ওমর সানী: নব্বই দশকের অন্যতম তারকা
ওমর সানীর অভিষেক হয় ১৯৯২ সালে গুণী পরিচালক নুর হোসেন বলাই’র হিট ছবি ‘এই নিয়ে সংসার’-এর দিয়ে। ছবিটিতে তিনি প্রধান নায়ক চরিত্রে ছিলেন না, প্রধান চরিত্রে ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। আর স্বাভাবিকভাবেই ছবিটি হিট হলেও তার পুরো সফলতা চলে যায় এ জুটির ঘরে। তবে কাঞ্চনের ছোট ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা লম্বা আর সুঠাম দেহের অধিকারী ওমর সানী ঠিকই তখনকার অনেক প্রযোজক আর পরিচালকদের নজরে পড়েন।
যার প্রেক্ষিতে পরিচালক শেখ নজরুল ইসলাম গুণী অভিনেত্রী আনোয়ারার মেয়ে মুক্তি ও সানীকে নিয়ে তৈরি করলেন সম্পূর্ণ রোমান্টিক ধারার চলচ্চিত্র ‘চাঁদের আলো’, যা ছিল সানীর একক নায়ক হয়ে প্রথম চলচ্চিত্র। তখনকার সময়ে রেডিওর কল্যাণে ‘চাঁদের আলো’ ছবির গানগুলো চরম হিটের দুয়ারে। ‘তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো’ বা ‘প্রেমের নামে মিথ্যে বলো না’ গানগুলো ছিল মানুষের মুখে মুখে, ঠিক এই যখন অবস্থা তখন ছবিটির মুক্তির পর দর্শকদের দেখার আগ্রহও উঠল চরমে। ছবিটি দেখার জন্য যেন দর্শকদের ঢল নেমেছিল সারা দেশের সিনেমা হলগুলোতে। আমি নিজেও রাজশাহীর উপহার হলে বহু কষ্টে টিকিট কেটে ছবিটি দেখেছিলাম।
যাই হোক… এর পরপরই সানীর দুটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার একটি নুর মোহাম্মদ মনি পরিচালিত ‘প্রেম প্রতিশোধ’ (বিপরীতে সোনিয়া)। অন্যটি তার প্রথম চলচ্চিত্রের পরিচালক নুর হোসেন বলাই’র ‘মহৎ’, দ্বিতীয় নায়ক হয়ে নয় বরং ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো দাপুটে অভিনেতার সঙ্গে সমান গুরুত্বের চরিত্রে অভিনয় করলেন সানী। ছবিটিতে নায়িকা ছিলেন নবাগতা শাহনাজ, সঙ্গে রাজীবের মতো তারকা অভিনেতাও। ফলাফলে সুপার হিট হলো ‘মহৎ’। এবার আর ইলিয়াস কাঞ্চনের একার সফলতায় নয় বরং ছবিটির শতভাগ সাফল্য সানী ও কাঞ্চনের দুয়ারে সমান ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ওমর সানীরও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়ে যায়, চুক্তি হতে থাকেন একের পর এক চলচ্চিত্রে।
যার প্রেক্ষিতে মুক্তি পায় সানীর একক নায়ক হয়ে বাম্পার হিট চলচ্চিত্র নাদিম মাহমুদের ‘আখেরী হামলা’। সম্পূর্ণ অ্যাকশন ধাঁচের চলচ্চিত্রটিতে সানীর নায়িকা ছিলেন নতুন মুখ নিশি। চমৎকার নির্মাণের সঙ্গে সানীর মারমুখী অভিনয় ছবিটিকে পৌঁছে দিয়েছিল সুপারহিটের তালিকায়। ছবিটির একটি বিষয়ে হঠাৎ খুব মনে পড়ছে, তা হলো এর হল পোস্টার। এখনো মনে আছে, মুখ ভর্তি সাদা দাঁড়ি আর সাদা চুল নিয়ে ওমর সানী বিশেষ এক পোজ দিয়ে পুরো পোস্টার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা পোস্টারটিকে দারুণ আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। পোস্টারটি দেখে থমকে দাঁড়াতেই হতো, প্রথম দেখাতে কেউ বলতে পারবে না যে চিত্রটি সানীর ছিল। একটি সফল ছবির পেছনে যে পোস্টারের অনেক বড় ভূমিকা থাকে তার জ্বলন্ত উদাহরণ ‘আখেরী হামলা’। পোস্টারটি দেখে আমার মতো অনেক দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ছবিটি দেখার জন্য।
চাঁদের আলো ছবির সেটে ওমর সানী, মুক্তি ও নৃত্য পরিচালক মাসুম রেজা
পরপর তিন ছবির সাফল্যে যখন সানী নির্মাতাদের আস্থার প্রতীক হয়ে ধরা দিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই সেই আস্থার জায়গাকে আরও মজবুত করতে গুণী পরিচালক দিলীপ সোম ও রায়হান মুজিব নিয়ে এলেন ‘দোলা’ ও ‘আত্ম অহংকার’-এর মতো সুপারহিট ছবি। সদ্যই মুক্তি পাওয়া ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ও ‘অন্তরে অন্তরে’র মতো তুমুল দুই জনপ্রিয় ছবি দিয়ে নতুন মুখ মৌসুমী তখন ভাসছে সাফল্যের আকাশে, ঠিক তখনই মেধাবী পরিচালক দিলীপ সোম সানী-মৌসুমীকে জুটি করে বানালেন ‘দোলা’। রোমান্টিক গল্পের দক্ষ নির্মাণে ‘দোলা’ হলো সুপারহিট। রায়হান মুজিব মৌসুমীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসলেন মিউজিক্যাল লাভ স্টোরি ‘আত্ম অহংকার’, শ্রুতি মধুর সব গান সঙ্গে মজবুত গল্পের দক্ষ নির্মাণে এই ছবিটিও হয়ে যায় সুপারহিট। দুটি বড় সাফল্যে জুটি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় সানী-মৌসুমী, দর্শকেরা দারুণভাবে গ্রহণ করেন তাদের, শুরু হলো চলচ্চিত্রের এক নতুন জুটির অধ্যায়।
জুটি প্রথা হলেও সানী কিন্তু সে সময়ে তার সমসাময়িক প্রায় সব নায়িকার সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। আবার চম্পা-অঞ্জুদের মতো সিনিয়র অভিনেত্রীদের সঙ্গেও করেছেন ‘আজকের ছিনতাই’, ‘কালপুরুষ’ এবং কলকাতার ‘কাঞ্চন মালা’ ও ‘গরীবের সম্মান’ ছবিতে। সানী যখন নিজেকে একের পর এক চলচ্চিত্রে মেলে ধরছেন তখন তার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ছিলেন নাঈম, বাপ্পারাজ, আমিন খান ও সালমান শাহর মতো তারকা অভিনেতারা।
বিশেষ করে সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর সঙ্গেই তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি ছিল। একটা সময় এমন হলো এক শ্রেণির দর্শকেরা কেউ সালমান কেউ সানী কেন্দ্রিক ভাগ হয়ে গেল, চলতে থাকলো একে অপরের চলচ্চিত্র নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তবে দিন শেষে ঠিকই তারা সবাই সবারটা চলচ্চিত্র দল বেঁধেই সিনেমা হলে গিয়ে দেখতো। সে সময় এখনকার মতো ভক্তদের মধ্যে এত গোঁড়ামি ছিল না। আলোচনা-সমালোচনা হতো তবে সেটা সুস্থ সুন্দর পথেই থাকতো।
এদিকে হঠাৎ সালমান শাহর মৃত্যুতে যেন সানীর ভাগ্যের চাকা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। সালমানের রেখে যাওয়া বেশ কয়েকটি ছবি আসলো সানীর হাতে, যার মধ্যে ‘অধিকার চাই’, ‘মধুর মিলন’, ‘কে অপরাধী’ অন্যতম। শুধু চলচ্চিত্রই নয়, সেই সঙ্গে সাথী হিসেবে পেলেন সময়ের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবনূরকেও, জুটি হয়ে করেন বেশ কয়েকটি ছবি। তবে তত দিনে বেশ মুটিয়ে যান সানী, এ নিয়ে বেশ সমালোচিতও হন তিনি, বিশেষ করে ‘রঙিন নয়ন মনি’ ও ‘অধিকার চাই’ ছবিতে তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। তবে সবকিছুকেই ছাপিয়ে যান ২০০০ পরবর্তী নিজের নিয়ন্ত্রণহীন বিশাল দেহ নিয়ে পর্দায় ভিলেন চরিত্রে তুলে ধরে, কঠিন সমালোচনায় পড়তে হয় তাকে। সেখান থেকে বেরিয়েও আসেন তিনি এবং চলচ্চিত্রে চরিত্র অভিনেতা হয়ে নিজেকে আবার মেলে ধরেন।
১৯৬৮ সালের ৬ মে জন্মগ্রহণ করেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় নায়ক ওমর সানী। ব্যক্তি জীবনে ১৯৯৬ সালে সহকর্মী মৌসুমীকে বিয়ে করেন এবং তাদের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।