Select Page

আনোয়ার হোসেনের জন্য শোকগাঁথা

আনোয়ার হোসেনের জন্য শোকগাঁথা

1208780_702879993059381_1089525651_nরাজ্জাক:এইতো সেদিন হাসপাতালে আনু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর আমি তাকে বলছিলাম, ‘আনু ভাই আমাকে চিনতে পারছেন?’ জবাবে আনু ভাই বলেছিলেন কেন চিনতে পারব না।’ তিনি আমাকে চিনতে পেরেছিলেন। আমি অবাক হলাম তিনি আমার কুশলাদি নিলেন। শুনেছি চলচ্চিত্রের খুব কম মানুষই তার মৃত্যুর খবর শুনে তাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিলেন। আমরা সত্যিই দিন দিন কেন যেন নিজের জায়গার প্রতি, নিজের মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছি। এটা সত্যিই খুব অন্যায় হচ্ছে। আনু ভাই চলে গেছেন সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের চলচ্চিত্রে যে অবদান রেখে গেছেন তা কখনোই ভুলবার নয়। অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেছেন তিনি। তার সাথে আমি সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করি। এরপর বহু ছবিতে অভিনয় করেছি। আমার নির্দেশত ‘পাগলা রাজা’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। সব মিলিয়ে তার সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো আত্নিক সম্পর্ক। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন।

ববিতা: আনু ভাই নেই এটা আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। কারণ পনেরো দিন আগে আমি, সুচন্দা আপা এবং চম্পা একসাথে তাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তার শারীরিক অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না যে তাকে এভাবে চলে যেতে হবে। শুনেছিলাম প্রধানমন্ত্রী তার উন্নত চিকিত্সার জন্য দেশের বাইরে পাঠাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হলো না। আশায় ছিলাম, তিনি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যাবেন। আমরা পরিকল্পনাও করছিলাম যে এবার ৬ নভেম্বর তার জন্মদিনটি বেশ ভালোভাবে পালন করব। আনু ভাই ছিলেন সত্যিকার অর্থের মনেপ্রাণে একজন শিল্পী। চলচ্চিত্রে অনেকেই কাজ করেন জীবনের প্রয়োজনে। কিন্তু আনু ভাই অভিনয় করতেন অভিনয়কে ভালোবেসে। যেটা এই সময়ের শিল্পীদের মধ্যে নেই বলা চলে। আমার সৌভাগ্য যে আমি আনু ভাইয়ের নায়িকা হতে পেরেছিলাম।

শবনম: এটা আমার দুর্ভাগ্য যে মাত্র একটি ছবিতে আমি আনোয়ার ভাইয়ের সাথে অভিনয় করেছি। এত গুণী, উদার মনের মানুষের সাথে আমি অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম যেন এটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম অর্জন। খুব কম ছবিতে আমি অভিনয় করেছি। একজন আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের ইতিহাস। যদি কখনও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা হয় তাহলে কোনোভাবেই তার নামকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। একজন আনোয়ার হোসেন আমাদের সবার পথপ্রদর্শক ছিলেন। যগে যুগে জন্মায়না। তার এই চলে যাওয়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা সত্যিই পূরণ হওয়ার নয়। আমি তার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ বেহেশত নসীব করুন।

সুচন্দা :একজন আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের অবসান হলো। তিনি ছিলেন মাস্টার অভিনেতা। বর্তমান প্রজন্ম , আগামী প্রজন্মের জন্য তিনি সবার কাছে যুগের পর যুগ একটি ইনস্টিটিউট হয়ে থাকবেন। নতার আনু ভাই আমার কাছে সবসময়ই ছিলেন একজন অভিভাবকের মতো। তাকে কখনোই আমি, আমরা পরিবারের বাইরের কেউ বলে ভাবিনি কখনও, তিনিও ভাবেননি। তার সাথে খুব বেশি ছবিতে যে অভিনয় করেছি তেমনটি নয়। তবে যে কটি ছবিতে অভিনয় করেছি তারসবগুলোই দর্শকের হূদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে। আনু ভাইয়ের মৃত্যুতে আজ চোখের সামনে কতো যে স্মৃতি ভেসে উঠছে তা বলে বুঝাতে পারব না। একজন পরিচালক হিসেবে হাজার বছর ছবির জন্য আমি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার নিয়েছিলাম আনু ভাইয়ের হাত থেকেই। তার বেহেশত নসিব হোক এই কামনাই করি।

সোহেল রানা: আনু ভাইকে নিয়ে অনেক কথাই বলার আছে। অনেক কিছুই লেখার আছে। খুব বেশি কিছু আজ বলবনা। শুধু এতটুকুই বলব আনু ভাইয়ের মতো একজন উঁচু মাপের অভিনেতার যেভাবে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবে তিনি যেতে পারেন নি। শিল্প, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অনেক অভিমান ও ক্ষোভ তার। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন।

অনন্ত: কিছুদিন আগে তাকে যখন দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম তখন আমার খুব কষ্ট লেগেছে। এমন একজন মহান মানুষের প্রতি চলচ্চিত্রের শিল্পের দৈন্য সত্যিই অবিশ্বাস্য। আনোয়ার হোসেনের মতো মানুষ যুগে যুগে আসে না। নশ্বর এ পৃথিবীতে তাদের আগমন একবারই ঘটে। তার বর্ণাঢ্য চিত্রজীবনের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রইল। আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

শাকিব খান: আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। পেশাদার অভিনেতা। এই পেশায় কাজ করা কতটা কষ্টকর তা আমি জানি। এই কঠিন কাজটিই দিনের পর দিন খুশি মনে করে গেছেন তিনি। অর্জন করেছেন নবাব খ্যাতি। সবার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কিন্তু তার দুঃসময়ে দু’একজন ছাড়া কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। এটা সত্যিই কষ্টকর। এই দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত। তার বিদেহী আÍার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

ফেরদৌস: তিনি ছিলেন বাংলার নবাব। অসম্ভব ভালো একজন মানুষ ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তার সঙ্গে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। খুবই আদর করতেন আমাকে। ব্যস্ততার কারণে অসুস্থ অবস্থায় তাকে দেখতে যেতে পারিনি। আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি, যাকে সঠিক মর্যাদা দিতে পারিনি। আমাদের শিল্পী সমাজের এ বিষয়ে ভাবা উচিত। যারা জীবিত আছেন তাদের মৃত্যুটা যেন কষ্টের না হয়। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

মৌসুমী: একজন অভিভাবক হারালাম। সবাইকে চলে যেতে হবে। তবে কারও কারও কর্ম তাকে আজীবন মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখে। আনোয়ার আঙ্কেল এমন একজন মানুষ। চলচ্চিত্রেই সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন। শেষ সময়ে এসেও প্রিয় এফডিসিকে দেখতে চেয়েছেন। একটা মাধ্যমের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকলে মানুষের মনে এমন আকুতি ফুটে উঠতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তিনি।

অপু বিশ্বাস: আনোয়ার আঙ্কেল নেই এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ছিলেন সবার আদর্শ। তার মতো অভিনেতার জন্ম পৃথিবীতে খুব বেশি হয় না। তার সঙ্গে আমার কাজ করা হয়নি। তবে তার অভিনীত অনেক ছবি দেখেছি। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের গৌরব। একটা মানুষের মধ্যে কতটা ভালোবাসা থাকলে শেষ সময়ে এসেও নিজের পেশার কথা অকপটে বলে যান। এটা সত্যি অবিশ্বাস্য। আমার মনে হয় তার আরও অনেক বেশি মূল্যায়ন পাওয়া উচিত ছিল।

বর্ষা: প্রথম যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে তাকে দেখেছি, তখন মনে হতো একজন মানুষের ভাবনার গতি এতটা প্রবল হয় কিভাবে। আঙ্কেলের ভক্ত ছিলাম আমি। কিছুদিন আগে হাসপাতালে তাকে দেখেও এসেছিলাম। তিনিও মেয়ের মতো কাছে টেনেছিলেন। সবাইকে যেতে হবে একদিন। কিন্তু কিছু কিছু যাওয়া মেনে নেয়া অনেক কষ্টকর। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন তিনি।

উজ্জ্বল: তরুণ বয়সের আনোয়ার হোসেনের কথাই এখন বেশি মনে পড়ছে। নিয়তির জালে আমরা সবাই বাঁধা। সময় হলে একদিন যেতেই হবে। আনোয়ার হোসেন চলে গেছেন তার জন্য যতটুকু কষ্ট হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে জীবদ্দশায় তিনি কী পেয়েছেন? জাতি হিসেবে আমরা আসলে এখনও মহান হতে পারিনি। এ ব্যর্থতা আমার, আমাদের সবার। শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের দোহাই দিয়েছেন অনেকেই। যে মানুষটি দেশের মানুষকে বিনোদন দিতে সদা হাসিমুখেই নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, সে মানুষের জন্য কী সরকারের কিছুই করার ছিল না আগে। বিবেকের দহন কি মুক্তি দেবে কাউকে?

সূত্র: যুগান্তর, দৈনিক ইত্তেফাক


মন্তব্য করুন