Select Page

ইতিহাস জানা না থাকলে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ আনন্দ দিতে পারে

ইতিহাস জানা না থাকলে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ আনন্দ দিতে পারে

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের পরিপূর্ণ দখল নেই ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ তাদের আনন্দ দিতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস যারা জানেন তাদের এতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে আরেফিন শুভ খুব অবিবেচনাপ্রসূত কাস্টিং এটা আমার শুরু থেকেই মনে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সমস্ত নেতিবাচকতা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সিনেমা দেখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ হওয়ার পর সেই ধারণা তো একটুও বদলায়নি, উপরন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে আরিফিন শুভ যেন আমার পূর্ব ধারণাকে সত্য প্রমাণ করার জন্যই চেষ্টা করে গেছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক সিনেমাটি হওয়ার দরকার ছিল বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকে রিলে ধারণ করার একটা মাইলফলক। হওয়ার কথা ছিল আমাদের পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের একেবারে ঝরঝরে সচিত্র বর্ণনা। অথচ ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’-এ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের যে ইতিহাস চিত্রায়িত হয়েছে সেটা ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক পাঠ। যে ইতিহাস বহুল প্রচলিত, যে ইতিহাস একপেশে ও ইতিহাসের একেবারে গভীরের এমন কোনো ইতিহাস এখানে তুলে আনতে পারেনি, যা ইতিহাস পিপাসু মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে।

একটা প্লট চিত্রায়িত করতে প্লটটির পেছনের যে ঘটনা সেসবের ধারেকাছেও যায়নি চিত্রনাট্যকার। অর্থাৎ যথেষ্ট আবহ তৈরি না করেই একের পর এক দৃশ্য চিত্রায়িত করা হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পেছনে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ একটা বড় কারণ। এছাড়া সত্তরের বন্যায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হলে বিশ্বের অনেক দাতাগোষ্ঠী ত্রাণ সহায়তা দিলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার দেশের দুর্গত জনগণের দিকে ফিরেও তাকায়নি। শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় সশরীর বন্যাকবলিত মানুষের পাশে ছিলেন। ফলশ্রুতিতে পূর্বপাকিস্তানের মানুষ ভোটে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল।

পৃথিবীর ইতিহাসে এটা এমন এক বন্যা যা একটা জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। অথচ ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত বিজয় দেখালেও এর নেপথ্যে এইসব কারণগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়নি।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণটির কথাও বলা যাক। বহু ঘটনাপ্রবাহ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বহু অত্যাচার, নিপীড়ন, জুলম ও বহু বাঙালি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু কেন বলেছিল ‘আর যদি একটা গুলি চলে?’, কারণ সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্টতা পাওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না চাওয়াকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের পর দুই মাসে সারাদেশে বহু বিপ্লবী ছাত্র-জনতা এবং বহু নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। অথচ সেসবের কিছুই না দেখিয়ে হুট করে ৭ মার্চের ভাষণটি নিয়ে এসেছে দৃশ্যপটে।

একই ব্যাপার হয়েছে ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডিতেও। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে ব্যাপক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হয়েছে, সেসবের ধারেকাছেও যায়নি পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। শুধু একবার মাত্র জিয়াউর রহমানের কাছে খন্দকার মোশতাকের যাওয়ার একটা দৃশ্য দেখিয়ে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ দৃশ্যায়িত করে ফেলেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে ৭ মার্চের ভাষণ, সত্তরের নির্বাচন ও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পর্যন্ত মনে হয়েছে খাপছাড়া, বিক্ষিপ্ত ও আরোপিত।

এ তো গেলো চিত্রনাট্যের কথা। যদি ইতিহাসের উপস্থাপন বিষয়ে বলি, ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সেখানেও ব্যর্থ। অনেক দৃশ্যপট ইতিহাসের সঙ্গে মেলেনি। কতগুলো বিষয় একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মনে হচ্ছে কাউকে ইতিহাস থেকে বাদ দিতে, কাউকে ইতিহাসে জোরপূর্বক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে উদাহরণ দেয়া যাক। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসের মতো এ ছবিতেও তাজউদ্দীন আহমদকে অচ্ছ্যুত করে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিক জীবন ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া চিত্রায়িত করতে চাইলে সেটা মিথ্যাচার করা হবে। ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’-এও তাই করা হয়েছে।

এবার মেকিং নিয়ে বলা যাক। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় খরচ হয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। মুভিতে আকুপাকু করে খুঁজলেও এই টাকার অর্ধেকও আপনি পাবেন না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলোয় মঞ্চের সামনে ফেইক ও দৃষ্টিকটু জনসমাগমের দৃশ্য এডিট করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েকটা ভাষণে তো উত্তাল জনতার জায়গায় ব্লার স্টিল ইমেজ বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যতগুলো সেট স্ক্রিনে দেখা গেছে সবগুলোকে আলগা লেগেছে। রিয়েলিস্টক একেবারেই লাগেনি। চরিত্রগুলোর কস্টিউম মনে হচ্ছিল যেমন খুশি তেমন সাজের মতো একটা ব্যাপার। আরিফিন শুভ ও রিয়াজের পরচুলা, চঞ্চল চৌধুরী ও রাইসুল ইসলাম আসাদের দাড়ি মনে হচ্ছিল এই বুঝি খুলে পড়ে যাবে। পোস্ট প্রোডাকশনে এক্সট্রা বাজেট ২৫ কোটি টাকা, সেই সিনেমার ভিএফএক্স দেখে শত দুঃখেও আপনি হাসতে বাধ্য হবেন। ভিডিও গেমসের দৃশ্য লাগিয়ে দিয়েছে বিমান হামলা, বোমা হামলাসহ যুদ্ধের বেশিরভাগ দৃশ্যপটে।

একমাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকীর আহমেদ ছাড়া লিড কারেক্টারে আর কেউ চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। স্ক্রিনটাইম কম হলেও রাইসুল ইসলাম আসাদকে মওলানা ভাসানীর মতো দেখতে লেগেছে। তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে রিয়াজের মতো শক্তিমান অভিনেতার ওভারঅ্যাক্টিং খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। খন্দকার মোশতাক চরিত্র ফজলুর রহমান বাবু, শেখ লুৎফর রহমান চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী, বেগম ফজিলাতুন্নেছা চরিত্রে তিশাদের মতো মেধাবী শিল্পীদের বোকা বোকা অভিনয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালের ব্যর্থতাকেই ইঙ্গিত করে।

অনেকেই বলতে চান বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, সুতরাং এখানে আরিফিন শুভকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে কারণে দোষ দিচ্ছিও না। দোষ দিচ্ছি নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে জেনেও বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবের বায়োপিকে নাম ভুমিকায় অভিনয়ে রাজি হওয়ার জন্য। এক উচ্চতা ছাড়া আর কোনো কারণ এমনিতেই নেই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিবেচিত হওয়ার। কিন্তু যে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনের মতো অভিনেতা অভিনয় করতে সাহস করেনি, ইতিহাসে স্থান পাওয়ার লোভে সেই চরিত্রে শুধুমাত্র ছয় ফিট উচ্চতার যোগ্যতাকে সম্বল করে অভিনয়ের হিম্মত দেখানোর জন্য বহু বছর শুভকে লাগাতার সমালোচনার শাস্তি হজম করতে হবে।

মুজিব: একটি জাতির রূপকার; পরিচালক: শ্যাম বেনেগাল; চিত্রনাট্য: অতুল তিওয়ারি, শামা জাইদি; রেটিং: ২/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

রহমান বর্ণিল

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী"

মন্তব্য করুন