এক্সট্র্যাকশন আলোচনায় ‘মিশন এক্সট্রিম’ টিজারের সমালোচনার জবাব সানি সানোয়ারের
শুক্রবার থেকে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনায় রয়েছে নেটফ্লিক্সের ‘এক্সট্র্যাকশন’ সিনেমাটি। যার বেশির ভাগ রিভিউই নেতিবাচক। সে আলোচনায় শামিল হলেন ‘মিশন এক্সট্রিম‘ নির্মাতা সানি সানোয়ার। সঙ্গে যোগ করলেন তার সিনেমার টিজার নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার জবাব।
দীর্ঘ স্ট্যাটাসে সানি লেখেন-
“#এক্সট্রাকশন সিনেমা নিয়ে সবাই যখন সরব, তখন আমি যদি দুই-চার লাইন না লিখি তাহলে তো আবার ইজ্জত থাকে না। তাই লিখলাম।
আলোচ্য সিনেমায় এদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ইউনিফর্মের কাল্পনিকচিত্রটি শুধু ভুল বললে কম হবে, এগুলো অনেকের হাস্যরসের খোরাকও জুগিয়েছে। আর এই একটি পয়েন্টে লড়াই করার জন্যই একজন ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে পুলিশের চাকুরি করার পরও আমি সিনেমা নির্মাণ করতে এসেছিলাম। আমি চাই আমাদের কথা আমরা নিজেরাই বলবো। আর, যা বলবো তা বাস্তবতার আলোকেই বলব। এই আর্মি-পুলিশকে যে এদেশের নির্মাতারাও খুব নিঁখুত এবং সম্মানজনকভাবে সিনেমায় ফূটিয়ে তুলেতে পেরেছে তাও কিন্তু নয়। অথচ, তারাও দেখছি দু’দিন ধরে ‘এক্সট্রাকশন’কে ধূয়ে মুছে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিচ্ছে।
কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি,
(১)
একদিন এক স্বনামধন্য সিনেমা ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– ভাই, সিনেমা বানানোর আগে আপনারা প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষোণা করেন না?
– করি, করবো না কেন?
-তাহলে, ঢাকার রমনা থানার সাব-ইন্সপেক্টরের গায়ে রাজশাহী রেঞ্জের ড্রেস পড়ান কেন?
-তাই, নাকি? এরকম কে করলো?
– হ্যা, শুধু তাই না। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে চাকুরী পেয়ে তাকে ইন্সপেক্টরের র্যাংক পড়িয়ে পোস্টিং দেন কিশোরগঞ্জের কোন এক থানায়। এটা কেন, ভাই?
তিনি হাসলেন, কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর বললেল,
– দেখুন, পরিচালকের কোন ভুল নাই। সে যা দেখাবে তাই ঠিক। সেটাই শিল্প।
– তাহলে আমি এসব কি বানাচ্ছি! আমার সিনেমা তো শিল্পের কাতারে পড়বে না। কারণ, আমি রিয়্যালিটির বাইরে কম যাবার চেষ্টা করি।
– আপনি যেটা বানাবেন সেটাও শিল্প, কারণ আপনিও তো একজন পরিচালক। আপনার স্বাধীনতা আছে আপনার মত করে বানানোর। আসলে কারোটাই ভুল নয়।
আমি তার জাদুকরী উত্তরে কুপোকাত হয়ে গেলাম।
(২)
নিজের বানানো সিনেমা মুক্তি পাবার কিছুদিন আগে একজন নির্মাতা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন – “আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান রুগ্ন অবস্থা থেকে একে বাঁচানোর জন্য কোন দেশীয় সিনেমা মুক্তি পাবার পর সবার অন্তত দুই মাস যে কোন ধরণের নেগেটিভ রিভিউ দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ।”
কিন্তু দুঃখের বিষয়,
এ বছর আমাদের ‘মিশন এক্সট্রিম’ সিনেমার প্রথম টিজার রিলিজের পরদিনই তিনি এমন একখান রিভিউ মেরে দিলেন যেন এটা কোন সিনেমাই হয়নি। সিনেমা মুক্তি তো দূরের কথা তারও ম্যালাদিন আগে সিনেমার টিজারটাকেই তিনি গলা চেপে হত্যা করলেন।
এই হচ্ছে আমাদের শিল্প, এই হচ্ছে আমাদের কমিটমেন্ট আর এই হচ্ছে আমাদের উন্নতির নমুনা!
আসলে আমরা সবাই কিসের মধ্যে আছি নিজেরাও জানি না। আত্মপ্রেম, অন্ধত্ব, আত্মতুষ্টি, সীমাহীন আত্মকেন্দ্রিকতা – এসব কিছুর আবরণ মেখেই নিজেরাই নিজেদেরকে থার্ড-ওয়ার্ল্ডে বিসর্জন দিয়ে বসে আছি। সেখানে ‘এক্সট্রাকশন’ওয়ালাদের দোষ দিয়ে কি লাভ! আমরা শুধু এতটুকু বুঝি নিজেকেই শ্রেষ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে, আর বাকি সব শাকপাতা, থানকুনি পাতা অথবা ধুতরা পাতা।
দেশীয় মিডিয়ার এই দুর্বলতার ফাঁক দিয়ে গতকাল সবার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে ‘এক্সট্রাকশন’ নামের ‘নেটফ্লিক্স সিনেমা’। এর ৯০% স্যুট বা কাহিনী ঢাকা’কে কেন্দ্র করে হলেও এখানে নেই কোন দেশীয় শিল্পী, নেই কোন লোকাল এজেন্ট, নেই এদেশের সংস্কৃতি। যদিও একজন জড়িত ছিল তবে তার স্বীয় দায়িত্বে থেকে একার পক্ষে আর কতটুকুই বা করার ছিল। যদি এদেশের একটা শক্ত প্রতিষ্ঠান কিংবা বড় মাপের সিনেমাবোদ্ধারা এই প্রজেক্টেড় বড় কোন পদে নিযুক্ত থাকতো, তাহলে হয়তো আমাদের তুষ্ট থাকার জায়গাটা আর অনেকখানি প্রশস্ত হতো।
যাহোক, অনেকেই হয়তো বলবে যে, এই প্রজেক্টের সব কিছুই পরিকল্পিত ছিল। সে হিসেবেই তারা বানিয়েছে। কিন্তু আমি বলব ‘ভুল কখনো পরিকল্পিত হতে পারে না। দুর্বল অভিনয় কখনও পরিকল্পিত হতে পারে না। ভুল স্ক্রিপ্ট কখনো পরিকল্পিত হতে পারে না। এটি নেটফ্লিক্সের একটা বড় ভুল তা একদিন আগে বা পড়ে তারা স্বীকার করবেই। কারণ, টার্গেট অডিয়েন্সকে তুষ্ট করতে তারা বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশকে এতটা হীনভাবে দেখিয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছে। কিন্তু সেই টার্গেট অডিয়েন্স এই সিনেমার নেগেটিভ রিভিউ দিতে শুরু করেছে। এখন থলের বিড়াল কোথায় যাবে!
আসলে, হলিউড তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের শক্তি দিয়ে রাশিয়া আর মুসলমানদের যেমন ইচ্ছামত ভিলেন বানিয়ে ব্যবসা এবং রাজনীতি দু’টাই করছে, তেমনি বলিউড পাকিস্তানের উপর ভর করে। আর, আমাদের উপর তামাম দুনিয়া শূল বসালেও তার জবাব দেয়ার ন্যুনতম যোগ্যতা আমরা রাখি না।
৪ কোটি ফেসবুক একাউন্ট থাকার পরও এদেশে ফেসবুক অফিস স্থাপন করেনি, এদেশের পুলিশকে অপরাধের তথ্য দিতে চায়নি। কিন্তু পুলিশ তার সর্বোচ্চ চেষ্টায় তা আদায় করে নিয়েছে। এখন ফেসবুক আর বাংলাদেশ পুলিশ এক কাতারে কাজ করছে। শুধু তাই নয় যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই, যুক্তরাজ্যের নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডসহ বিশ্বের সব বড় বড় সংস্থার সাথে এদেশের পুলিশ এক সাথে কাজ করছে উগ্রবাদ নির্মূলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে যে পেশায় জড়িত সে সে পেশার মানোন্নয় ঘটিয়ে কেন বিশ্বে সব বস-দের সাথে যুক্ত হতে পারছে না? সেটা পারলে হয়তো ‘এক্সট্রাকশন’ মুভিটা কিছুটা হলেও অন্যরকম হতো। এটা আমার ধারণা।
যাহোক, ৫৫২ কোটি টাকা খরচ করে হয়তো আমরা এরকম মুভি বানাতে পারবো না, কিন্তু যেটা বানাবো সেটার শিল্পগুণ হওয়া উচিৎ বিশ্বমানের। আর সেটা দিয়েই এদেশকে ছোট করার শক্ত জবাব দেয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা করতে হলে নিজেদের মধ্যে একতা, কাজের মানোন্নয় এবং সর্বোপরি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। তা না হলে এরকম হাজারো বিদেশী নির্মাতা এসে পুরো দেশটাই এক্সাট্রাক্ট করে নিয়ে যাবে।”
সানির এমন আলোচনায় অনেকেই স্মরণ নিচ্ছেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’ পরিচালক দীপঙ্কর দীপনের রিভিউর- যদিও নির্মাতার নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
মার্চে প্রথম আলোকে দীপন বলেছিলেন-
‘আরেকটু ভালো হতে পারত’, দীপনের প্রথম প্রতিক্রিয়া এ রকম। তারপর তিনি ভেঙে বললেন, ‘আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। টিজারে কিছু পাঞ্চ লাগে। কোনো একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে হয়। অজানা কোনো কিছুকে জানার ব্যাপার থাকে। কোনো একটা অমীমাংসিত কিছু থাকতে হয়। আগ্রহের জায়গাকে উসকে দিতে হয়। একটা কিছু জাগিয়ে তুলতে হয়। সে রকম কি টিজারে পাওয়া গেল?’ দীপনের কণ্ঠে আফসোসের সুর।
তারপর দীপন প্রশ্ন করেন, ‘টিজার কি এত বড় হওয়া উচিত? টিজার ৩০ থেকে ১ মিনিটের মধ্যে হওয়া উচিত। ট্রেলার হওয়া উচিত আড়াই মিনিটের মধ্যে। টিজারের দৈর্ঘ্য আর ট্রেলারের দৈর্ঘ্যের মাঝামাঝি একটা দৈর্ঘ্য আমরা দেখলাম। এটাকে আমার টিজার নয়, ট্রেলারই মনে হয়েছে।’
দীপন পরামর্শ দিলেন, ‘টিজার কোনোভাবেই এক মিনিটের ওপরে হওয়া উচিত নয়।’‘ঢাকা অ্যাটাক’–এর টিজার তৈরির সময় কোন বিষয়টা মাথায় রেখে কাজ করেছিলেন, জানতে চাইলে দীপন বলেন, ‘আমরা একটা পাঞ্চলাইন নিয়ে কাজ করেছিলাম—লাশের পকেটে হাসি। একটা হাসির ইমো দিয়ে দর্শকদের প্রশ্নের ভেতর ফেলতে চেয়েছিলাম। টিজার যত বেশি প্রশ্ন তৈরি করবে, তত বেশি ভালো। ট্রেলার এক ধরনের উত্তর দেবে। পূর্ণাঙ্গ উত্তর পাওয়া যাবে না। তার জন্য সিনেমা হলে যেতে হবে।’