Select Page

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নিয়ে বিখ্যাত লেখাটি বইয়ের পাতায়

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নিয়ে বিখ্যাত লেখাটি বইয়ের পাতায়

বেদের মেয়ে জোসনা‘ নিয়ে ফরহাদ মাজহারের লেখাটি বাংলা সিনেমা বিষয়ক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে প্রায় তিন দশক ধরে। সুখবর হলো, শিগগিরই দুই মলাটে বন্দী হচ্ছে প্রবন্ধটি।

‘সিনেমাপাঠ’ ও ফরহাদ মজহার

শনিবার এসেছে এ ঘোষণা।  আরও একটি লেখার সঙ্গে সংকলিত বইটির শিরোনাম ‘সিনেমাপাঠ’। প্রকাশ করছে ম্যাজিক লন্ঠন।

এ নিয়ে রবিবার ফেসবুকে মুখ খুলেছে ফরহাদ মজহার।

তিনি লেখেন, “আমি সিনেমার তাফসির করবো, সেটা কখনই সজ্ঞানে ভাবি নি। ‘আর্ট ফিল্ম’ (?) জিনিসটা আসলে কী! উন্নাসিকতা, অভিজাতগিরি, আঁতলামি? এর বিরুদ্ধে আমাকে কলম ধরতে হয়েছিল এবং হয়। যেসব ‘বই’ সাধারণ গরিব মানুষ পয়সা দিয়ে সিনেমাহলে দেখে সেইসব ছবির সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে, কথাটা বোঝানো জরুরী বোধ করলাম। এই আমার আগমনের কেচ্ছা।

অভিজাতগিরি আর আঁতলামি অপছন্দ করি বলে আমি আমার বন্ধু খসরু ও তারেকের দুষমন হয়ে গেলাম। তাদের জীবদ্দশায় এই দূরত্ব কমাতে পারি নাই। তবে প্রধান কারন ছিল ‘ওয়ার অন টেরর’ । অধিকাংশ প্রগতিশীলদের বিশ্বাস যে ধর্ম — বিশেষ ভাবে ইসলাম — বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। এই অসুখ থেকে মুক্ত হওয়া দরকার

তারেক মাসুদ ‘মুক্তির গান’ ডকুমেন্টারি বানাল ১৯৯৬ সালে। এরপর ২০০২ সালে ‘মাটির ময়না’। ইতোমধ্যে ওয়ার অন টেরর শুরু হয়ে গিয়েছে। তারেক মাসুদ জর্জ বুশের মতোই বোঝাল ইসলাম দুই প্রকার। এক প্রকার ‘গুড মুসলিম’ আর আরেক প্রকার ‘ব্যাড মুসলিম’। তারেকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর খারাপ লেগেছিল। তাই মন থেকে তাকে দূরে রাখতে পারি নি। তাকে নিয়ে অন্যত্র লিখেছি।

একদা যখন বাংলাদেশে আধুনিক ও প্রগতিশীল লোকজন সত্যজিত আর ঋত্বিক দেখছে তখন বোমা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন সালাহ্‌উদ্দীন। তাঁর ‘রূপবান’ সিনেমা হিট। আমি তখন গোগ্রাসে মার্শাল মাকলুহান পড়ছি। ‘মিডিয়াম ইজ দ্য ম্যাসেজ’ বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। কেন বাংলাদেশে সিনেমার ফ্রেমের মধ্যে যাত্রা অভিনীত হওয়াটাই অনিবার্য ছিল সেটা মাকলুহান পড়ে বুঝতে শুরু করি। কিন্তু কিভাবে মাধ্যম আমাদের ইন্দ্রিয়েরও রূপান্তর ঘটায় সেটা অবসরের অভাবে আজও লিখে উঠতে পারি নি। ‘রূপবান’ যখন মুক্তি পায় বাংলাদেশে তখনও মহিলা সমিতি মঞ্চ বা পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর সংস্কৃতি চর্চার স্থানগুলো গড়ে ওঠে নি। যদি থাকত সালাহউদ্দীনের সিনেমাতেও আমরা নাটকই দেখতাম, যাত্রা দেখতাম না। যা আমরা অবশ্য পরে দেখতে শুরু করি। কিন্তু ‘রূপবান’-এর রাজনৈতিক তাৎপর্য অন্যত্র।

রূপবানে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম ইসলামাবাদের উর্দু সিনেমা এবং কলকাতার বাবুদের আর্ট ফিল্মের বিপরীতে তাদের সংস্কৃতিকে সেলুলয়েডে দেখল। এটা ছিল তাদের জন্য চরম উত্তেজনার মূহূর্ত। সালাহউদ্দীন বাজার মাত করে দিয়ে গেলেন। অভিজাত ও শহুরে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর রুচি, চিন্তা ও আভিজাত্যের বিপরীতে ভিন্ন রুচির জনগন আছে ‘রূপবান’ সেটা প্রমাণ করে গেল। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাভাষী অতি সাধারণ বিপুল জনগণের অস্তিত্ব আছে সেটাও ‘রূপবান’ জেলায় জেলায় সিনেমা হলেগুলোতে দেখিয়ে দিয়ে গেল। বাকিটা ইতিহাস। এরাই ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে দেখাল তারা কারা। কিন্তু এই শ্রেণী তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করতে পারে নি। তাদের পক্ষে কথা বলার লোক নাই বললেই চলে। ফলে রাজনৈতিক ভাবেও তারা পরাজিত হয়ে আছে।

দল বেঁধে স্বঘোষিত শিল্পকলার রসিক বা অভিজাত শ্রেণির আকাশচুম্বি বোদ্ধাগণ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ মুক্তি পাবার পর সিনেমাটিকে নিম্ন রুচির জন্য গালিগালাজ করছিল। তখন আমাকে কলম ধরতে হয়েছিল। আমি তখন প্রথম আবিষ্কার করলাম বাংলাদেশের দীন হীন দরিদ্র মানুষ সৌন্দর্য বলতে মোটাসোটা মেয়ে বোঝে। তাদের সৌন্দর্য বোধ দারুন। পাশ্চাত্য সিনেমা স্কিনি গার্লকে সৌন্দর্যের স্টান্ডার্ড হিশাবে যেভাবে হাজির করে এটা তার একদমই বিপরীত ব্যাপার। অঞ্জু ঘোষ তাদের প্রিয় নায়িকা। আমি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’য় আরও অনেক কথা লিখলাম। এই লেখাটি অনেকেরই পছন্দ। আমারও ভাল লাগে কারন আমি সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে পারি। এমনকি একা হয়ে যাবার সাহস আমার আছে।

আমি আসলে আর্ট ফিল্ম বিরোধী লোক। কিন্তু আমরা যা তৈয়ার করতে চাই সেই বাসনার জায়গা নিয়া ভাবা, কিম্বা যা তৈয়ার হয়ে সামনে হাজির হয়ে যায় তাকে চিন্তার বিষয় বানিয়ে চিন্তা করা তো দরকার। তাই না?

কোন কিছু তৈয়ারির আগেও তত্ত্ব থাকে; বানাবার পরেও নতুন তত্ত্ব তৈয়ার হয়। যে উসিলাতেই হোক চিন্তার অনুপ্রাণনা, জবব্জবা কিম্বা হাত পা ছোঁড়াছুড়ি সবসময়ই ভাল। আর্টফিল্ম যারা ভালবাসেন বা আর্টফিল্ম যারা করতে চান তারা নিজেরা কেন কোন ভাল ছবি বানাইতে পারেন নাই — এই সমালোচনা আমি করি না। সিনেমা নিয়া নতুন চিন্তা তা যতোই ছোটখাট কিম্বা ছড়ানো ছিটানো হোক, হতে থাকুক। ক্ষতি কি? আপত্তি তখনই হয় যখন আর্টফিল্মকেই মূল্য নির্ণায়ক একমাত্র মানদণ্ড বানিয়ে ফেলা হয়। তখন।

আর্ট ফিল্ম থাকুক, কিন্তু আমার আগ্রহ সাধারণ মানুষের সিনেমায়। যে সিনেমা সাধারন মানুষ পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে দেখে। একসময় মনে হোল ‘সাধার মানুষের সিনেমা’ বলতে কি বুঝি সেটা ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। তাই লিখেছি, ‘সাধারণ মানুষের সিনেমা’।

তবে প্রথম ড্রাফটা বন্ধু কবি অতনু সিংহ দাবড়িয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন, এখন বন্ধু মানস চৌধুরীর তাগিদে আরো বিস্তৃত করেছি। তাঁদের দুজনকে সালাম।

‘সাধারন মানুষের সিনেমা দুটো সিনেমা নিয়ে আলাপ” ‘র‍্যাম্বো’ এবং ‘আম্মাজান’। একটু ‘আঁতলামি’ করবার জন্য ফরাসি দার্শনিক বাদিয়ুর সিনেমা তত্ত্ব সমালোচনা করেছি।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ও ‘সাধারন মানুষের সিনেমা’ এই দুইয়ে মিলে ম্যাজিক লন্ঠন ‘সিনেমাপাঠ’ নামে ছাপছে। তাঁদের তারিফ করি।”


মন্তব্য করুন