‘এর বেশী ভালোবাসা যায় না’ সুস্থ বিনোদন
জাকির হোসেন রাজুর পোড়ামন ছবিটিতেই সায়মন সাদিককে প্রথম দেখেছিলাম। ছবিটি নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে গল্পে এবং নির্মাণে নতুনত্ব আনতে পেরেছিলেন পরিচালক। মূলত: জাকির হোসেন রাজু, সায়মন সাদিক আর আকর্ষনীয় পোস্টারের জন্যই “এর বেশী ভালোবাসা যায়না” ছবিটি দেখতে যাওয়া।
রাজুর ছবি নির্মানের একটা নিজস্ব ধরণ রয়েছে, অন্তত তার দুটো ছবি দেখে তাই মনে হয়। তিনি একটি সরলরৈখিক গল্পকে কিছু ফ্ল্যাশব্যাক আর ফ্ল্যাশফরওয়ার্ডসহ অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে ঘটনাবহুল করে তুলেন অর্থাৎ একটি গল্পের মধ্যে ছোট ছোট অনেক গল্প, ছোট ছোট অনেকগুলো টুইস্ট থাকে, দর্শক ভাবে গল্প বোধ হয় একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে কিন্তু তখনই আরেকটা ঘটনার সৃষ্টি হয়। ছবির গল্পে এই ঘটনাগুলোর সৃষ্টি হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিংবা অনেকে বিভিন্ন ঘটনাগুলোর সাথে বিভিন্ন ছবির সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তবে এই ছবি দেখে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত- একটা গল্পকে একটা সিনেমা হয়ে উঠতে গেলে বিশেষ করে বাণিজ্যিক সিনেমা হয়ে উঠতে গেলে এই ছোট ছোট ঘটনা বা টুইস্ট বা হাস্যরস বা প্রেমের আবেগ সৃষ্টির জন্য করা দৃশ্যগুলোর প্রয়োজন আছে। অনেক বেশী প্রয়োজন আছে।
এবার গল্পের প্রসঙ্গে আসি, অটোমোবাইল মেকানিকের ছেলে রবি (সায়মন) মূলত বাপের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো রকম চরিত্র। সে বেকার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকে। যথারীতি বন্ধুদের চরিত্রগুলোকে নিয়ে ছবিতে বিভিন্ন কমেডি সিকোয়েন্স করা হয়েছে। হাস্যরসের দৃশ্যগুলো ভালো খুব একটা ভাঁড়ামো মনে হয়নি। তবে একজন গাড়ীর মেকানিকের বাড়ি এতোটা বিলাসবহুল হতে পারে- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিরণ (নিঝুম) নতুন এসেছে রবির এলাকায়। কিরণ থাকে তার এক বান্ধবীর সাথে- যদিও বান্ধবী কিরণকে কখনও তুই কখনও তুমি এমনকি আপু বলেও সম্বোধন করে। তাই সম্পর্কে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। প্রথম দেখাতেই কিরনের প্রেমে পড়ে যায় রবি। এরপর বিভিন্ন ঘটনা, কমেডি, গুণ্ডাদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা আর গান। অতঃপর রবিকে কিরন প্রত্যাখান করে এবং জানিয়ে দেয় যে তার ছোটবেলার বন্ধু হৃদয়কে সে ভালোবাসে এবং হৃদয়ের ফিরে আসার পথ চেয়ে আছে সে।
কিরণ আরও জানায় সৎ মায়ের অত্যাচারে পালিয়ে রবিদের এলাকায় এসে থাকছে। তার সৎ মা এবং মামা চায় যে সে তাদের পছন্দমত এমন ছেলেকে বিয়ে করুক যে তাদের কথায় উঠবে বসবে এবং কিরনের নামে রেখে যাওয়া বাবার বিশাল সম্পত্তির পুরোটাই সৎ মা এবং মামা ভোগ করবে। এই ঘটনা শোনার পর রবি কিরনকে জানিয়ে দেয় সে আর বিরক্ত করবেনা। কিন্তু তবুও রবি তার মনকে রাজি করাতে পারেনা। সে কিরনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে এবং কিরণের প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে। এটা টের পেয়ে কিরন রবির সাথে খারাপ আচরন করে এবং বলে দেয় সে কোনদিনও তার ভালোবাসা পাবেনা কারণ সে হৃদয়কে ভালোবাসে। অপমানিত হওয়ার পর রবি সিদ্ধান্ত নেয় যে সে সব কিছু ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কর্মমুখী হবে।অন্যদিকে কিরনের কাছে হৃদয়ের চিঠি নিয়ে আসে কিরনের বাড়ির পুরনো ভৃত্য ইমন চাচা চিঠিতে হৃদয় কিরন কে ঢাকায় তার বাড়িতে আসার জন্য বলে।
ঘটনাক্রমে একই ট্রেনে একই সময়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কিরন এবং রবি, দেখা হয়ে যায় তাদের,তারপর এই শেরপুর থেকে ঢাকা যাত্রাতে বিভিন্ন ঘটনা, স্যাক্রিফাইজ, কম্প্রোমাইজ, আবেগ ইত্যাদি থেকে রবির প্রতি কিরনের ভালোবাসা জন্ম নেয়। ট্রেনের মধ্যে অনেক দৃশ্যের অসামন্জস্যতা রয়েছে। অনেকে এই ট্রেন যাত্রা কিংবা শেরপুর থেকে ঢাকা যাত্রার সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে নায়ক নায়িকার প্রেমের প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে হিন্দি Jab we met কিংবা তেলেগু Ishq বা Paiyaa ছবির সাথে মিল খুজে পেতে পারেন কিন্তু সেটা ঐ নায়কের প্রতি নায়িকার ভালোবাসার অনুভূতি জন্ম নেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এর বেশী নয়। অবশ্য তেলেগু ছবি দুটোতে ট্রেন যাত্রা নেই, রয়েছে ট্যাক্সি এবং বিমান যাত্রা। হিন্দি কিংবা তেলেগু ছবিগুলোর সাথে এই বাংলা ছবিটিকে গুলিয়ে ফেলার কোন কারন নেই সবগুলো ছবির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন ভিন্ন ভিন্ন।
চিত্রগ্রহন ভালো তবে এর আগের ছবি পোড়ামনে আরো ভালো ছিল। গোটা সিনেমাটিতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে close up শট ব্যবহার করা হয়েছে তাই অনেকের কাছে একটু টেলিফিল্ম টেলিফিল্ম মনে হতে পারে, তবে ভরপুর নায়কোচিত মারামারির দৃশ্য দেখে আবার মনে হবে – নাহ সিনেমাই দেখছি। সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইফেক্ট যেমন মারামারির দৃশ্য বা হাসির দৃশ্যে স্লো বা স্পিডি মোশন কিংবা জুম ইন জুম আউট ইত্যাদির ব্যবহার পরিমিত এবং যথোপযুক্ত। গান এবং গানের দৃশ্যায়ন যথারীতি ভালো। এই ব্যপারে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে সন্দেহাতীত ভাবে। রাজুর আগের ছবিটির মত নায়ক নায়িকার অর্থনৈতিক অবস্থা সাপেক্ষে পোশাকের কিংবা ভাষার অসামন্জস্যতা এই ছবিতে ছিলনা। সায়মন সাদিক ভালো করেছেন। তবে তিনি উত্তেজনার বা রাগের সংলাপ কিংবা খুব বেশী আবেগঘন সংলাপ ডেলিভারিতে অপারঙ্গম, এই বিষয়ে তার উন্নতির প্রয়োজন। নায়িকা নিঝুমকে নিয়ে আমি কিছুটা হতাশ। সৌন্দর্য্যের কমতি না থাকলেও অভিনয়ে তিনি অপটু। সিনেমার গানে কিংবা অন্য দৃশ্যে নায়িকাসুলভ অভিব্যক্তি প্রকাশেও তিনি দূর্বল। তার অভিনয় দক্ষতা বাড়াবার অনেক সুযোগ রয়েছে।তবুও অনেক ভালো যে আমাদের একসময়ের নায়িকাদের মত ইমোশনাল দৃশ্যে তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে জোরে জোরে ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস নেননি। আমি আশাবাদি নিঝুম কে নিয়ে। শব্দ ধারণ, সংযোজন এবং আবহ সঙ্গীত অসাধারণ।
আমি জানিনা এখনও পর্যন্ত ছবিটির মৌলিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেছে কিনা। আমিও সেরকমটি পাইনি, তবে সিনেমাটির বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনাগুলোর সাথে বিক্ষিপ্ত ভাবে অনেকে ভিন্ন ভিন্ন সিনেমার, বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার অনেক সাদৃশ্য পেতে পারেন কিংবা অনেকে জোর করে টেনেটুনে মিল খুঁজে বের করতে পারেন। তবে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয় এবং মুল চিত্রনাট্যেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনা। আমার কাছে মনে হয়েছে “এর বেশী ভালোবাসা যায় না” ছবিটি একটি পুরোদস্তুর প্রেমের সিনেমা যাতে প্রেম আছে, হাসি আছে, আবেগ আছে, গান আছে, ঘাত প্রতিঘাত আছে এবং অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য সুস্থ বিনোদন আছে। তবুও জাকির হোসেন রাজুর কাছে প্রত্যাশা “এর বেশী কি আশা করা যায়না?” অবশ্যই যায় এবং আমরা আশা করিও, পরবর্তীতে তিনি আরও ভালো সিনেমা আমাদের উপহার দিবেন। জাকির হোসেন রাজু আপনাকে সাধুবাদ।
সুন্দর রিভিউ। তবে একটা কথা নিঝুম প্রথম মুভি হিসেবে যে অভিনয় করেছে তা প্রশংশা পাওয়ার মত। একটা বিষয় লক্ষ করেছি নিঝুম কে বাঙ্গালী পোশাক এর চেয়ে ওয়েস্টান পুশাকে ভালো লাগে। সায়মন বরাবরের মত ভালো অভিনয় করেছে। এই প্রথম একজন নায়ক দেখলাম যার তিন সিনেমায় তিন জন নায়িকা হয়েছে (সারা জেরিন, মাহী, নিঝুম) এবং তিন সিনেমার গল্প তিন ধরনের (জী হুজুর, পোড়ামন, এর বেশী ভালোবাসা যায় না)। আর জাকির হোসেন রাজু সম্পর্কে কিছু বলার তিনি সব সময়ই ভাল করেন। এতো বছরের ফিল্ম ক্যারিয়ারে মাত্র ১৪ টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। অথচ চাইলে বছরে ৫ টা সিনেমায় কাজ করতে পারেন। তিনি সব সময় মানে বিশ্বাসী।
জাকির হোসেন রাজুর কাছে “এত বেশি জোড়াতালি আশা করা যায় না”।
ছবি দেখে মনে হয়েছে “এর বেশি জোড়াতালি দেয়া যায় না।”
আপনি অনেক সুন্দর করে পজেটিভ দিকগুলো তুলে ধরছেন কিন্তু এটাও বলেছেন যে পোরামন এর আগের ছবিগুলো দেখেন নি। তাই হয়তো এর বেশি প্রত্যাশাও ছিল না।
এত অসমাঞ্জস্যতা এর আগে তার ছবিতে চোখে পড়ে নি।
এ ছবিটি এত বেশি অসামঞ্জস্যতায় ভরা যে সেগুলো বলতেই ইচ্ছে করেনা। এত বড় বড় ভূল কি করে হয়। দোলা নামের মেয়েটে কিরনকে আপু আপু ডেকে সারা সারা করল শেষে গিয়ে ডাকছে নাম ধরে।
আর বাংলাদেশের রেলওয়ের ট্রেনগুলোতে যে রাজু ভাই থার্ড ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাসের পার্থক্য বোঝেন সেটা নি:স্বাসে তুমি বি:শ্বাসে তুমি ছবিতে দেখিয়েছেন।
তবে কি রাজু ভাইও চুক্তিভিত্তিতে কাজ করা শুরু করেছেন?
জোর করে হিন্দী ছবির সাথে মিল খোজার আসলে প্রয়োজন হয়নি। সীন নিজেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সেই সব দৃশ্যের কথা