একদল বিবেক-বুদ্ধিওয়ালা ডাকাত!
ডাকাতিয়া বাঁশি (২০২১-চলমান); ধরন: শর্টফিল্ম সিরিজ; পরিচালনা: ভিকি জাহেদ (লাল কাতান নীল ডাকাত), সুমন আনোয়ার (জোয়ার ভাটা), গৌতম কৈরী (বাঘের বাচ্চা), শরাফ আহমেদ জীবন (বকুল ফুল); অভিনয়: ফজলুর রহমান বাবু, শ্যামল মাওলা, খায়রুল বাসার, মোশাররফ করিম, মনোজ প্রামাণিক, ফারহানা আত্তি, শহীদুজ্জামান সেলিম, তাসনুভা তিশা, নাসির উদ্দিন খান, এ কে আজাদ সেতু, দীপক সুমন প্রমুখ। প্ল্যাটফর্ম: চরকি
‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ হলো এ বছর প্রিমিয়ার হওয়া এক ভিন্নরকমের প্রচেষ্টা। ডাকাতদের মানবিক দিক দেখানো বলা যায় এই সিরিজের সবকয়টি গল্পের কমন পয়েন্ট। এ রকম এক লাইনে গল্পের বেসিক বুঝতে গেলে হয়তো এই সিরিজটি একটু ক্লিশে ঘরানার মনে হতে পারে। তবে ভিন্ন ভিন্ন পরিচালক তাদের নিজস্ব ঢঙ্গে, নিজস্ব ভঙ্গিমায় একেক রকমের ডাকাতের গল্প বলায়, সিরিজটি দিনকে দিন বেশ আগ্রহদ্দীপক হয়ে উঠছে।
গত ৫ মাসে এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত মোট ৪টি শর্টফিল্ম চরকিতে রিলিজ হয়েছে। সেই ছবিগুলো নিয়েই টুকটাক আলোচনা।
লাল কাতান নীল ডাকাত; সাসপেন্স থ্রিলার; মুক্তি: ১২ আগস্ট
চরকি যেদিন প্রথম লঞ্চ হয়, সেদিন ‘মরীচিকা’ ও ‘ঊনলৌকিক’-এর পাশাপাশি এই ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের শর্টফিল্মটি রিলিজ হয়। বর্তমান জেনারেশনে যারা থ্রিলারপ্রেমী রয়েছেন, তাদের কাছে ভিকি জাহেদ পছন্দের পরিচালক। এখানে ফজলুর রহমান বাবুকে ডাকাত চরিত্রে দেখা যায়।
গল্পটির উপস্থাপনা বেশ স্বাভাবিক ও সাবলীল। সাসপেন্স ও থ্রিলের পাশাপাশি গল্পে থাকা ছোট ছোট ইমোশনাল মুহূর্তগুলো বেশ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। তবে প্রধান চরিত্রের ফজলুর রহমান বাবুর পারফরম্যান্স ততটা যুতসই মনে হয়নি। তিনি যে জাত অভিনেতা সে তো আর এই সময়ের এসে আর আলাদা করে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। তবে এই চরিত্রে তিনি তেমন বিশেষ কিছু যোগ করতে পারেননি, মাঝেমধ্যে তার অভিনয়ের গ্রাফ অনেকখানি ওভার দ্য টপ মনে হচ্ছিল।
গল্পের অন্য দুটি মুখ্য চরিত্রে থাকা মনোজ প্রামাণিক ও নাসির উদ্দিন খানের পারফরম্যান্স ঠিকঠাক। সব মিলিয়ে ভিকি জাহেদের থ্রিলারগুলো কেমন হয়, সে সম্পর্কে পূর্বধারণা থাকলে— কাজটি আপনার কাছে সাদামাটা থ্রিলার মনে হতে পারে।
রেটিং: ৬/১০
জোয়ার ভাটা; সাসপেন্স ড্রামা; পরিচালনা: সুমন আনোয়ার; মুক্তি: ২৬ আগস্ট ২০২১
২০২০ সালে বিঞ্জ ‘আগস্ট ১৪’ সিরিজের পাশাপাশি আরও একটি সিরিজ বেশ বড়সড় হাইপ তুলেছিল, যদিও কাজটি তত ভালো লাগেনি। সেটি হলো ‘সদরঘাটের টাইগার’। সেই সিরিজের পরিচালক-অভিনেতা-অভিনেত্রী ত্রয়ী প্রায় ১ বছর পর একত্রিত হলেন এই শর্টফিল্মে।
সিরিজের অন্য শর্টফিল্মের তুলনায় এটির দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম (১৯ মিনিট)। অভিনয় এই ছবির শক্তির জায়গা। শ্যামল মাওলা ও ফারহানা আত্তি, দুজনেই যেন চোখ দিয়ে অভিনয় করেন। বিশেষ করে ফারহানার পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ! তার কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি বেশিদিন হয়নি। অন্যদিকে শ্যামল মাওলা এখানে খুবই সাবলীল।
নেগেটিভ দিক যদি বলি, গল্পের মাঝামাঝিতে মেকিং-এ কিছু সমস্যা আছে। ওখানকার কিছু সিকোয়েন্স আরও বিস্তারিত দেখানোর প্রয়োজন ছিল। কেমন যেন এক লাফ-দুই লাফ দিয়ে শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে গেল, যারা দেখেছেন তারা আশা করি বুঝতে পারছেন কোন অংশটুকুর কথা বলছি। আর শেষের টুইস্টটি প্রেডিক্টেবল মনে হয়েছে। শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল এমন কিছু প্রকাশ হবে।
রেটিং: ৭/১০
বাঘের বাচ্চা; ব্ল্যাক কমেডি থ্রিলার; পরিচালনা: গৌতম কৈরী; মুক্তি: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
গৌতম কৈরী গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ভালো থ্রিলার নাটক উপহার দিয়েছেন। অল্পকয়েকটি কাজ দেখার সুবাদে তার নির্মাণ নিয়ে কিছুটা অবগত ছিলাম। তবে ব্ল্যাক কমেডি ঘরানার কাজ তিনি এর আগে করেছেন কিনা, আমার জানা নেই।
এখানে খায়রুল বাসারসহ একদল বাঘের মুখোশ পড়া ডাকাত দেখতে পাওয়া যায়, জনমানুষের কাছে যারা ‘বাঘের বাচ্চা’। তারা সাধারণত যারা গরিবের ত্রাণ লুট করে, তাদের ঘরে গিয়ে ডাকাতি করে, এরপর সেগুলো আবার গরিবদের কাছে পাঠায়। অনেকটা রবিনহুডের মতো। তবে এবার একটা বড় মিশনে গিয়ে তাদের বেশ বেগ পোহাতে হয়।
২৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের শর্টফিল্মটি দেখে ভালোই হেসেছি। স্ক্রিনে সিরিয়াস কাজকর্ম চলছে, কিন্তু দর্শকের দেখে বিষয়গুলো ফাজলামো মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক কমেডি বিষয়টি অনেকটা এমন। শুরুর দিকে চিত্রনাট্য লন-লিনিয়ারভাবে সাজানো হয়েছে। আর শেষের দিকে কিছু ছোটখাটো টুইস্ট রয়েছে, যেগুলো পরপর যখন আসে তখন বেশ চমকে গিয়েছিলাম। খায়রুল বাসার, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ বাকি অভিনেতাদের পারফরম্যান্স আমার কাছে ভালো লেগেছে। কিছু ছোটখাটো দিক ছাড়া আহামরি কোনো দুর্বলতা ছিল না।
রেটিং: ৮.৫/১০
বকুল ফুল; ড্রামা; পরিচালনা: শরাফ আহমেদ জীবন; মুক্তিঃ ২ ডিসেম্বর ২০২১
ছবিয়ালের অন্যতম সদস্য শরাফ আহমেদ জীবন বর্তমান প্রজন্মের কাছে অভিনেতা হিসেবে বেশি পরিচিত। তার পরিচালিত সেরকম কোনো কাজ দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
৩৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ফিল্মে থ্রিল কম, ড্রামাকে বেশি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গল্পের প্রথমাংশ বেশ আগ্রহদ্দীপক। গল্প, নির্মাণ, পরিস্থিতি, চরিত্র সবকিছুই বিশ্বাসযোগ্য। মনে হচ্ছিল প্রডাকশন ভ্যালুর দিক থেকেও অন্য তিনটি ছবির তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে।
কিন্তু পরের অংশে গিয়ে হুট করেই কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলে। যে বিষয়গুলো শুরুর ২০ মিনিটে ভালো লাগছিল, পরের ১৬ মিনিটে সেগুলোই কেমন যেন দুর্বল। গল্পের গতি কমে যায়, শেষের দিকটা কিছুটা ওভার দ্য টপ ও ক্লিশে। তাসনুভা তিশার অভিনয় বেশ কিছু জায়গায় ক্লিশে লেগেছে, যদিও তিনি দক্ষ অভিনেত্রী।
আর ডাকাতরূপে মোশাররফ করিম যেরকম ক্লিন শেভের লুক নিয়েছেন, এটা চরিত্রের সাথে মানানসই মনে হয়নি। ওনাকে এর আগেও ‘হালদা’য় ক্লিন শেভ জেলের চরিত্রে দেখেছিলাম। এটা ঠিক যে, ডাকাতদের ক্লিন শেভ লুক থাকতেই পারে। খোঁচা খোঁচা গোফ-দাড়ি থাকতে হবে, সেরকম ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে এই ছোট ছোট দুর্বলতাগুলো চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে ফেলে। মোশাররফ করিম খুবই ব্যস্ত অভিনেতা। সারাবছর শর্টফিল্ম থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, নাটক, টেলিফিল্ম, ওয়েবফিল্ম, সিরিজ, চলচ্চিত্র সবকিছুতে সমানতালে অভিনয় করেন। তবে এই ধরনের গ্রাম্য ঘরানার চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে তার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত।
রেটিং: ৫/১০
নতুন ও অভিজ্ঞ পরিচালক-অভিনয়শিল্পীদের সমন্বয়ে সিরিজটি আরও সমৃদ্ধ হোক। শুভ কামনা রইলো।