একটু দাম্পত্য ভু্ল বোঝাবুঝি সারাজীবনের কান্না!
৭ মে ১৯৮৯ রবিবার ছিল ঈদুল ফিতর। ঈদের পরদিন মা, আমি ও পাড়াত এক খালাতো বোন পাহাড়তলী বেড়াতে যাই। আমার মায়ের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর মেয়ের বাসায়।
ঈদের পরদিন বিটিভিতে দুপুরবেলা সিনেমা দেখায় জানতাম। তাই ওই বোনকে বললাম, আপা কাল টিভিতে বই (আমরা সিনেমাকে বই বলতাম) আছে। আমার মাকে বলেন আমরা লাকী আপার বাসায় বেড়াতে যাবো। তবে সিনেমার কথা বলবেন না।
মা রাজি হলেন। লাকী আপার স্বামী পাহাড়তলীর স্থানীয় বাসিন্দা ধনী ব্যক্তি। ঘরে টিভি আছে। সকাল দশটার মধ্য চলে গেলাম লাকী আপার বাসায়। যতটুকু মনে পড়ে দুপুর বারোটায় সিনেমা আরম্ভ হয়।
সিনেমার নাম ‘জীবন নৌকা’, অভিনয়ে; সোহেল রানা, সুচরিতা, কামাল পারভেজ, ডলি চৌধুরী প্রমুখ! পরিচালনায় সোহেল রানা নিজে, তিনি মাসুদ পারভেজ পৈতৃক নামে পরিচালনা করেন।
আশি দশকে যত সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, আমি এর ৯৯ শতাংশ দেখেছি। ‘জীবন নৌকা’ আমার দেখা ওই দশকের যে কয়টি ক্লাসিক সিনেমা আছে তার অন্যতম। এমন শিক্ষামুলক কাহিনির সিনেমা বারবার তৈরি হওয়া প্রয়োজন। দাম্পত্য সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে এ সব সিনেমা।
কাহিনি সংক্ষেপ: সোহেল রানা ধনীর দুলাল ও উচ্চশিক্ষিত যুবক, সুচরিতা পিতৃহীন গরীব ঘরের মেয়ে। তাদের মাঝে গভীর প্রেম। সুচরিতা নৌকায় ভ্রমণ করতে খুব ভালোবাসে। তাই সোহেল রানা প্রেমিকাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় প্রায় নৌকা ভ্রমণে যায়।
ধনী ও গরীবের ব্যবধানের বাবা অমত জানালে সোহেল রানা তাকে না জানিয়ে সুচরিতাকে বিয়ে করে। তারপর বাড়ি নিয়ে আসে। বাবা সুচরিতাকে বরণ করে না। তাই সোহেল রানা স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বাহির হয়ে যায়, বন্ধুর বাড়িতে উঠে। বন্ধু ও বন্ধুর পত্নী তাদের বাসর সাজিয়ে দেয়।
সোহেল রানা সরকারি চাকরি পায়, কক্সবাজারে ফরেস্ট অফিসার। সুচরিতাকে বন্ধুর বাসায় রেখে কক্সবাজার আসে চাকরিতে যোগ দিতে। আর একই অফিসে কামাল পারভেজ সহকারী ফরেস্ট অফিসার, এক পাহাড়ি মেয়ের সাথে তার গভীর প্রেম। এই সম্পর্কের কথা তারা দুজন ছাড়া কেউ জানে না।
সোহেল রানা পদবিতে কামাল পারভেজের সিনিয়র কিন্তু বসের বন্ধুসুলভ ব্যবহারে মুগ্ধ হয়। কিছুদিনের মধ্যে সোহেল রানা সুচরিতাকে কক্সবাজার নিয়ে আসলে দেখা যায় কামাল পারভেজ তার ক্লাসমেট ছিল। অনেকদিন পর তাদের দেখা। সোহেল রানাও খুশি কামাল পারভেজ স্ত্রীর ক্লাসমেট জানতে পেরে।
পাহাড় ঘেরা সরকারি বাংলোয় সোহেল রানা-সুচরিতার স্বাধীন দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধুর প্রেমে সরকারি বাংলো, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সবুজ অরণ্য রঙিন হয়ে ওঠে। নদী-খালে চলতে থাকে নৌকা ভ্রমণ।
সুচরিতা কাঠ দিয়ে নৌকার শোপিস বানিয়ে সোহেল রানাকে উপহার দেয়। বলে, এই নৌকায় আমার জীবন আছে, এটা আমার জীবন নৌকা।
বনদস্যূদের দমন করতে একদিন সোহেল রানা একা একা অভিযানে বাহির হয়। বনদস্যূরা তার জিপের চাকার নাটবল্টু লুজ করে রাখে। ফেরার পথে জিপ অ্যাকসিডেন্টে মারাত্মকভাবে জখম হয় সোহেল রানা। ডাক্তার সুচরিতাকে বলে, আপনার স্বামী সুস্থ্য কিন্তু ছয় মাস শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। তাতে মেরুদণ্ডে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
সুচরিতা ডাক্তারকে বলে বিষয়টি যেন সোহেল রানাকে না জানানো হয়। তাতে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে। ছয়মাস পর্যন্ত সোহেল রানাকে এড়িয়ে চলতে থাকে সুচরিতা। স্বামী যত শারীরিকভাবে কাছে টানতে চায়, সুচরিতা তত দূরে সরে যায়। এতে সোহেল রানা মানসিকভাবে আহত হতে থাকে।
সুচরিতার ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। ডায়েরি সবকিছু লিখে রাখে সে। এ দিকে সোহেল রানা মনে করে, সুচরিতা আর তাকে ভালোবাসে না। সুচরিতার জীবনে অন্যকেউ এসেছে।
এ দিকে সুচরিতার সাথে সেই পাহাড়ি মেয়ের সখ্য হয়। কামাল পারভেজ সকালে পাহাড়ে পাহাড়ে প্রাতঃভ্রমণ করতো। সুচরিতাও তাই করতো। একদিন পাহাড়ি মেয়েটি সুচরিতা ও কামাল পারভেজের ছবি তোলে। সুচরিতার অনুমতিক্রমেই ছবি তোলা হয়। একদিন পাহাড়ি মেয়েটি একটি খাম দেয়। খামের মধ্যে কামাল পারভেজ ও সুচরিতার ছবি, কামাল পারভেজের ছবি ও একটি চিঠি। এই চিঠি কামাল পারভেজ পাহাড়ি মেয়েটিকে লিখেছিল।
পাহাড়ি মেয়েটি সুচরিতার কাছে খামটি জমা রাখে। খুলতে মানা করে। সোহেল রানা খামটি দেখে জানতে চায়, কীসের খাম? সুচরিতা জবাব দেয়, টপ সিক্রেট! সুচরিতা খামটির বিষয়েও ডায়েরিতে লিখে রাখে।
সুচরিতা কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি ঢাকা যায়। সোহেল রানা কক্সবাজার থাকে, আলমারি খুলে খামটি দেখতে পায়। খুলে দেখে ছবিগুলো দেখে, চিঠিটি মূলত প্রেমপত্র। সোহেল রানা বুঝে নেয় কামাল পারভেজের সাথে সুচরিতার পরকীয়া। সে মনে মনে রাগ পুষতে থাকে।
কিছুদিন পর সুচরিতা কক্সবাজার আসে। ততদিনে ছয়মাস পূর্ণ হয়। ডাক্তার সুচরিতাকে অনুমতি দেয় দাম্পত্য মিলনের। সুচরিতা খুশি হয়ে স্বামীকে নিয়ে সৈকতে যায়। তখন জোয়ার ছিল। অনুমতি চায় সমুদ্রে নামার জন্য। সুচরিতা যখন প্রথম কক্সবাজার আসে তখন একবার জোয়ারের সময় সমুদ্রে নামে। ঢেউয়ের মাঝে ডুবে যেতে থাকলে সোহেল রানা জীবনবাজি রেখে উদ্ধার করে।
এবার সোহেল রানা অনুমতি দেয়। সমুদ্রে নামলে ঢেউ সুচরিতাকে গ্রাস করে। সোহেল রানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। বাঁচানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। সমুদ্রে হারিয়ে যায় সুচরিতা। স্বামী নীরব দর্শকের মতো দেখে। সে মনে করতো স্ত্রী বিশ্বাসঘাতিনী, তাই কৌশলে হত্যা করলো।
বাংলোয় এসে সুচরিতার জিনিসপত্র যখন ভাঙচুর করতে থাকে, তখন ডায়েরিটি পায় সোহেল রানা। জানতে পারে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণ, কামাল পারভেজ ও পাহাড়ি মেয়ের প্রেম কাহিনি ও খামের রহস্য।
তখন সোহেল রানার কান্না ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দিনরাত কাঁদে আর কাঁদে। সুচরিতা কল্পনায় আসে— প্রশ্ন করে, কেন তাকে হত্যা করলো আর জীবন নৌকাটি চায়।
কাহিনির তিনটি দিক দাম্পত্য জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ: স্বামী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে তাই দূরত্ব বজায় রাখার রহস্য গোপন রাখে স্ত্রী। ফলাফল হিতেবিপরীত। যদি খোলামেলা আলোচনা হতো, তবে এমন বিপর্যয় হতো না।
স্বামী বা স্ত্রী যদি সকল সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। তাহলে সকল সমস্যার সমাধান হয়। তারা যদি জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে কিছু গোপন করে বা রহস্যের চাদরে ঢাকে তাহলে দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় আসবেই। তাই দাম্পত্য অথবা পারিবারিক-সামাজিক জীবনের সমস্যার খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন। কেনোকিছু গোপন করা উচিৎ নয়। সংসার সুখের হয় তখন, যখন স্বামী-স্ত্রী তাদের ব্যক্তিগত জানালা যদি খুলে দেয় জীবনসঙ্গীর জন্য।
সোহেল রানা কেনোকিছু যাচাই বাছাই না করেই সুচরিতাকে বিশ্বাসঘাতিনী ভেবে নিল আর কৌশলে হত্যা করলো। কিন্তু তার উচিৎ ছিল সবকিছু ভালোমতে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
এমন ভুল শুধু ‘জীবন নৌকা’র সোহেল রানা করে না। বাস্তব জীবনে অনেকেই চুড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কখনো তালাক কখনো হত্যার মতো জঘন্য কাজ। তাই যখন কোনো স্বামী বা স্ত্রী দেখে যে তার জীবনসঙ্গী এমন কাজ করছে যা করা কখনো উচিৎ নয়, তখনই সিদ্ধান্ত না নিয়ে যাচাই করতে হবে। প্রমাণ সংগ্রহ করে শান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। মনে রাখবেন ঘটনার আড়ালে ঘটনা থাকে।
স্ত্রী সুচরিতার উচিৎ ছিল না কামাল পারভেজের সাথে ছবি তোলা। বিবাহিত কোনো নারী-পুরুষের উচিৎ নয় পরনারী বা পরপুরুষের সাথে ছবি তোলা। প্রত্যেক স্বামী বা স্ত্রী তার জীবন সঙ্গীকে ভাবে একান্ত নিজের। এটাই ভালোবাসা।
৩১ বছর আগে দেখা সিনেমা তাই পুরো কাহিনী মনে নাই। না হয় আরো কিছু পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা যেত।
মুক্তিযোদ্ধা, চিত্রনায়ক, চিত্রপ্রযোজক, চিত্রপরিচালক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানাকে ধন্যবাদ। এমন একটি ক্লাসিক ও শিক্ষামুলক গল্পের সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য।