Select Page

সূর্যকন্যা ও প্রেমিক লেনিন

সূর্যকন্যা ও প্রেমিক লেনিন


রোজ সূর্য ওঠে আবার ডোবে। ডোবার সময় কারো কারো মন খারাপ যদি হয়ে যায় পরদিন আবার সূর্য উঠবে দেখতে পাবে ভাবলে মন ভালো হবে নতুন শুরুর জন্য। সূর্য আলোর প্রতীক। সমাজ-সংসারের চিরন্তন অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতে চায় অনেকেই বিশেষত অন্ধকারে পড়ে থাকা নারীরা। তাদেরই একজন হয়ে সূর্যের মতো আলোর দিকে ফিরতে চাওয়া নারীর গল্পে তাই ছবির নাম হয়ে যায় ‘সূর্যকন্যা।’ ছবির রূপকার আলমগীর কবির। সূর্যকন্যা পশ্চিমবঙ্গের অভিনেত্রী রাজশ্রী বোস আর লেনিন আমাদের বুলবুল আহমেদ।

সূর্যকন্যার জন্ম হয়েছিল এক শিল্পীর মনে। খোদাই করা মূর্তিগড়া শিল্পী। নাম তার লেনিন। স্বপ্ন আর বাস্তবতার কুহক যাকে বলি ম্যাজিক রিয়ালিজম আবার ইলিউশন ভার্সেস রিয়েলিটিও বলা যেতে পারে এরই মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারী কল্পনার সাথে বাস্তবের যোগাযোগ ঘটিয়ে রক্ত-মাংসের নারী হয়ে ধরা দিলো লেনিনের কাছে। লেনিন তাকে ভালোবেসে ফেলল। সে কি ভালোবাসা!
– তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো তো!
– হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসি
– কোনোদিন কামনা করবে না তো!
– না করব না কিন্তু তোমাকে পেতে চাই
– পাবে। আমার যেদিন মুক্তি হবে সেদিন পাবে ততদিন অপেক্ষা করবে তো!
– দরকার হলে জন্ম জন্মান্তরে অপেক্ষা করব তোমাকে পাবার জন্য। সবুজ যেমন প্রকৃতিকে ভালোবাসে তেমনি করে ভালোবেসে যাবো

লেনিন কথাগুলো বলে যায় আর সূর্যকন্যা শুনে যায়। ভালোবাসার মধ্যে কামনার ইতিহাস পুরনো যারা এটা থেকে বের হতে পারে হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে ভোগ থেকে মুক্ত হয়ে নারী তাদেরই ভালোবাসে মন থেকে।
– মুক্তি দেবে কে তোমাকে?
– মুক্তি কি কেউ দেয়? আদায় করে নিতে হয়।

প্রাচীন পোড়োবাড়ি থেকে বেরিয়ে সূর্যের ঝলকানিতে আলমগীর কবির এখানেই ছবির নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। স্থিরদৃশ্যে, চিত্রশিল্পে নারীর বন্দিত্বের ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে যেভাবে চলে এসেছে তারই রূপকল্প দেখান। সূর্যকন্যা বলে মুক্তি আদায় করে নেয়ার কথা। প্রথমে সে গানে গানে বলেছিল-‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী/আমারে আলোতে ডেকে নাও’ সেটা ছিল অনুরোধ, আকুতির সুর কিন্তু পরে সুরে যোগ হয় বিদ্রোহী মনন তাই মুক্তি আদায় করে নেয়ার কথা বলে। লেনিন জানায় মুক্তি একদিন আসবেই এবং ভালোবাসাই পারে মুক্তি আনতে। লেনিন সূর্যকন্যাকে ভালোবাসে যার মুক্তি হবে সূর্যকন্যার কথামতো একদিন শেষরাতে ভোরের দিকে। ‘ভোর’ বা ‘নতুন সূর্য’ সম্ভাবনা, শত বছরের নারীর দাসত্বের মুক্তিকে আহবান করে। যেদিন তার মুক্তি হবে সে রাতে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মদে ডুবে থাকে লেনিন কিন্তু মনে পড়ে শেষরাতে তার ভালোবাসার মুক্তির কথা। সময় অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে তাও লেনিন ছুটে যায়। পরিচালক আলমগীর কবির এখানে সূক্ষ্ম দর্শনটি প্রয়োগ করেন, নারী যে মুক্তি চায় আলোর দিকে ফিরতে তার জন্য পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাই লেনিন হয়ে যায় সেই পুরুষ যে সূর্যকন্যাকে নতুন সূর্যের সাথে পরিচিত করাতে এবং হৃদয়জ ভালোবাসাতে আবদ্ধ করতে চায়।

নায়কের নাম লেনিন নামকরণও প্রগতির কথা বলে। ভ্লাদিমির লেনিনের প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস যাদের জানানা তারা সহজেই ধরে নিতে পারবে। খোলা মাঠের ছোট্ট দালানে দোতলায় উঠে কাল্পনিক জনতাকে উদ্দেশ্য করে লেনিন ভাষণ দেয় যখন তখনই পরিষ্কার হয় নায়ক লেনিন পিছিয়ে পড়া সমাজের বিপরীতে হাল ধরতে চায়। যে যার স্বাধীনতা মতো কাজ করবে, সম অধিকার থাকবে, বাক স্বাধীনতা থাকবে এসব বক্তব্য দিতে থাকে। সাথে বাস্তবতাও দেখান পরিচালক যখন উপস্থিত কয়েকজন মাঠ থেকে হাসতে থাকে লেনিনের ভাষণ শুনে। তবু তার প্রগতিশীল চেতনাকে সম্মান করতে হয় আর সে মানসিকতা থেকেই তার জীবনে সূর্যকন্যার দেখা পাওয়া।

সূর্যকন্যা যখন সুজলা হয়ে ফিরে আসে লেনিন বিস্মিত হয়। কল্পনা, মোহভরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের ছায়ায় বিমূর্ত খোদাই করা নারীটি তার সাথে যে ভালোবাসার দাবিতে এসেছিল তাকে বাস্তবে দেখে বিস্মিত না হয়ে কি পারে! কিন্তু আলমগীর কবির বোঝাতে চেয়েছেন চিন্তা যদি স্বচ্ছ হয় বাস্তবায়ন একদিন না একদিন হবেই। সুজলা সেই বাস্তবায়নের অংশ যাকে সূর্যকন্যায় দেখেছিল লেনিন।

সূর্যকন্যা রাজশ্রী বোস আর তার প্রেমিক লেনিন বুলবুল আহমেদ সূক্ষ্ম অভিনয়ে চরিত্র দুটিকে জীবন্ত করেছেন। বইয়ের পাতায় ইউরোপে যে আলোকময়তার ইতিহাস আমরা পড়ি, নারীবাদিতার ইতিহাস পড়ি, পুরুষতন্ত্রকে এককভাবে দোষারোপ করা দেখি ভূমিকা পালন বাদ রেখে নির্মাতা আলমগীর কবির সব উত্তর দিয়ে দেন সেই সত্তরের দশকেই তাঁর মুন্সিয়ানায় ভরা বক্তব্যধর্মী এ ছবিতে।
তুমি মহলে মহলে ঘোরো তাই তুমি মহিলা..
তোমাকে রমণ করতে চায় যারা তারা বলে রমণী..
তোমাকে লালন করতে চায় যারা নিজস্ব ভোগে পড়ে তারা বলে ললনা..
তোমাকে অবুঝ বলে যারা তারা বলে অবলা..
কিন্তু ‘নারী’ তোমাকে ভালোবাসে যারা আর তুমি ভালোবাসো যাদের তারা আজও সূর্যকন্যা-লেলিন।
নজরুল তো সেই কবে বলেই দিয়েছেন –
‘কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষী নারী।’


Leave a reply