Select Page

ওমর সানী-মৌসুমী: হঠকারিতা এখন সাহসিকতা

ওমর সানী-মৌসুমী: হঠকারিতা এখন সাহসিকতা

সোশ্যাল মিডিয়ায় ওমর সানীজায়েদ খানের মধ্যেকার একটা অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। যাকে নিয়ে ঘটনা সেই মৌসুমীও এই ব্যাপারে মুখ খোলায় বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি জটিলতা ও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে দুটি কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। 

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগটা আমি খুব ভালোভাবে উপভোগ করেছিলাম সেই সূত্রে ওমর সানী ও মৌসুমীর চলচ্চিত্রে আগমন, উত্থান-পতন তিনটি সময় আমি দেখেছি। 

ওমর সানী হলেন আমার দেখা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে অসচেতন ও নির্বোধ একজন অভিনেতা। এমন অভিনেতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এর আগে কখনো আসেনি, আজও নেই ও আগামীতেও আসবে না। সানী চলচ্চিত্রে আসেন মৌসুমীর ১ বছর আগে ১৯৯২ সালে। তবে এর আগে কিশোর সানী ১৯৮৭/৮৮ সালে ‘মশাল’ চলচ্চিত্রে ফারুকের ছোট বেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৯২ সালে শেখ নজরুল ইসলামের ‘চাঁদের আলো’ চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সফলতায় সানীর উত্থান বা প্রযোজক, পরিচালক, প্রদর্শক ও  দর্শকদের কাছে পরিচিতি পান।  এর ঠিক বছর খানেক আগে সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ীর মডেল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মৌসুমীর চলচ্চিত্রে আগমন। 

প্রথম ছবি দিয়েই সারাদেশে দর্শকদের কাছে মৌসুমী জনপ্রিয়তা লাভ করেন তার সৌন্দর্য ও সালমান শাহর কারণে।  বলিউডের আমির খান ও জুহি চাওলার জনপ্রিয় একটা চলচ্চিত্রের অফিসিয়াল রিমেক হওয়ায় দর্শকদের কাছে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নিয়ে আলাদা একটা আকর্ষণ ছিলো; যার ফলে মৌসুমীর প্রথম ছবি হিসেবে শুরুতেই দর্শকদের নজর কাড়তে পেরেছিলেন। প্রথম ছবি রেকর্ড ব্যবসা করার কারণে জুটি হিসেবে সালমান-মৌসুমীর চাহিদা তখন তুঙ্গে। কিন্তু  এ জুটি এরপর ৩টি চলচ্চিত্র (অন্তরে অন্তরে, স্নেহ ও দেনমোহর) পর্যন্ত টিকে; যার কারণ সালমান শাহ ও মৌসুমীর দুজনের মায়ের বিবাদ বা ব্যক্তিগত ইগো সমস্যা। দুই মায়ের বিবাদটা শুরু হয় শিবলী সাদিকের ‘অন্তরে অন্তরে’ ছবির শুটিংয়ের সময়। দুই মায়ের বিবাদে একটা সম্ভাবনাময় সফল জুটির ভাঙ্গন ধরে। যার ফলে সালমানকে নিয়ে প্রযোজক-পরিচালকরা শাবনূর এবং মৌসুমীকে সানীর সঙ্গে জুটিবদ্ধ করে নতুন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সফলতা পান। 

ফিরে আসি ওমর সানীর কথায়।  মৌসুমীর চলচ্চিত্রে আগমন, সালমানের সঙ্গে জুটির ভাঙ্গন এই সময়টাতে  (১৯৯৩-১৯৯৪) সানী কখনো একক কখনো দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে বেশ সফলতা পেয়েছিলেন নূর হোসেন বলাইয়ের ‘মহৎ’,  নাদিম মাহমুদের ‘আখেরী হামলা’, সৈয়দ হারুনর ‘চরম আঘাত’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘প্রেমগীত’,  নূর মোহাম্মদ মণির ‘প্রেম প্রতিশোধ’, ফখরুল হাসান বৈরাগীর ‘অগ্নিপথ’, এ জে মিন্টুর ‘বাংলার বধূ’, জীবন রহমানের ‘জানের দুশমন’, শেখ নজরুল ইসলামের ‘চাঁদের হাসি’ ছবিগুলো দিয়ে।  এরমধ্যে  মহৎ, প্রেমগীত,  আখেরী হামলা ব্যবসাসফল হলে প্রযোজক পরিচালকরা নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছে সানীর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ পায়।

উল্লেখ্য যে ১৯৯৩ সালে আমিন খান নামে আরেকজন নতুন সুদর্শন নায়কের আগমন ঘটে যার প্রথম ছবি ‘অবুঝ দুটি মন’ সুপারহিট ব্যবসা করে। আমিন খান ছিলেন সেসময় ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সুদর্শন নায়ক। আমিন খানের তথ্যটা এই কারণে দিলাম যে, প্রযোজক-পরিচালকরা চাইলে মৌসুমীকে দিয়ে আমিন খানের সঙ্গে জুটি বাঁধাতে পারতেন; কিন্তু তারা তা না করে ওমর সানীকেই বেছে নিলেন যার ফলে সালমান শাহর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যান ওমর সানী। সানী-মৌসুমীর প্রথম ছবি দিলীপ সোমের ‘দোলা’ ও দ্বিতীয় ছবি রায়হান মুজিবের ‘আত্মঅহংকার’ সুপার ডুপার হিট হওয়ায় এ জুটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একই সময়ে জহিরুল হকের ‘তুমি আমার’ সুপার ডুপার হিট হওয়ায় শাবনুর-সালমান জুটি পাকাপোক্ত হয়।

এরপরের ইতিহাসটা শুধুই নির্বোধ ওমর সানীর। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে একজন অভিনেতা কিভাবে শুধুমাত্র নিজের ভুলের কারণে ছিটকে যায় সেটা সানীর চেয়ে বড় উদাহরণ বিশ্ব চলচ্চিত্রে সম্ভবত আরেকটিও নেই। সালমান বেঁচে থাকতেই সানী চলচ্চিত্রে নিজেকে জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন; ঠিক তখনই মৌসুমীর সঙ্গে বিয়ের খবর প্রকাশ্য আসায় তাদের জুটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়। পর্দায় মৌসুমীর সঙ্গে জনপ্রিয়তা কমলেও সানী তা খুব ভালোভাবে উৎড়ে যেতে পারতেন; কিন্তু পারেননি শুধু ফিটনেস ধরে রাখতে না পারায়। 

সালমানের মৃত্যুর পর যে সানী হতে পারতেন প্রযোজক-পরিচালকদের সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা সেই সানী তখন দিনে দিনে এমনই মোটা হয়ে গেলেন যে খল অভিনেতা জাম্বুকেও হার মানাতো। একজন নায়ক জনপ্রিয়তার শীর্ষে যখন থাকার কথা তখন শুধুমাত্র মেদভূড়ির কারণে পুরো ক্যারিয়ারটা ওলট-পালট করে দিলেন। সেই সময় মনেই হয়নি সানী নিজের ফিটনেস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বরং মনে হয়েছিল কত মোটা হতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলাফল হিরো থেকে একদম জিরো বনে গেলেন। 

আজকের প্রজন্ম ওমর সানীকে নিয়ে অনেক ট্রল করতে পারে তা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একটা সময় তিনি ছিলেন নিজের সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।  সানীর অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন সবকিছুতে দুর্বলতা ছিলো তবুও দোলা, আত্মঅহংকার, প্রথম প্রেম, প্রিয় তুমি, মুক্তির সংগ্রাম,  লজ্জা, হুলিয়া, সংসারের সুখ দুঃখ, শয়তান মানুষ, শান্তি চাই, লাট সাহেবের মেয়ে, কুলি, প্রেমের অহংকার, অধিকার চাই, হারানো প্রেমের মতো ব্যবসাসফল ছবিগুলোর প্রধান নায়ক ছিলেন। এখন বর্তমান প্রজন্ম যদি বলে ‘সেই সময়কার প্রজন্ম ক্ষ্যাত ছিল তাই সানী সফল হয়েছিল’, তাহলে সেটা তাদের হীনমন্যতা কিংবা ভুল ধারণা।  কারণ যে প্রজন্ম স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দেখে দেখে বড় হয়েছে। আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান,মাইলস, ফিডব্যাক, ওয়ারফেইজ শুনে বড় হয়েছে; সেই প্রজন্মের মতো স্মার্ট ও তুখোড় প্রজন্ম আজকের প্রজন্ম নয়। 

এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ তা হলো ওমর সানীকে কখনও আমার কাছে বুদ্ধিমান মনে হয়নি; যা এত বছর পর ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও তিনি প্রমাণ করলেন।  সানী-মৌসুমী দম্পতির মধ্যে কোন সমস্যা যদি থেকেও থাকে সেটা এতদিন প্রকাশ্য আসেনি যা ওমর সানীর কারণে এখন এসেছে। সানীর উচিৎ ছিল বিষয়টাকে খুবই ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি ও ধৈর্য্যর সঙ্গে মোকাবিলা করা যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এত নোংরামি না হয়। কারণ তাদের দুই সন্তানও এখন বেশ ম্যাচিউরড। পরিবারের সংকটের সময়ে প্রধান কর্তা ব্যক্তিকে হতে হয় খুবই ধৈর্য্যশীল ও দৃঢ়চেতা যা ওমর সানী দেখাতে পারেননি।  

সানীর উচিৎ ছিলো সমস্যাটা যেখানে মৌসুমীকে নিয়ে সেখানে একটা বোঝাপড়ায় যাওয়া; এরপর জায়েদ খানকে জবাব দেয়া। কিন্তু সানী তা না করে জায়েদ খানকে জবাব দিতে গিয়ে উল্টো মৌসুমীর বক্তব্যর পর নিজেই এখন সবার কাছে তামাশার পাত্র হলেন।

গত দেড় দশকে এই রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থায় এতটাই পচন ধরেছে যে পারিবারিক সম্পর্কচ্ছেদ এখন পুতুল খেলার মতো হয়ে গেছে। যে রাষ্ট্রের নৈতিকতা, মানবিকতা বলতে কিছু নেই সেখানে সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি পর্যায়েও নৈতিক স্খলনের ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। এমন রাষ্ট্রে নৈতিক স্খলনটাই সাহসিকতার সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পর্ক এখানে তুচ্ছ।   

জায়েদ খানকে নিয়ে বলার কিছু নেই, জায়েদ খানকে নিয়ে কিছু বলতে রুচিতে বাঁধে। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কতটা অধঃপতন হয়েছে সেটা জায়েদ খান নায়ক ও শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হওয়াতে বোঝা যায়। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির যদি সুদিন থাকতো তাহলে আমি নিশ্চিত জায়েদ খান নায়ক হওয়া তো দূরের কথা এফডিসির মূল ফটকেই পার হওয়ার সাহস করতো না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন