Select Page

ওরে নীল দরিয়া এবং সারেং বৌ

ওরে নীল দরিয়া এবং সারেং বৌ

“আবহমান বাংলাদেশের একান্ত আপনজন,
তার কাহিনী আমার, আপনার, সবার…”

১৯৭৮ সালে খ্যাতনামা সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস “সারেং বৌ” অবলম্বনে আরেক কিংবদন্তী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেন “সারেং বৌ”। যেখানে নবিতন ও কদম সারেং, এই দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপদান করেছেন যথাক্রমে কবরী ও ফারুক; এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন নার্গিস, গোলাম মোস্তফা, দারাশিকো, বাবর, হাসান ইমাম, জহিরুল হক, আরিফুল হক সহ আরো অনেকে।

এছবিতে নবীতুন চরিত্র রূপদান করা কবরী তার দূর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এরকম শক্তিশালী নারী চরিত্র হয়তো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যাবে। এরকম চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পাওয়াও যেকোনো আর্টিষ্টের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্বীকৃতিসরূপ কবরী পরবর্তীতে এই চরিত্রের সুবাদে পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।

কবরী যেমন তার অভিনয়ের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তেমনি এছবিতে অসাধারণ সংগীতায়োজন করে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন কিংবদন্তী সুরকার আলম খান। তার, গীতিকার মুকুল চৌধুরী এবং আরেক কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বার সহ একাধিক সংগীতজ্ঞের পরিশ্রমে সৃষ্টি করা কালজয়ী গান “ওরে নীল দরিয়া” এখনো কোটি দর্শকের চোখের কোণে অশ্রু এনে দেয়। প্রযুক্তি সময়ের সাথেসাথে তরতর করে উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু চার দশক পরেও এই গানের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি।

আলম খান বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে এই গান সৃষ্টির পটভুমি আমাদের সবাইকে জানিয়েছেন, যেখান থেকে জানা যায় সামান্য একটা ৪-৫ মিনিটের গান তৈরির পেছনে তাদের কী পরিমাণ শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, গানটির অস্থায়ী সুরটা তার ১৯৬৯ সালে করা। ১৯৬৯ সালে তিনি একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ট্রিটমেন্টে ছিলেন। একদিন বিকেলে যখন তিনি একটু সুস্থ হলেন, গুনগুন করে সুরটা তার মাথায় আসে। কিন্তু তখন সুরের ওপর কথা লেখা হয়নি। তিনি সেসময় মনের মতো কোনো দৃশ্য না পাওয়ায় কোনো ছবিতে এই সুরটি ব্যবহার করতে পারেননি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেই সুযোগ এলো, “সারেং বৌ” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

তিনি বলেছেন, যাঁরা গানবাজনা জানেন, তাঁরা বুঝবেন—এতে ভূপালি, বিলাবল—এ দুটি রাগের সঙ্গে আমাদের মাটির সুরের মিশ্রণ করা হয়েছে। তিনি মনে করে থাকেন গানটি এর জন্যই এত বেশি জনপ্রিয়, এগুলোরই ফসল গানটি। এরপর ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে পরিচালক আবদুল্লাহ আল-মামুন তার কাছে এলেন ‘সারেং বউ’ ছবিটি নিয়ে। সারেং বাড়ি ফিরছে—এ রকম একটি সিকোয়েন্স পরিচালক তাকে শোনান। ওইখানে দেখা যাবে, সারেং গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে, আর তাঁর স্ত্রী নবিতন সেটি স্বপ্নে দেখছে। তখন তিনি গানটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাখা সেই সুরটি গীতিকার মুকুল চৌধুরীকে শোনান। মুকুল চৌধুরী গানের সুরের সাথে ভালো গীত বসাতে পারেন, তখন তিনি সুরের ওপর ‘ওরে নীল দরিয়া’ পুরো মুখটি লিখেন। এর দুইদিন পর গল্প অনুযায়ী অন্তরাসহ-ই লিখে নিয়ে এলেন। অন্তরাটি সবার এতো বেশি পছন্দ হয়, আলম খান এরপর তাঁর কথার ওপরই সুর করেন।

আলম খান পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে জানতে চাইলেন, সারেং কীভাবে বাড়ি ফিরছে। তখন তিনি বললেন, প্রথম অন্তরায় ট্রেনে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে, এরপর মেঠোপথ ধরে বাড়ী ফিরবে। দৃশ্য অনুযায়ী ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বইঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং শেষে একতারার ইফেক্ট তৈরি করা হলো এবং এগুলো সবই ছিল বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন আসবাবপত্র দিয়ে বানানো। যেমনঃ তিনি রেললাইনের সাউন্ড তৈরির জন্য খাঁজকাটা কাঠের টুকরা ব্যবহার করেছেন, বৈঠা বাওয়ার আওয়াজ তৈরিতে পাটকাঠি ব্যবহার করেছেন, বৈঠা বেয়ে বেয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন সাউন্ড তৈরির জন্য পানিভর্তি চাড়ি (গরুর পানি খাওয়ার পাত্র) ব্যবহার করেছেন। এসকল কাজ করা হয়েছে ৩ টি মাইক্রোফোনের সহায়তায়, মোট ১২ জন্য শিল্পী এই রিদমিক সেকশনে কাজ করেছিলেন, ছিলেন ১০ জন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী। গানটি কাকে দিয়ে গাওয়ানো যায়, আলম খান যখন ভাবছিলেন, তখন আবদুল্লাহ আল-মামুনই আব্দুল জব্বারের কথা বলেন। গানটি কাকরাইলের ঈপ্সা রেকর্ডিং স্টুডিওতে সকাল ১০টায় রেকর্ড শুরু হয়, শেষ হয় বিকাল ৫টায়। এরপরের গল্প মোটামুটি সবার জানা, গানটি এবং “সারেং বৌ” চলচ্চিত্র দর্শক দু’হাত ভরে গ্রহণ করেছিল।

“সারেং বৌ” চলচ্চিত্রের ইংরেজি ট্যাগলাইন রাখা হয়েছিল ‘The Survivors’। সত্যিকার অর্থেই এখানে এক নারীর সংগ্রাম দেখানো হয়েছে, এক স্ত্রীর সংগ্রাম দেখানো হয়েছে, সমাজের ঘৃণ্য মানসিকতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক মায়ের সংগ্রাম দেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে সৎ মানুষের জীবনসংগ্রাম, খারাপ মানুষদের হাত থেকে রেহাই না পাওয়া। খোদাভীরুতা এছবির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নবিতন যখন তার সংগ্রামের কথা কাউকে বলতে পারে না, যখন এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কাছে নবিতন তার প্রাপ্য সম্মান পায় না, সে তখন আল্লাহর কাছে এর সুবিচার চায়, তাকে এই অন্যায়, তার এই সীমাহীন অপমান, লজ্জা দেখে রাখতে বলে।

উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে “সারেং বৌ” এর গল্প মোটামুটি সবার কাছেই পরিচিত, তবুও যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে আমি একটু সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি। মূলত এটি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের গল্প। সারেং হলো সেসময় সমাজের অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা। সাধারণত লঞ্চ, জাহাজ, স্টিমারের মতো নৌপরিবহন চালনাকারীদের সারেং বলা হয়। সেরকম একজন হলেন আমাদের “কদম সারেং” (ফারুক)। জাহাজে কাজ করে অনেক দিন পর কদম সারেং ফিরে আসে তার নিজ বাড়িতে, তারপর ভালবেসে বিয়ে করে “নবিতন”কে (কবরী)। বিয়ের কিছুদিন পরে কদম সারেং আবার চলে যায় জাহাজের কাজে, কদম চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝেই নবিতনের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠায়। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী “মোড়ল” (আরিফুল হক) ডাক পিয়নকে হাত করে সেইসব চিঠি ও টাকা নিয়ে নেয়, যাতে করে নবিতনের সংসারে অভাব চলে আসে। আর এই অভাবের সুযোগে নবিতনকে তার লালসার শিকার বানাতে চায়। কিন্তু নবিতন নিজে গায়ে খেঁটে ঢেঁকিতে ধান বেঁনে কোন মতে সংসার চালায়।

এদিকে কদমের সহকর্মী “মন্টু চাচা” (গোলাম মোস্তফা) পকেটে অবৈধ মাল পুরে দিলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, সাজার মেয়াদ শেষ হলে অনেক বছর পর সে ফিরে আসে নিজ গ্রামে। ততদিনে চক্রান্তকারী মোড়ল কদমের চাচাতো ভাইয়ের সাথে নবিতনের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু কদম ফিরে আসাতে সব ঠান্ডা হয়ে যায়, খুশিতে বুক ভরে ওঠে নবিতনের। কিন্তু ফিরে আসার পর ঘরের কিছু আসবাবপত্র না পেয়ে নবীতনকে জেরা করা শুরু করে কদম, কেন সে এগুলো বিক্রি করলো, কদম যে মাসের পর মাস টাকা পাঠিয়েছে সে টাকা গেলো কোথায়? একসময় কদম সারেং জানতে পারে, তার সারেং বাড়ীর বৌ চৌধুরী বাড়ীতে গিয়ে বান্দীগিরি খেটেছে (খাবারের বিনিময়ে কাজ)।

পরবর্তীতে কদম লক্ষ করে তার স্ত্রী অন্তঃস্বত্তা, তাদের দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীতে আসছে। কদম জিজ্ঞেস করে সে কেন চৌধুরী বাড়ীতে গিয়ে বান্দীগিরি খাটলো। এই সন্তান কোথা থেকে আসলো। নবিতন উত্তর দিতে পারে না। সে কীভাবে বোঝাবে, এতোবছর সে শুধুমাত্র কদমের জন্য অপেক্ষা করে গেছে, কীভাবে বোঝাবে সে টাকা তো দুর… এতোবছর কদমের কোনো চিঠিও তার কাছে আসেনি, সে কীভাবে বোঝাবে তার লেখা কোনো চিঠি কদমের নিকট যায়নি, সে কীভাবে বোঝাবে পেটের দায়ে এবং একমাত্র মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তাকে কাজ করতে হয়েছে, সে কীভাবে বোঝাবে এই লোভী সমাজ তার শরীর ভক্ষণের জন্য রাতের বেলা দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে বলেছে। এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর তার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। যার জন্যে সে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে কাটিয়েছে, সে যদি নবিতনের মনের কষ্ট বুঝতে না পারে, নবিতনের তখন দুঃখের সীমা থাকে না।

এভাবে নানাঘটনায় অতিবাহিত হল কিছুদিন, হঠাৎ একদিন তীব্র বাতাসের গণগণে শব্দে আতঙ্কিত উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ, এ’যেন জলচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস! শুরু হলো উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের তড়িগড়ি, প্রলয়নকারী ঘূর্নিঝড় ও জলচ্ছ্বাসে বেঁচে থাকার সব আশা। দীর্ঘ ঘূর্নিঝড় ও জলচ্ছ্বাসের পর সব কিছু থমেথমে অবস্থা, চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, মানুষ, পশুপাখি কারোরই রক্ষা হয়নি এই দুর্যোগে-দুর্ভোগে, শুধু বেঁচে ছিল দুইজন।কদম সারেং এর শরীরের বেশিরভাগ কাদামাটি ও বালির ভিতরে আটকে গেছে, আর পানি পানি করে কাতরাচ্ছে। এদিকে নবিতনও একই অবস্থা থেকে উঠে খুঁজছে আপনজনদের। হঠাৎ শুনতে পেল কেউ পানি খেতে চাইছে, কাছে গিয়ে দেখল তার স্বামী!

 

হাতে করে পানি এনে খাওয়ানোর চেষ্টা করে নবিতন। কিন্তু আহত শরীর দিয়ে পানি মুখের কাছে আনতেই সব পানি মাটিতে পড়ে যায়। অতঃপর না পেরে, কদমকেই সে টেনে নিয়ে গেল পানির কাছে, পানি মুখে দিতেই মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে কদম। নবিতন নিজেই একটু পানি মুখে দিয়ে দেখল এগুলো নোনাপানি। স্বামীকে বাঁচানোর কোন উপায় না দেখে, মাতৃত্বকে জাগিয়ে স্বামীকে দুধের শিশুর মতো বুকে জড়িয়ে নবিতন নিজ স্তনদ্বয় থেকে দুধ পান করালো। স্বামী কদম চোখ মেলে দেখে চমকে উঠে বলে- নবিতন তুই আমারে পর কইরা দিলি? তুই জানোস না এতে স্বামী পর হয়া যায়? নবিতন বললো- না, জান বাঁচানো ফরজ! জান বাঁচাতে হলে যেকোনো কিছুই করা যায়, তখন কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করতে হয় না।

“সারেং বৌ” এর মাধ্যমেই এ চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা দর্শকের মণিকোঠা জুড়ে বেঁচে থাকবে চিরদিন। আর কয়দিন পর এই চলচ্চিত্র মুক্তির ৪৩ বছর পূর্ণ হবে৷ ইউটিউবে লেজার ভিশনের চ্যানেলে খুবই দুর্বলমানের একটি প্রিন্ট আপলোড দেয়া আছে, মাত্রাতিরিক্ত কাটাকাটি করা। সেটি দেখতে গেলে এছবি নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে।

এক নজরে –
নামঃ সারেং বৌ (১৯৭৮)
ধরণঃ সারভাইভাল
পরিচালনাঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন
অভিনয়ঃ কবরী, ফারুক, আরিফুল হক, গোল


Leave a reply