Select Page

এ এক অন্যরকম বাতাস!

এ এক অন্যরকম বাতাস!

নাম: ঊনপঞ্চাশ বাতাস – Incomplete Breath (২০২০)
ধরন: রোম্যান্টিক সাই-ফাই ড্রামা
গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল
প্রযোজনা: রেড অক্টোবর ফিল্মস
অভিনয়: শার্লিন ফারজানা (নীরা), ইমতিয়াজ বর্ষণ (অয়ন), নেভিল ফেরদৌস হাসান (প্রফেসর), ইলোরা গওহর (নীরার মা), মানস বন্দ্যোপাধ্যায় (নীরার বাবা), ড. এনামুল হক (ডাক্তার), লামিয়া আহমেদ (নীরার বান্ধবী), খায়রুল বাশার (নীরার বন্ধু), সৈকত সিদ্দিক, শোয়েব মুনীর, ফারিহা শামস সেঁওতি, শাফায়াত মাহমুদ ফুয়াদ প্রমুখ।
মুক্তি: ২৩ অক্টোবর, ২০২০
দেশ: বাংলাদেশ
ভাষা: বাংলা

নামকরণ: ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ শিরোনামটি ধার করা হয়েছে ‘ঊনপঞ্চাশ বায়ূ’ বাগধারা থেকে, যার আভিধানিক অর্থ পাগলামি। ভারতীয় পৌরাণিক বৃত্তান্ত থেকে বাংলায় ব্যবহৃত ‘ঊনপঞ্চাশ বায়ু’ পদটির আবির্ভাব। ঋগ্বেদ সংহিতায় বর্ণিত ‘মরুৎগণ’ হলেন ঝঞ্ঝার দেবতাদের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এরা সংখ্যায় ৪৯জন, অর্থাৎ ঊণপঞ্চাশৎ মরুৎ। মরুৎ ও বায়ু সমার্থক করে বাংলায় ঊনপঞ্চাশবায়ু কথাটির ব্যবহার হয়, আর বায়ুর সমার্থক হলো বাতাস।

ঋগ্বেদে পাওয়া যায়, ৪৯জন ঝঞ্ঝার দেবতা একসঙ্গে কোনো কাজে বা কোনো কিছু করতে গেলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতো। তাঁরা কাজ করার সময় করেই যেত, ভালোমন্দ, ক্ষতি-লাভ কিছুই চিন্তা করতো না। কারও মাথায় ভয়ানক গন্ডগোল হলে, মেজাজ বিগড়ে গেলে কোনো কারণে সেও ‘ঊনপঞ্চাশ মরুৎ’ এর মতো ভয়ানক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিতে পারে। এ জন্য কারও মাথায় ভয়ানক গন্ডগোল বোঝাতে পূর্বে ‘ঊনপঞ্চাশবায়ু চড়েছে’ কথাটির ব্যবহার করা হতো। তবে পরিচালক এ নামের মাধ্যমে শুধু পাগলামি বোঝাতে চাননি। বিভিন্ন ইন্টারভিউ মারফত জানা যায়, এখানে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ বলতে পাগলামির পাশাপাশি অসম্পূর্ণ প্রশ্বাস (incomplete breath) বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নামটি শুধুমাত্র আভিধানিক অর্থে নয়, অনেকখানি ভাবার্থে ছবির বিষয়বস্তু তুলে ধরছে। তাই নামকরণ আমার কাছে যথাযথ মনে হয়েছে।

কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ বাংলা ছবির জন্য দুইটি দিক থেকে এক্সপেরিমেন্টাল। প্রথমত, ছবিতে রোমান্স ও ড্রামা বেশি প্রাধান্য পেলেও ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ প্রকৃতপক্ষে জনরা মিক্সিং ঘরানার ছবি। একই গল্পের ভেতরে রোমান্স, ড্রামা, সায়েন্স ফিকশন, হিউম্যানিটি, ফ্যান্টাসি, হরর, হালকা কমেডি, স্যাটায়ার, ইমোশন… সবকিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে। আমাদের দেশে জনরা মিক্সিং ঘরানার কাজ বলতে আমরা বুঝি নাচে-গানে ভরপুর কমার্শিয়াল ছবি, যেখানে আড়াই ঘণ্টা এন্টারটেইনিং হওয়া যায় এ রকম সমস্ত উপাদান চিত্রনাট্যে রাখা হয় এবং সেখানে বিনোদনের কথা মাথায় রেখে ওভার দ্য টপ উপস্থাপনার মাধ্যমে সমস্ত বিষয়বস্তু দেখানো হয়। এটি সে ধরনের কাজ নয়। এখানে উপস্থাপনা সহজ কিন্তু মূল বিষয়বস্তু তুলনামূলক গভীর।

দ্বিতীয়ত, ইউনিক স্টোরি লাইন, সঙ্গে ইউনিক উপস্থাপনা। গল্পে অয়ন-নীরার প্রেম ভালোবাসা মূল ফোকাসে থাকলেও ছবিটি অনেকখানি সায়েন্সের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সাধারণত হলিউডের ছবিগুলোতে দেখে থাকি, বিজ্ঞানীরা কোনো একটি প্রমাণের যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এ রকম কনসেপ্টের ওপর গল্প দাঁড় করিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে, কিংবা পরীক্ষাধীন/গবেষণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এ রকম কোনো স্বীকৃতি না পাওয়া কনসেপ্টকে পুঁজি করে চলচ্চিত্র বানাতে।

অতি সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে আজকে (২৩ অক্টোবর) আমাদের দেশে রিলিজ হওয়া ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ‘টেনেট’ এর কথা বলা যায়, যেখানে ‘ইনভারশন’ নামক গবেষণাধীন একটি কনসেপ্টের ওপর ভিত্তি গড়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। বস্তুত আমাদের দেশে সম্ভবত এবারই প্রথম এমন কিছু দেখা গেলো, যেখানে আমরা একটি গবেষণাধীন বিষয়বস্তুকে বড়পর্দায় তুলে ধরতে পেরেছি এবং বেশ ইউনিক উপস্থাপনার সাহায্যেই তুলে ধরতে পেরেছি। ইউনিক বলার কারণ হলিউডের বড় বড় পরিচালকেরা যুগ যুগ ধরে যেভাবে সাই-ফাই ছবি পর্দায় দেখাচ্ছেন, উপমহাদেশসহ সারাবিশ্বেই সেই একই স্টাইল অনুকরণ করে বেশির ভাগ সাই-ফাই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এর প্রেজেন্টেশন এ ক্ষেত্রে একদমই আলাদা, গতানুগতিক ধারায় না গিয়ে উপস্থাপনার নতুন রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছবিতে।

এ ছবিতে মূলত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মানুষের পুনঃ জন্ম লাভ করা সম্ভব কি না সে বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়েছে। ধারণা দেওয়া হয়েছে, যদি একটা ক্যাপসুলের ভেতর মৃত মানুষের ডিএনএ এর ব্লুপ্রিন্ট কোনোভাবে সংরক্ষণ করে রাখা যায়, তবে কোনো না কোনোভাবে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া সেই মানুষকে পুনরায় দুনিয়াতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সে মানুষ হয়েও ফিরতে পারে, কিংবা পশু-পাখির বেশেও ফিরতে পারে। আবার তিনি কোন বয়স ধরে ফিরবেন সে সম্পর্কিত পরিষ্কার ধারণা এ ছবি দেয়নি- শিশু অবস্থায় ফিরতে পারে, যুবক বয়সে ফিরতে পারে কিংবা বৃদ্ধ বয়সেও ফিরে আসতে পারে।

দ্বিতীয়ত একটি বিরল রোগের ওপর ছবিটি আলোকপাত করেছে, এটি হলো মেসোথেলিয়োমা (Mesothelioma)। এটি হলো এক ধরনের ক্যানসার, যা টিস্যুর পাতলা স্তর থেকে বিকাশ লাভ করে পরবর্তীতে অনেকগুলি অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে আবৃত করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ফুসফুস এবং বুকের প্রাচীরকে। এ রোগের তেমন কোনো লক্ষণ সাধারণত প্রকাশ পায় না, রোগীর দেহে বহুদিন বাস করার পর একসময় ফুসফুসের চারপাশে পানি জমা, পেট ফোলা, বুকে ব্যথা, কাশি, ক্লান্তি অনুভব করা, ওজন কমা, শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। দীর্ঘদিন সিলিকন জাতীয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি; আমাদের দেশে যারা ইট-বালু-সিমেন্ট আনা নেওয়ার কাজ করে থাকেন তাদের এ রোগ বেশি হয়।

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এর দুই অর্ধে দুইরকম নেতিবাচক দিক লক্ষ করা গেছে। সিনেমার প্রথমার্ধে অয়ন-নীরা এই দুইটি চরিত্রকে ঘিরে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং সিকোয়েন্স দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলো একদিক থেকে চিত্রনাট্যকারের সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়। অন্যদিকে ঐ একই অর্ধেই কিছু ছোট ছোট কমেডি/স্যাটায়ার টাইপ সিকোয়েন্স রাখা হয়েছে, যেগুলো মনে হয়েছে খুব একটা ভালো করে লেখা হয়নি। গল্পটিকে হালকা করার জন্য অর্থাৎ দর্শক যেন গল্পের গভীরতায় বোরিং ফিল না করে সে জন্যেই হয়তো এগুলোর সংযুক্তি, তবে আদতে মনে হয়েছে এগুলো ছবি দীর্ঘ করতেই অধিক সহায়তা করেছে। অবশ্য এর প্রভাব একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতে পারে, আমার কমেডি অংশ দেখে মোটেও হাসি আসেনি, আবার আমার আশপাশের অনেককে শুনেছি অট্টহাসি দিতে।

তবে ছবির শুরুতে গুলিস্তান-সদরঘাট এলাকায় যেরকম দারুণ সব সিকোয়েন্স বিল্ডআপ করা হয়েছিল, কিংবা যখন নীরা প্রথমবার অয়নের বাসায় যায় সেই অংশটুকু যেভাবে খুব সুন্দরভাবে বিল্ডআপ করা হয়েছে… পুরো প্রথমার্ধজুড়ে এই ধারা বজায় থাকেনি। তবে স্ক্রিনপ্লে যথেষ্ট গতিশীল থাকায় এই দুর্বলতাগুলো skip করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের প্রথমার্ধে বোরিং লাগার সুযোগ কম।

যদি কী দেখানো হয়েছে সেগুলো তুলনা করি সেদিক থেকে ছবির দ্বিতীয়ার্ধ প্রথমার্ধের থেকে অনেক ভালো, বলা যায় যেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দর্শক হিসেবে ছবিটি দেখতে যাওয়া তার অনেকখানি পূর্ণতা দিয়েছে ছবির দ্বিতীয়ার্ধ। কিন্তু… এখানে এসে বাধ সাধে গল্পের ধীর গতি। প্রথমার্ধে কিছু অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য থাকলেও গল্প সাধারণ গতিবিধি মেনে সামনে এগোচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে এসে গল্প যখন তার সঠিক রাস্তায় ফিরে এলো তখন যেন ছবি আর সামনেই এগোয় না! তুলনামূলক ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রচণ্ড ধীর গতির স্টোরিটেলিং এই অর্ধে দর্শকদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়।

ছবির শুরু হওয়ার আগে পর্দায় দেখানো সেন্সর সনদে যখন দেখেছিলাম ছবির দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা (১৬৫ মিনিট), তখনই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে। সাধারণত আমাদের দেশের পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবিগুলোও আড়াই ঘণ্টার বেশি দৈর্ঘ্য হয় না, বরং বর্তমানে এটি কমে এখন গড়ে ১২০-১৪০ মিনিটে নেমে এসেছে।

পুনরায় ইতিবাচক দিকে ফিরে আসি। এ ছবির যে কয়টি দিক চোখ বন্ধ করে উপভোগ করার মতো তার মধ্যে একটি হচ্ছে মিউজিক, যেটা নিয়ে পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো। আরেকটি হচ্ছে সংলাপ। কমেডি অংশের সংলাপটুকু আমার তেমন ভালো না লাগলেও বাকি সব অংশেই পুরো ছবিজুড়ে দারুণ সব সংলাপ দেখতে-শুনতে পাওয়া গেছে। এই মুহূর্তে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ভেতরের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে, দৃশ্যটি ট্রেলারেও দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যায় অয়ন নীরাকে একটি ছোট্ট কৌটায় আবির উপহার দেয়, সেটা দেখে নীরা জিজ্ঞেস করে “আপনার আমার কথা মনে ছিল?”, অয়ন বলে “না, আবির কেনার উপলক্ষে আপনার কথা মনে পড়েছিল”। ট্রেলারে এই অংশটুকু শুনতে বেশ সহজ মনে হলেও পুরো ছবি দেখার পর বোঝা গেছে ভালো সংলাপ কোনো সিনকে কতটা গভীর ও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। এ রকম অনেক সুন্দর সংলাপ পুরো ছবি জুড়ে দেখতে ও শুনতে পাওয়া যায়।

এ অংশ পাবে ৬৫% মার্ক।

পরিচালনা: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ছোটপর্দার একজন প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা। ছোটপর্দায় তার নির্মাণ অভিজ্ঞতা প্রায় এক যুগের। এই সময়টায় তিনি নির্মাণ করেছেন ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’, ‘রোদ মেখো সূর্যমুখী’, ‘অর্থহীন মানি প্ল্যান্ট’, ‘কাগজ কার্বনে সম্মোহন’, ‘কালো বরফ জমাট অন্ধকার’, ‘ধুলোর মানুষ মানুষের ঘ্রাণ’, ‘অক্ষয় কোম্পানির জুতো’, ‘দাস কেবিন’ এর মতো উল্লেখযোগ্য নাটক, টেলিফিল্ম। এগুলোর মাধ্যমে তিনি ছোটপর্দায় তার কাজের একধরনের নিজস্বতা তৈরি করে নিয়েছেন। তার একটি নির্দিষ্ট দর্শক গড়ে উঠেছে যারা তার নির্মাণ দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন। গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত একটু জটিল ঘরানার বিষয়বস্তু বাছাই করেন, যার বেশির ভাগ হয় মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কিত।

সে অনুসারে মনে হয়েছিল তার প্রথম চলচ্চিত্রও কিছুটা জটিল হবে, যা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হবে। যদিও নির্মাতা শুরু থেকেই আশ্বস্ত করেছেন তিনি অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সাজিয়েছেন এবং পরিশেষে কথা-কাজের মিলও পাওয়া গেছে। তিনি খুবই সরলভাবে ছবির প্রতিটি অংশ সাজিয়েছেন, কোনো অংশই দেখে মনে হয়নি যে এই অংশটুকু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। অন্তত তার ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ জটিল উপস্থাপনার নাটক রয়েছে সে তুলনায় ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ খুবই সরল। তবে যারা তার অতীতের গম্ভীর কাজের ভক্ত তারা এই ছবি দেখে কিছুটা হতাশ হতে পারে। ছবিকে যথেষ্ট হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন অধিক দর্শক গল্পটির সঙ্গে নিজেকে কানেক্ট করতে পারে।

অভিনয়: অভিনয়ে ইমতিয়াজ বর্ষণ ছবির সেরা পারফরমার। একজন মেডিসিন সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ এর চরিত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল। মনে হচ্ছিল তিনি ঐ চরিত্রের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে পেরেছেন। তার কথাবার্তা, চলন-বলন, সিনেমায় দেখানো তার জীবনাচরণ দেখে কখনো মনেই হয়নি আমি মঞ্চ থেকে উঠে আসা সম্ভাবনাময় অভিনেতাকে দেখছি, মনে হয়েছে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে, নিয়মিত ডাক্তার ভিজিট করে এমন একজনের জীবনাচরণ দেখছি।

বিপরীতে দীর্ঘদিন ছোটপর্দায় কাজ করা শার্লিন ফারজানার পারফরমেন্স তুলনামূলক দুর্বলই লেগেছে। তার চরিত্রে ডাইমেনশন ছিল। বেশির ভাগ সময় তাকে কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চরিত্রে দেখা গেছে, বাকিটা সময় তাকে দেখা গেছে একজন বিজ্ঞানী/গবেষকরূপে। এর মধ্যে গবেষকরূপে তার কাছ থেকে যথেষ্ট পরিণত পারফরমেন্স পাওয়া গেছে, এটি নিয়ে আমার অভিযোগ নেই। তবে চঞ্চল চরিত্রটিতে মনে হয়েছে তিনি ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারেননি, বিশেষ করে তার কমেডি টাইমিং খুবই দুর্বল লাগলো। অবশ্য এ অংশের লেখাতেও দুর্বলতা রয়েছে। তা ছাড়া পুরো ছবিজুড়েই তাকে একই রকম তীক্ষ্ণ ভয়েসে কথা বলতে দেখা গেছে, সিচুয়েশন যা ডিমান্ড করে সে অনুসারে কণ্ঠের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।

এ ছাড়া তার ডাবিং এও যথেষ্ট সমস্যা লক্ষ করা গেছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই তার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুন্দর, তীক্ষ্ণ এবং শ্রুতিমধুর। সমস্যা হলো সেই ভয়েসের সঠিক ব্যবহার পুরো ছবিজুড়ে পাওয়া যায়নি। একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে, যেখানে যেমন অভিনেতাদের ডাবিং এ দোষ আছে, তেমনি সার্বিক তত্ত্বাবধানের দিক থেকে পরিচালকেরও সমান দোষ আছে। দৃশ্যটি ছিল এ রকম, শার্লিন ফারজানা ইমতিয়াজ বর্ষণকে লঞ্চের তিনতলা/চারতলা থেকে ডাকেন। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল এমনিতেই খুব কোলাহলযুক্ত জায়গা, তো এখানে ওপর থেকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে ডাক দিতে হলে আপনার কণ্ঠে সর্বোচ্চ প্রেশার দিয়ে সজোরে ডাক দিতে হবে। সেখানে দেখা গেলো তিনি খুব মলিন সুরে ‘অয়ন’ বলে ডাক দিলেন, আর অয়নও কাকতালীয়ভাবে সেই ডাক শুনতে পেলো। আবার এর মিনিট খানিক বাদেই এ রকম একটি দৃশ্য দেখানো হলো, যেখানে তারা প্রায় তিন ফিট দূরত্ব রেখে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলবে। শার্লিন ফারজানা যথারীতি একইসুরে কথা বলছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা গেলো অপরপাশে থাকা ইমতিয়াজ বর্ষণ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। অথচ লঞ্চের ছাদ থেকে আসা ডাক নিচে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল!

পার্শ্ব চরিত্রে যারা ছিলেন তারা মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। ইলোরা গওহর এর চরিত্রের স্ক্রিন টাইমিং একটু বেশি আশা করেছিলাম, তবে যতটুকু পেয়েছেন ভালোই করেছেন। এ ছাড়া শার্লিন ফারজানার বন্ধুর চরিত্রে লামিয়া আহমেদ ও খায়রুল বাশার মোটামুটি ভালো অভিনয় করেছেন। তারা তুলনামূলক ভালো স্পেসও পেয়েছেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে বন্ধুর চরিত্রকে তেমন স্পেসই দেওয়া হয় না, তাই সাধারণত হাবাগোবা টাইপ বন্ধুই বাংলা সিনেমায় বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া ছোট ছোট চরিত্রে নেভিল ফেরদৌস হাসান, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. এনামুল হক, সৈকত সিদ্দিক, শোয়েব মুনীর, ফারিহা শামস সেঁওতি, শাফায়াত মাহমুদ ফুয়াদ প্রমুখ ভালো অভিনয় করেছেন।

এ অংশ পাবে ৭০% মার্ক।

কারিগরি: এই অংশে সবচেয়ে দারুণ কাজ হয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের, যে দায়িত্ব পালন করেছেন মীর মাসুম। মানানসই বিজিএম দৃশ্যগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি অভিজ্ঞ রিপন নাথের করা মিউজিক ডিজাইনও ভালো হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল সাউন্ডের আধিক্য কিছুটা বেশি থাকলেও অত একটা খারাপ লাগেনি। সাধারণত টালিগঞ্জ এবং বলিউডের চলচ্চিত্রে আর্টিফিশিয়াল সাউন্ড বেশি শুনতে পাই, আমাদের দেশে রিয়েল লোকেশনের অরিজিনাল সাউন্ড বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাই এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা পাওয়া গেলো। মিউজিকের পাশাপাশি সিনেমাটোগ্রাফির কাজ বরাবর টক্কর দেওয়ার মতো হয়েছে। গুলিস্তান এরিয়াটিকে খুব সুন্দরভাবে ক্যাপচার করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘১৫ মিনিট অন্তর অন্তর ড্রোন ক্যামেরা উড়াও’ এই নীতি ফলো করা হয়নি। ড্রোন শট আছে, তবে সেটা পরিমিতভাবে। ডিজিটাল চলচ্চিত্রে ড্রোন ক্যামেরা আসার পর থেকে এটি চলচ্চিত্রকারদের কাছে এক ধরনের গুপ্ত পদ্ধতি হয়ে গেছে।

সিনেমাটোগ্রাফি এবং মিউজিকের কাজ ভালো হলে এমনিতেই যেকোনো ছবি একবার দেখার মতো রিকমেন্ডেশন পেয়ে যায়। এরে বাইরে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস এবং কম্পিউটার গ্রাফিকসের কাজ খুবই ভালো হয়েছে। গতানুগতিক স্বল্প বাজেটের কাজ এটা না, তা ছাড়া ভিএফএক্স ও সিজিআই দেখলেই একপ্রকার স্পষ্ট হয়ে যায়। কোনটা আসলেই শুট করা আর কোনটা সিজিআই ইউজ করে করা তা পার্থক্য করা বেশ কঠিনই হবে। ছবির প্রায় পুরোটাই শুট হয়েছে গুলিস্তান-সদরঘাট অঞ্চলে যার অনেকখানি গণমানুষের মধ্যে। এ রকম জনমানুষে ভরা এলাকায় সিনেমা শুট করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। ছবির টিম সেই চ্যালেঞ্জ বেশ ভালোভাবেই উতরে যেতে পেরেছেন।

কারিগরি দিকের সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক লেগেছে দৈর্ঘ্য ভিত্তিক এডিটিং, যা সম্পর্কে অনেকখানি ইতিমধ্যেই আলোচনা করে ফেলেছি। কিছু কিছু সিন অযথা লম্বা করা হয়েছে, অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কিছু সিন অতিরিক্ত মনে হয়েছে, না থাকলেও চলতো। ট্রেলারে দেখানো কিছু সিকোয়েন্স ছবিতে খুঁজে পাইনি, আবার ইউটিউবে রিলিজ হওয়া পাঁচ গানের মধ্যে মূল চলচ্চিত্রে শুনতে পেয়েছি চারটি। এতে মনে হলো কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে, তবুও ছবির লেংথ হয়ে গেছে ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। এর বাইরে ছবির ডাবিং এ কিছু সমস্যা ছিল, যেটি সম্পর্কেও ইতিমধ্যে আলোচনা করে ফেলেছি।

এ অংশ পাবে ৭৫% মার্ক।

বিনোদন ও সামাজিক বার্তা: ইউটিউবে ৫টি গান রিলিজ হলেও মূল চলচ্চিত্রে গান পাওয়া গেছে চারটি। ভারতের ‘ক্যাকটাস’ ব্যান্ড প্রধান সিধুর গাওয়া ‘চিবুক’ গানটি মূল চলচ্চিত্রে খুঁজে পাইনি। এটি বাদে বাকি সবগুলো গানই শ্রুতিমধুর। অর্থহীন ব্যান্ড প্রধান বেজবাবা সুমন বহুদিন পর কোনো নতুন গান উপহার দিলেন তাও প্লেব্যাকের মাধ্যমে, এবারই প্রথম তিনি প্লেব্যাক করলেন। সাধারণত বেশি পারিশ্রমিক এবং বিভিন্ন অডিও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পীদের চলচ্চিত্র প্লেব্যাকে খুব একটা দেখা যায় না। এককালে আইয়ুব বাচ্চু এবং ডিজিটাল সময়ে জেমস, এরাই মূলত তুলনামূলক বেশি প্লেব্যাক করেছেন। তাই যেকোনো চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় ব্যান্ড শিল্পীদের প্লেব্যাক করা মানে স্পেশাল কিছু। শুনেছি সামনে ওয়ারফেজ কোনো একটি চলচ্চিত্রের জন্য টাইটেল ট্র্যাক রেডি করছে।

মূল চলচ্চিত্রে যে গানগুলো শুনতে পাওয়া গেছে-

১.
প্রথম
কণ্ঠ: বেজবাবা সুমন (অর্থহীন)
গীতিকার: সুমন টিংকু
সুরকার: ইমতিয়াজ বর্ষণ
সংগীত: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল

২.
যেখানে
কণ্ঠ: সোমলতা আচার্য চৌধুরী (ভারত)
গীতিকার, সুরকার ও সংগীত: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল

৩.
মেঘমালা
কণ্ঠ, গীতিকার ও সু্রকার: মাসুদ হাসান উজ্জ্বল

৪.
এ শহর
কণ্ঠ, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত: সৌরিন

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ চলচ্চিত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রেম-ভালোবাসার বাইরে ঢাকা শহরে স্ট্রাগল করা মধ্যবিত্ত সমাজের দৃশ্য খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। অয়নের মতো ঢাকা শহরে এ রকম হাজারো সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে, অথচ অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে পিছপা হচ্ছে না। বর্তমান সমাজ এগুলোকে নিজের খেয়ে বনে মোষ তাড়ানো মনে করলেও, আদতে এই মানুষগুলো না থাকলে সমাজে ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে, যারা প্রতিনিয়ত যেভাবে যতটুকু সম্ভব মানুষকে উপকার করে যাচ্ছে। সাধারণত মিডিয়ায় খারাপ মানুষের কুকর্ম বেশি হাইলাইট করে দেখানো হয়, কারণ আমজনতা ভালো মানুষের ভালো কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হওয়ার চাইতে খারাপ মানুষের কুকর্ম দেখে এ থেকে সাবধান থাকতে বেশি পছন্দ করে। এ কারণে অয়নের মতো যারা মানবিকতায় বিশ্বাসী, তাদের জীবনের স্ট্রাগল মিডিয়ায় খুব একটা উঠে আসে না।

এ অংশ পাবে ৭০% মার্ক।

ব্যক্তিগত: পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল একাই ছবির অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট সামলিয়েছেন। তিনি গল্প লিখেছেন, চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন, সংলাপ লিখেছেন, আর্ট ডিরেকশন দিয়েছেন, গান গেয়েছেন, গান লিখেছেন, গানে সুর দিয়েছেন ইত্যাদি। তাই ছবির সাফল্যের অনেকখানি ক্রেডিট যেমন তার প্রাপ্য, তেমনি ছবির দোষগুলোও অনেকখানি তার ওপর অধিক বর্তায়।

সব মিলিয়ে যদি বলি, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এর ইউনিক স্টোরিলাইন, বিজ্ঞানকে অন্যভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা, মনে রাখার জন্য সংলাপ, ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনয়, যথোপযুক্ত পার্শ্ব চরিত্র, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সিনেমাটোগ্রাফি, ভিএফএক্স, সিজিআই এবং গান ছবির ইতিবাচক দিক। যদি ছবির দৈর্ঘ্য অন্তত ১৫-২০ মিনিট কমানো যেতো, প্রথমার্ধের বিষয়বস্তু কমিয়ে দ্বিতীয়ার্ধের বিষয়বস্তুসমূহকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া যেতো এবং যদি ডাবিং এর সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যেতো… তবে ছবিটি দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো হতো।

রেটিং: ৭.৫/১০

ছবিটি কেন দেখবেন: বহুদিন বাদে কোনো মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র বড়পর্দায় মুক্তি পেয়েছে। পূর্বে উল্লেখ করলাম ছবিটি এক ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল, জনরা মিক্সড করে এ রকম প্রেজেন্টেশন সচরাচর বাংলা সিনেমায় দেখা যায় না। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতির প্রয়োজন, তাই প্রথম চলচ্চিত্রে ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। তাই নতুন কিছু এক্সপেরিয়েন্স করতে ছবিটি একবার দেখা যায়। ভালো ছবি যথেষ্ট সাপোর্ট পেলে এ রকম নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্টের সংখ্যা আর বাড়বে, দর্শকও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং রুচির উন্নতি ঘটবে।


মন্তব্য করুন