এ জে মিন্টুর মাস্টারপিস ‘সত্য মিথ্যা’
১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘সত্য মিথ্যা’ মুক্তি পায় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও শিল্পনগরী খুলনায়। মুক্তির পর দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ও হল মালিকদের মাঝে ছবিটি নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে মুক্তি পাওয়ার পর টানা ২৫ সপ্তাহ বা ‘সিলভার জুবিলি’ সপ্তাহের মাইলফলক অর্জন করে ছিল ছবিটি।
এমন অবস্থা দেখে ২ জুন ‘সত্য মিথ্যা’ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নতুন করে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ছবিটি সপরিবারের সিলেটে তৎকালীন সময়ে নবনির্মিত বিশাল পরিসরে ‘নন্দিতা’ সিনেমা হলে দেখেছিলাম, যা আজও চোখে ভাসে।
ছবির গল্পটা ছিল এমন— চৌধুরী সাহেবের (গোলাম মুস্তাফা) একমাত্র মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, এতো সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও যাকে তিনি বিবাহ দিতে পারছেন না। ওনার অফিসে চাকরি নেয় রাজু। যে বিবাহিত কিন্তু চাকরির শর্ত হলো অবিবাহিত হতে পাবে। আলমগীরের চাকরিটা খুব দরকার তাই সে বিষয়টা চেপে যায়।
ধীরে ধীরে চৌধুরী সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায় আলমগীর এবং ঘটনার পরিক্রমায় চৌধুরী সাহেবের মেয়ে নূতনের সঙ্গে পরিচয় হয়। যে নূতন কারো সঙ্গে কথা বলতো না, ঘর থেকে বের হতো না; সেই নূতন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে নতুন পরিবেশে। এ দেখে চৌধুরী সাহেবের চিন্তা দূর হয়। তিনি আলমগীরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু আলমগীর বিবাহিত এবং তার একটা পুত্র সন্তানও আছে; যার ফলে বিয়েতে রাজি হয় না। চৌধুরী সাহেবের বাড়ির বিশ্বস্ত ভৃত্য আনোয়ার হোসেন আলমগীরকে বোঝাতে গেলে সে সব ঘটনা খুলে বলে চলে যায়। আলমগীর বিবাহিত এই কথা শুধু আনোয়ার হোসেন জানেন। যা তিনি বলার আগেই চৌধুরী সাহেব হৃদ্রোগে আক্রান্ত হোন আলমগীর চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর শুনে। ডাক্তার বলে যায় চৌধুরী সাহেব সুস্থ হলেও যদি কোন কারণে আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হোন তাহলে তিনি মারাও যেতে পারেন।
আলমগীর স্ত্রী শাবানার কাছে এসব ঘটনা লুকিয়ে রাখেন। এদিকে তাদের ছেলে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়, যাকে বাঁচাতে দেড় লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু আলমগীরের পক্ষে এতো টাকা জোগাড় করাও সম্ভব নয়। আলমগীর টাকার জোগাড়ের জন্য বের হোন, তাকে পথে পেয়ে যায় চৌধুরী আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেনও তাকে খুঁজতে বের হয়েছিল, এবার সব কথা খুলে বলেন। আলমগীর তাতেও রাজি হয় না। শেষপর্যন্ত আনোয়ার হোসেন বোঝান, ছেলেকে বাঁচাতে হলে যে টাকা তুমি খুঁজছো তা তোমাকে কেউ দেবে না কিন্তু এই টাকা তুমি অনায়াসে পাবে যদি চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হও। তাতে করে চৌধুরী সাহেব ও তোমার ছেলে দুটো জীবন বেঁচে যায়। অবশেষে আলমগীর রাজি হয়।
একদিকে হাসপাতালে ছেলের অপারেশন চলছে, অন্য দিকে আলমগীর বর সেজে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাসর ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার হোসেন মিথ্যা বাহানা করে আলমগীরকে হাসপাতালে তার অসুস্থ ছেলেকে দেখতে পাঠায়। এভাবে ছবি এগিয়ে যায়। চৌধুরী সাহেব যেদিন জানতে পারেন আলমগীর বিবাহিত, সেদিন তিনি হৃদ্রোগে মারা যান। তখনো নূতন জানে না আলমগীর বিবাহিত আর শাবানাও জানে না আলমগীর আরেকটি বিয়ে হয়েছে।
আলমগীর নতুনের সংসারে শাবানা কাজের বুয়া হিসেবে ঠাঁই নেয়। এমন সব নাটকীয়তায় ছবিটা এগিয়ে যায়, এক সময় সব সত্য-মিথ্যা প্রকাশ পায়। অর্থাৎ যা ছিল সত্য তা হয় মিথ্যা আর যা মিথ্যা ছিল বিভিন্ন ঘটনার কারণে সেগুলো হয় সত্য। এই সম্পর্কের টানাপোড়েন দর্শকের মনে দাগ কাটে। আজও ছবিটির কথা ভুলতে পারিনি তারা। কিছু সাধারণ ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ জে মিন্টু পুরো বাস্তবতার মিশেলে তৈরি করেছিলেন, দেখে মনে হয়েছিল এটি আমাদের সমাজেরই চেনা কারো অজানা গল্প।
মিন্টু ছবির শুরু থেকেই এমনভাবে শাবানাকে রাখলেন যা নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল দর্শকদের; ছবিতে কি আসলেই শাবানা আছে। কারণ শাবানা থাকবেন অথচ ছবি শুরু হওয়ার পর থেকে এতো দীর্ঘ সময় তার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না সেটা এর আগে দর্শকেরা আর কোন ছবিতে দেখেছিলেন বলে মনে করতে পারছিল না। জহিরুল হকের ‘সারেন্ডার’ ছবিতে শাবানা অনেকক্ষণ পর্দার বাইরে ছিলেন কিন্তু ছবির শুরুর দিকে অন্তত দেখা দিয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি আছেন। কিন্তু মিন্টু তো একবারই শাবানাকে দেখাচ্ছে না, এমনকি তার থাকারও কোন ইঙ্গিত দিচ্ছেন না।
শাবানা পর্দায় আসে ছবি শুরু হওয়ার ৪০ মিনিট পর। আসলেই এ জে মিন্টু অন্য সবার চেয়ে আলাদা ছিলেন বলেই দর্শকদের হৃদয়ের মণি শাবানাকে আড়াল করে রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। মিন্টু ছবির গল্পের প্রয়োজনেই শাবানাকে পর্দায় একবারও আনেননি। কারণ গল্পটা যে ছিল জীবনযুদ্ধে বাধ্য হয়েই কিছু সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এক তরুণের গল্প, যে তরুণ জানেই না যে সে ধীরে ধীরে কীভাবে মিথ্যার জালে আটকে যাচ্ছে। বেকার আলমগীর বিবাহিত এই কথা সে একবারও উল্লেখ করেনি বা এই প্রশ্নের উত্তর সে সরাসরি কিছুই দেয়নি কারণ বলে দিলে নতুন চাকরিটাই যদি চলে যায় সেই ভয়ে। আলমগীরের দরকার একটি চাকরির কারণ ঘরে তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে যারা অনাহারে দিনযাপন করছে। হঠাৎ বেকার হয়ে পড়া আলমগীরের আরেকটি চাকরি বড় প্রয়োজন এটাই শেষ কথা। আলমগীর চাকরি পেয়ে যান এবং কঠোর বসের মনও জিতে নিয়েছিলেন। কিন্তু সাহস ও সততা জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে আলমগীর আরও কঠিন সময়ের মুখোমুখি হোন আর এভাবেই গল্প এগিয়ে যায়। আরও মজার ব্যাপার, প্রধান খলনায়ক রাজীব পর্দায় হাজির হয়েছিলেন সর্বপ্রথম বিরতির পর। রাজীব আসার আগে মিজু আহমেদকে এমনভাবে তৈরি করে রাখলেন যে মিজু আহমেদের সঙ্গে রাজীব একই সূত্রে গাঁথা অথচ দুজন ছিল দুজনার অপরিচিত। এমন সাহস এ জে মিন্টু ছাড়া কে দেখাতে পারে বলুন?
গল্পের সব চরিত্রকে এক সুতোয় গেঁথে মালা বানানোতে মিন্টুর জুড়ি ছিল না। যে শাবানা শুরু থেকে ৪০ মিনিট পর্যন্ত পর্দায় নেই, সেই শাবানা পরবর্তীতে গল্পের অন্যতম শক্তিশালী একটি চরিত্র হিসেবে পর্দায় আবির্ভাব হলেন এবং শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ছিলেন। শাবানা ছবিতে আছেন সেটা মিন্টু কয়েকটি দৃশ্য ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যা খুব সাধারণ দর্শকেরা ধরতে পারার কথাও নয়। যখন গোলাম মুস্তাফা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে তখন নতুনকে হাসপাতালে রেখে কাউকে কিছু না বলে হুট করে কেবিন থেকে বের হয়ে টাউন বাসে চড়ে আলমগীরের কোথাও চলে যাওয়া এবং দু’ঘণ্টা পর ভাত খেয়ে ফেরত আসা এসবই ছিল আলমগীরের গোপন কিছুর ইঙ্গিত দেয়া যা ততক্ষণ পর্দায় না দেখানোটাই যুক্তিসংগত ছিল। কারণ পর্দায় তখন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, তার একমাত্র মেয়ে ও তাঁদের কোম্পানিতে চাকরিরত একজন তরুণের গল্প দেখাচ্ছিল যে গল্পটি একটি ‘সত্য’কে এড়িয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মিথ্যার জালে পা দেওয়ার গল্প।
মিন্টুর সুনিপুণ নির্মাণের কাছে বছর শেষে মতিন রহমানের বক্স অফিস কাঁপানো ‘রাঙাভাবী’ ও মালেক আফসারীর ‘ক্ষতিপূরণ’ হার মেনে যায়।
১৯৮৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটি একাধিক শাখায় পুরস্কার অর্জন করে— সেরা পরিচালক – এ জে মিন্টু, সেরা চিত্রনাট্যকার – এ জে মিন্টু, সেরা সংলাপ রচয়িতা – ছটকু আহমেদ, সেরা শিশুশিল্পী – মাস্টার জনসন ও সেরা সম্পাদক – মুজিবুর রহমান দুলু।
- ‘সত্য মিথ্যা’র রিমেক হয়েছিল কলকাতায়। আলমগীর-নূতন ছাড়াও ঢাকার বেশ কয়েকজন শিল্পী ছিলেন ওই সিনেমা।