Select Page

আগের সেই মমতা-যত্ন কি এখন পাওয়া যাচ্ছে!- সাক্ষাতকারে মোজাহারুল ইসলাম ওবায়েদ

আগের সেই মমতা-যত্ন কি এখন পাওয়া যাচ্ছে!- সাক্ষাতকারে মোজাহারুল ইসলাম ওবায়েদ

Mozaharul Islam Obaid_BM Publicityমোজাহারুল ইসলাম ওবায়েদ। বিএম পাবলিসিটির অন্যতম সত্ত্বাধিকারী। চলচ্চিত্রের  প্রচার প্রসারে বিএম পাবলিসিটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পোস্টার শিল্পের না জানা গল্প শুনতে বিএমডিবি-র পক্ষ থেকে ওবায়েদের মুখোমুখি হয়েছেন নাজমুল হাসান দারাশিকো।  সাক্ষাতকারটি পাঠকদের জন্য নীচে পত্রস্থ করা হলো-

কিভাবে এই চলচ্চিত্র প্রকাশনা ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হলেন?

আমি ফিল্মে এসেছি ১৯৭৭ সালে। সুভাষ দত্তের ‘বসুন্ধরা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আমি প্রবেশ করি। আমি ফিফথ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিলাম, আর চিফ ছিলেন নুরুদ্দিন সাহেব। কাজটা আমার ভালো লাগে নি। ১৯৭৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। তারপর দত্তদা (সুভাষ দত্ত) তার নিজের ছবি ‘ডুমুরের ফুল’ নির্মানের কাজ শুরু করেন। স্পন্দন রেকর্ডিং স্টুডিও-তে তিনি তার ছবির গান ‘আপায় কইছে আমারে বাল্যশিক্ষা শিখাইবে’ রেকর্ড করার পর দাদা আমাদের বললেন – দেখো এটা আমার নিজের প্রোডাকশন। আমি কিন্তু তোমাদের এখন টাকা দিতে পারবো না, ছবি বানানোর পর টাকা দিবো। এ কথার পর অনেকে থেকে গেছে, কিন্তু আমি চলে আসলাম। তারপর আর ফিল্মে কাজ করি নি।

ফিল্ম থেকে বের হয়ে আমি চিত্রকর ব্যানার স্টুডিও-তে চাকুরী শুরু করলাম। ওখানে সিনেমার ব্যানার তৈরী করা হত। বিদেশ কুমার ধর ছিলেন ওখানকার ওয়ার্কিং পার্টনার এবং চিফ আর্টিস্ট। উনার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৪ সালে বিদেশ বাবু বের হয়ে এসে নিজের প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এবং আমিও তার সাথে যোগ দিই – দুজনে মিলে বিকেডি পাবলিসিটি স্থাপন করি এবং কাজ করা শুরু করি।

এ সময় আমরা দুটো ছবি প্রযোজনাও করি। এদের প্রথমটি ‘শেষ পরিচয়’ এবং পরেরটি ‘পাষাণ’। পাষাণ ছবির কাজ করার সময়েই ১৯৯২ সালে তার সাথে আমার কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরী হয় এবং আমি পার্টনারশিপ থেকে সরে আসি। বিকেডি-তে চিফ আর্টিস্ট ছিলেন বীর বিক্রম সিং। আমি তাকে পিক করি এবং দুজনে ফিফটি ফিফটি পার্টনারশিপে ১৯৯২ সালে বিএম পাবলিসিটি প্রতিষ্ঠা করি।

বিএম – নামকরণ কিভাবে হল?

তার নাম বিক্রম থেকে ‘বি’ এবং আমার নাম মোজাহারুল ইসলাম ওবায়েদ থেকে ‘এম’ নিয়ে বিএম পাবলিসিটি নামকরণ করা হয় এবং সকলের দোয়ায় এখনো আমরা একসাথে কাজ করে যাচ্ছি। উনি হাতের কাজ করতেন, আমি ক্লায়েন্টের দিকটা দেখতাম। আগে তো সব হাতে তৈরী হত, এখন কম্পিউটারের যুগ – সব কিছু কম্পিউটারে তৈরী হচ্ছে।

আপনারা যখন শুরু করেছেন তখন সব কাজ করা হত হাতে, এখন কম্পিউটারে করা হচ্ছে। দুটো মাধ্যমেই আপনারা কাজ করেছেন। কোন মাধ্যমটাকে আপনার বেশী ভালো লাগে?

আগে যখন কাজ করা হত তখন বড় প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করতে হত – মজার কাজ। অ্যালবাম ঘেটে সিনেমার স্টিল ছবি দেখে আমরা হাতে স্কেচ তৈরী করতাম। তারপর সেই স্কেচ ক্লায়েন্টকে দেখিয়ে অ্যাপ্রুভাল নিতাম। তারপরে ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে ছবি নিতাম। ছবি সাদাকালো হত, সেগুলোকে হাতে রং করে রঙ্গিন করা হত। ব্যাকগ্রাউন্ড কি হবে সেটা ঠিক করা হত। তারপর প্লেট তৈরী হত, প্রেসে যেত। একটা কাজ করতে সময় লাগত, কিন্তু কাজ করে আনন্দ পাওয়া যেত। একদম হাতের ছাপ, যত্ন মিলেমিশে তারপর পোস্টার তৈরী হত। এখন কাজ হচ্ছে কম্পিউটারে – মাউসের ক্লিকে। অনেক কম সময়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সেই মমতা-যত্ন কি এখন পাওয়া যাচ্ছে? আমার মনে হয় না।

আমরা দেখেছি মাঝে একটা সময়ে সিনেমার পোস্টারে অশ্লীলতা খুব বেড়ে গিয়েছিল। কেন?

আমরা যখন কাজ শুরু করি – ১৯৮৪ সালের দিকে – তখন কিন্তু পোস্টার সেন্সর করা হত না। শুধু চলচ্চিত্র সেন্সর করা হত, কিন্তু পোস্টার সেন্সর আওতার বাইরে ছিল। আশির দশকের শেষের দিকে এসে পোস্টারও সেন্সর করা হতে লাগল। কেন? তখন সিনেমা নির্মাণে নতুন নতুন কোম্পানী আসল। তারা সিনেমার দর্শককে আকর্ষন করার জন্য পোস্টারে খোলামেলা ভালগার ছবি দিতে শুরু করল। ফলে পোস্টারও সেন্সর নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসা হল।

তারপর যখন সিনেমায় খোলামেলা পোস্টার হচ্ছিল, তখন কিন্তু আমরাও বাধ্য হয়ে, প্রযোজকের স্বার্থে পোস্টার ডিজাইন করেছি। প্রযোজকরা অনুরোধ করতো – ছবি চলে না, পোস্টার করে দেন যেন দর্শক আসে। আমরা সেসময় খুব বেশি কাজ করি নি এবং প্রযোজকদের এধরনের ডিমান্ড পূরণ করার জন্য আমরা আলাদা কোন পারিশ্রমিকও পাই নি। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসল, এবং এসব বন্ধ হল।

ছবির পোস্টারে এত এত মুখ – অথচ বোম্বে-হলিউডের ছবিতে এক ছবি দিয়েও পোস্টার হয়। আমাদের পোস্টার এরকম হয় কেন?

এক ছবি দিয়ে পোস্টার তো একসময় আমরাও তৈরী করেছি। শুধু দুজনের ছবি দিয়ে সিনেমার পোস্টার হয়েছে। কিন্তু তারপরে প্রযোজকরা বড় বাজেটে ছবি তৈরী করা শুরু করেছেন- সেখানে অনেক বেশী আর্টিস্ট নিয়েছেন – নায়ক নায়িকার পাশাপাশি সিনিয়র আর্টিস্ট আসছে, ভিলেন আসছে, কমেডিয়ান আসছে – প্রযোজকও চেয়েছেন তাদের একটা ছবি যদি পোস্টারে না দেয়া হয় তাহলে দর্শক কিভাবে জানবে ছবিতে আর্টিস্ট কারা কারা। ফলে তাদের মুখের ছবিও এসেছে পোস্টারে।

বর্তমানে যে সব ডিজিটাল ছবি নির্মিত হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে বলুন।

ডিজিটাল ছবি আসার পর বেশীরভাগ নতুন প্রযোজক আসছে ছবি বানাতে। এদের মধ্যে অল্প কিছু লোক আসছে যারা সত্যিকার অর্থে ছবি বানাচ্ছে। বেশীরভাগই নামে ছবি বানাচ্ছে। ছবি বানাতে চাইলে ছবি বানাতে হবে, ছবির নামে প্রহসন বানালে চলবে না। অনেক প্রযোজক আসছেন ছবি বানাতে – বিশ-পঁচিশ লাখ টাকায় নাকি সিনেমা বানানো যায়। আমি অনেককেই বলেছি – আপনার ছবি চ্যানেলকে দিয়ে দেন, দুইলাখ, চারলাখ, পাঁচলাখ যা পান ওইটাই আপনার লাভ, এই ছবি হলে চলবে না। এই লগ্নি পুরোটাই নষ্ট করে চলে যাচ্ছে। ছবি বানানোর পর আমার কাছে এসে বলে – ভাই, পোস্টার ছাপানোর খরচ তো পাঁচ লাখ টাকা, আমি অর্ধেক দেই – বাকী অর্ধেক ছবি মুক্তির পরে দেবো। যখন সামর্থ্য ছিল করে দিয়েছি, করে দিতে দিতে এখন নিজের আর সামর্থ্য নাই। সত্তর-আশি লাখ টাকা বাজারে আছে যেটা আমি কখনো পাবো না।

কি মনে করছেন – বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কি আবার ঘুরে দাড়াবে?

দাড়াবে। এক সময় প্রতিসপ্তাহে ছবি মুক্তি পেত। দেশে হলের সংখ্যা ছিল বারোশ। একটা ছবি মুক্তি পেলে পাঁচশ হলে মুক্তি পেত। ভালো চললে আটশ-নয়শ হলেও মুক্তি পেত। তখন পরিচালক প্রযোজকরাও সেভাবে কাজ করত। ষোল শিটের পোস্টারও বানিয়েছি তখন। শহিদুল ইসলাম খোকনের ছবি মানেই তো দশ শিটের পোস্টার। উনি শর্তই দিয়ে দিতেন – বড় পোস্টার বানাবেন, ইত্তেফাক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন। মাঝে সময় খারাপ হয়েছে। এখন আবার আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়াচ্ছে। পুরাতন প্রযোজকরা যারা মাঝে ছবি বানানো বন্ধ রেখেছেন – তারা যদি আবার ফিরে আসতে শুরু করেন – তবে অবশ্যই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আবার সুদিন ফিরে আসবে।


২ টি মন্তব্য

  1. পুরাতন প্রযোজকরা যারা মাঝে ছবি বানানো বন্ধ রেখেছেন – তারা যদি আবার ফিরে আসতে শুরু করেন – তবে অবশ্যই ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আবার সুদিন ফিরে আসবে।

    তাদেরকে আনার দায়িত্ব নিবে কে?কেউ কি এবিষয়ে ভেবেছেন?অনেকে অভিমান করেই দূরে সরে আছেন।সরকার তাদের খবর ও নেয়না।তাদের চাহিদা পূরনের কোন চিন্তা ই করেনা।তাহলে তারা কোন সাহসে আবার আসবেন?

    যদি আসেন তাহলে এই ইন্ডাষ্ট্রির বড়ই উপকার হইত।
    সরকার এবং সেইসব পুরনো প্রযোজকদের আবারো আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দেখতে চাই।

    শুভ কামনা রইল বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য।

মন্তব্য করুন