একজন শওকত আকবর
‘সেনাপতি, বন্দি করো এই বিদ্রোহী যুবককে। রাজপ্রাসাদের মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব যে ভুলে যায়, সামান্য বেদের মেয়েকে যে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে ঢুকতে পারে তার মতো সন্তানের আমার প্রয়োজন নেই। তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করো। কাল তাকে হত্যা করা হবে আর জোসনাকে পাঠিয়ে দাও বনবাসে।’
সংলাপগুলো এক নিঃশ্বাসে ভরাট কণ্ঠে স্বর ঠিক রেখে কবিতার মতো আবৃত্তি করে বলে যান তিনি। তিনি আমার বাবার প্রিয় অভিনেতা। বাবা বলতেন তাঁর কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হতেন তিনি। যেবার ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ মুক্তি পায় সিনেমাহলে তাঁর বজ্রকণ্ঠের আওয়াজে দর্শক করতালি দিয়ে মুখরিত করত। রাজা-বাদশাহ, ফোক-ফ্যান্টাসি ছবিতে তিনি কাঁপিয়ে দিতেন তাঁর বজ্রকণ্ঠের অভিনয়ে। হুম, বলছি কিংবদন্তি অভিনেতা শওকত আকবরের কথা।
শওকত আকবর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গর্বিত একজন অভিনেতা। দেশের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধির সময়ে সামনে থেকে যেসব অভিনেতারা লিড দিয়েছেন তিনি তাঁদেরই একজন।
মূল নাম সাইয়েদ আকবর হোসেন, চলচ্চিত্রে নামটি সংক্ষিপ্ত করানো হয়। জন্ম ভারতের বর্ধমান জেলায় ১৯৩৮ সালের ৭ মার্চ। স্ত্রী মুক্তা আকবর। শওকত আকবর-মুক্তা আকবর দম্পতির ছেলে মিল্টন আকবর ছিলেন আরেক গুণী মানুষ। তিনি ‘এলআরবি ও মাইলস’ ব্যান্ডের জনপ্রিয় ড্রামার ছিলেন।
শওকত আকবরের শৈশব কাটে হুগলিতে। সিনেমাহলে যাওয়া-আসা ছিল এবং এভাবেই চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ জন্মে তাঁর। ‘দেবদাস’ নামে মঞ্চনাটক করেছিলেন যুবক বয়সে। ১৯৫০ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় পরিস্থিতির জন্য ঢাকায় চলে আসেন সপরিবারে। ডাক্তারি পড়ার পরেও চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন ভালোবেসে। তাঁর এই দিকটি উচ্চমাত্রায় প্রশংসনীয় যেখানে ডাক্তারি পাশ করে লোকে কোটি কোটি টাকা কামাই করার কথা ভাবে তিনি তা না করে চলচ্চিত্রে আসেন ভালোবাসা থেকে। আসাতে বরং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের লাভ হয়েছে আমরা গর্ব করার মতো একজন অভিনেতা পেয়েছি।
তাঁর প্রথম অভিনীত ছবি ‘তালাশ’ কিন্তু মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি ‘এইতো জীবন।’ বাংলা ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি উর্দু কিছু ছবিতে নায়ক ছিলেন যেমন – প্যায়সে, পুনম কি রাত ও ভাইয়া। পরিচালনা করেছেন দুটি ছবি – আলোর পিপাসা ও বিমানবালা (মুক্তি পায়নি)।
অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সব ছবি: আখেরি স্টেশন, সুতরাং, মিলন, মেঘ ভাঙা রোদ, জানাজানি, বড়বউ, টাকা আনা পাই, জীবন থেকে নেয়া, মোমের আলো, সোহাগ, ফকির মজনু শাহ, মহেশখালীর বাঁকে, নদের চাঁদ, বাজিমাত, অবুঝ মন, ছুটির ঘণ্টা, শহর থেকে দূরে, বিজয়িনী সোনাভান, পরিবর্তন, দেনা পাওনা, নতুন সুর, অপরিচিতা, জংলি ফুল, মহানায়ক, আরাধনা, দি ফাদার, নিশান, দোস্ত দুশমন, পরিচয়, অভাগী, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, দূর থেকে কাছে, লালন ফকির, এখানে আকাশ নীল, ছন্দ হারিয়ে গেল, গাঁয়ের বধূ, মায়ার সংসার, রূপবান, প্রেমকাহিনী, মিয়াভাই, পদ্মা মেঘনা যমুনা, যাদুমহল, হুঁশিয়ার, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, দিদার, গুনাই বিবি, গৃহ বিবাদ, মিস লঙ্কা, লালু মাস্তান, স্বর্গ নরক, মেহমান, বিষকন্যার প্রেম, পুরস্কার, লাইলী মজনু, মেঘ বিজলি বাদল, বড়বাড়ির মেয়ে, যন্তর মন্তর, ছক্কাপাঞ্জা, তিনকন্যা, দিল, সহধর্মিণী, ক্ষতি পূরণ, বিধাতা, অর্জন, অন্ধ প্রেম, টাকার পাহাড়, অচেনা, বেদের মেয়ে জোসনা, রাজার মেয়ে পারুল, কাশেম মালার প্রেম, বিশ্বাস অবিশ্বাস।
শওকত আকবর একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। অনেক ধরণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির হ্যান্ডসাম চরিত্রটি সেই সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। বোন রওশন জামিলের পারিবারিক কর্তৃত্ব আর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনিও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন রাজ্জাকের পাশাপাশি। ‘টাকা আনা পাই’ ছবির কমেডি অভিনয়ে মিশে গিয়েছিলেন। ‘ক্ষতি পূরণ’ ছবিতে আহমেদ শরীফের হাতে খুন হন তিনি এবং তাঁর খুনের ঘটনাকে ঘিরেই ছবির অন্যান্য চরিত্র, ঘটনা সব এগিয়ে চলে। খুন হবার সময় আহমেদ শরীফ ও ড্যানি সিডাকের সাথে তাঁর সাইলেন্ট অ্যাকটিং অনবদ্য ছিল। উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী কুমার শানুর চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরুই হয় শওকত আকবরের লিপে ‘তিনকন্যা’ ছবিতে। তাঁর লিপেই ‘তিনকন্যা এক ছবি’ গানটি ছিল। ছোট্ট তিন মেয়ের রাগ ভাঙাতে আদর করে গান গেয়ে যান তিনি। অসাধারণ ছিল গান ও অভিনয়। ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাস’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের বড়ভাই ছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়ি থেকে ছোটভাইয়ের স্ত্রীর অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে শহরে কাঞ্চনেরই বাড়িতে ওঠেন কিন্তু জানতে পারেননি। পরে জানতে পেরে কাঞ্চনের ফটোগ্রাফকে আদর করতে গেলে কাঞ্চন রেগে মারধর করে আর শওকত আকবর গামছা দিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ ভাবী আনোয়ারাকে দেখে কাঞ্চন অবাক হয় এবং জানতে চায় কাকে মারল। সিকোয়েন্সে বড়ভাইয়ের চরিত্রেও শওকত আকবর অসাধারণ ছিলেন। রাজা-বাদশাহ বা পোশাকি ফোক-ফ্যান্টাসি ছবির রাজা, বাদশাহ চরিত্রগুলোতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কণ্ঠ দিয়ে বাজিমাত করে দিতেন। তাঁর সংলাপ বলার ধরণে আবৃত্তির গুণ থাকত এবং বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠত। এভাবে তিনি বহুমুখী চরিত্রের সফল একজন অভিনেতা হয়ে ওঠেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’-র রঙিন ভার্সনে শওকত আকবর বেশি ভালো করতেন। অবশ্যই প্রবীরমিত্র অসাধারণ ছিলেন কিন্তু কণ্ঠস্বরের বিবেচনায় শওকত আকবর প্রবীরমিত্রের থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকতেন। অবশ্যই তাঁদের দুজনের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই কথাটা বলা।
যে চলচ্চিত্রকে একজন শওকত আকবর অনেক দিয়েছেন একটা সময় তার সাথেই তাঁকে অভিমান করতে হয় পরিস্থিতির কারণে। তিনি লন্ডন চলে যান এবং সেখানেই ২০০০ সালের ২৩ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। লন্ডনের মুসলিম কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
একজন শওকত আকবর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কি ছিলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাবে সময়ের সাথে সাথে। সেজন্য তাঁকে জানতে এবং চর্চা করতে হবে।