর থেকে এক বদনা জল নেওয়ার সমান) নিয়ে বের হয়ে যায়। আলীবাবা মাকে বলে, ‘এত স্বর্ণমুদ্রা গোনার সময় নাই, আপনি কাসেম বাবার ঘর থেকে মিজান (দাঁড়িপাল্লা) আনেন, মেপে মেপে রাখি।’

শাশুড়ি মিজানের জন্য আসলে কাসেমের স্ত্রীর সন্দেহ হয়। কাঠুরিয়া আলীবাবা দিন আনে দিন খায়, তাদের মাপার এমনকি সম্পদ আছে! কাসেমের স্ত্রী চালাকি করে মিজানের তলায় আঁঠা লাগিয়ে দেয়।

আলীবাবার স্বর্ণমুদ্রা মাপা শেষ হলে, মিজান ফেরত দিয়ে যায়। কাসেমের স্ত্রী মিজান উল্টিয়ে দেখে দুটি স্বর্ণমুদ্রা লেগে আছে। স্ত্রী কাসেমকে জানায় সব। তারা অবাক ও লোভাতুর হয়।

আলীবাবা রাতারাতি ধনী হয়ে যায়। দাসী মর্জিনাকে আলীবাবা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে মুক্ত করে দেয়। মর্জিনা স্বেচ্ছায় আলীবাবার মহলে থাকে, আলীবাবার মুক্তদাসী হয়ে।

এদিকে কাসেম ও কাসেমের স্ত্রী লোভ আর হিংসায় জ্বলতে থাকে। কাসেম আলীবাবার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে। ধূর্ত কাসেম স্বার্থ হাসিল করতে এই সন্ধি করে, যা ছিল অভিসন্ধি!

একদিন আলীবাবাকে নিজ মহলে দাওয়াত করে, মিষ্টি কথা বলে বলে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার রহস্য জেনে নেয়।

রহস্য জানার পর কাসেম আলীবাবাকে বন্দী করে।

কাসেম সেই ঝরনার সামনে গিয়ে বলে, ‘খুলে যাহ ঝমঝম!’ গুহার মুখ খুলে যায়। কাসেম ভেতরে প্রবেশ করে বলে, ‘বন্ধ হয়ে যাহ ঝমঝম!’ গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

কাসেম ধনরত্ন দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। লোভাতুর কাসেম যা পারে তা পাগলের মতো বস্তায় ভরতে থাকে। কিন্তু কাসেম সংকেত ভুলে যায়। গুহার মুখে এসে বলতে থাকে, ‘খুলে যাহ টমটম!’ গুহার মুখ খোলে না।

‘খুলে যাহ থমথম! খুলে যাহ কমকম! খুলে যাহ ভনভন!’ আবোলতাবোল বলতে থাকে কাসেম, কিন্তু গুহার মুখ খোলে না।

আর তখনই আসে আবু হুসেন দলবলসহ। গুহায় তাকে দেখতে পেয়ে তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো করে তারা চলে যায়।

কাসেম রাতে না ফেরায় কাসেমের পরিবার চিন্তিত হয়ে যায়। আলীবাবা বুঝতে পারে কাসেম কোথায় গেছে, এও বুঝতে পারে কাসেম বিপদে পড়ছে।

কাসেমের স্ত্রীকে বলে তাকে ছেড়ে দিতে, সে কাসেমকে নিয়ে আসবে। কাসেমের স্ত্রী আলীবাবাকে ছেড়ে দেয়।

আলীবাবা গুহায় এসে দেখে কাসেম টুকরা টুকরা।

আলীবাবা কাসেমের টুকরা নিয়ে যায়। কিন্তু এই টুকরো লাশ মাটি দিলে নানাজন নানা প্রশ্ন তুলবে, কী করা যায়!

বুদ্ধিমতী মর্জিনা বাজারের এক দক্ষ দরজি মোস্তাফা বাবাকে চোখ বেঁধে নিয়ে আসে লাশ সেলাই করতে। দরজি মোস্তফা বাবা দুই হাজার স্বর্ণমুদ্রা বিনিময়ে লাশ সেলাই করে।

তারপর আয়কৃত অর্থ দিয়ে সরাইখানায় মদ আর মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে থাকে।

আবু হুসেন গুহায় এসে যখন দেখে লাশ নাই, তখন বুঝতে পারে গুহায় আরও কারো যাতায়াত আসে।

সে স্থানীয় বাজারে গুপ্তচর লাগায়।

গুপ্তচররা দেখে সাধারণ এক দরজি সরাইখানায় মদ ও নারীর পেছনে অঢেল অর্থ ব্যয় করছে। দরজি মোস্তাফা বাবা মাতাল অবস্থায় অর্থ উপার্জনের রহস্য ফাঁস করে, গুপ্তচরদের কাছে।

আবু হুসেন বলে তাকে সেই বাড়িতে নিয়ে যেতে। দরজি বলে, ‘আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়, কাজ শেষে চোখ বেঁধে রেখে যায়! তবে আমি সেই বাড়ির ফটকে ক্রস চিহ্ন দিয়েছি।’

আবু হুসেন দরজিকে নিয়ে এসে দেখে সব ফটকে ক্রস চিহ্ন।

বুদ্ধিমতী মর্জিনা যখন দেখেছে ফটকে ক্রস চিহ্ন, তখন সে সবার ফটকে ক্রস চিহ্ন দিয়েছে।

আবু হুসেন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। আবু হুসেন বাজারে গুপ্তচর জোরদার করে।

গুপ্তচরের মাধ্যমে জানতে পারে৷ এলাকায় আলীবাবা রাতারাতি ধনী হয়েছে। ছিল গরিব কাঠুরিয়া এখন এলাকার সেরা আমিরদের একজন।

আবু হুসেন ব্যবসায়ী সেজে চল্লিশ চোরকে তেলের মটকায় ভরে আলীবাবার অতিথি হয়। বলে, সে তেল ব্যবসায়ী চল্লিশ মটকা তেল নিয়ে এসেছে বাজারে বিক্রি করতে, রাতে অতিথি হতে চায়।

আলীবাবা আবু হুসেনকে অতিথি হিসাবে গ্রহণ করে, এবং চল্লিশ মটকা তেল নিজ হেফাজতে রাখে।

বুদ্ধিমতী মর্জিনা আবু হুসেনকে চিনতে পারে এবং মটকায় তেল নয়, চোর জানতে পারে।

মর্জিনা রাতে গরম তেল ঢেলে প্রত্যক মটকায় সবাইকে মারে, তারপর আবু হুসেন।

খুনি, লুটেরা আবু হুসেন ও তার দল এভাবে শেষ হয়ে যায়।

এই সিনেমার মূল শিক্ষণীয় বিষয় হলো— লোভে পাপ পাপ মৃত্যু! আসুন আমরা লোভ থেকে দূরে থাকি।

কাসেম বাবার করুণ পরিণতির জন্য কাসেমের লোভই দায়ী।

আমাদের সমাজে চারদিকে কাসেম বাবা আর কাসেম বাবা।


Leave a reply