Select Page

ওথেলো ও কদম মাঝি-নবিতুন

ওথেলো ও কদম মাঝি-নবিতুন

সারেং বৌ’ উপন্যাসটি পড়তে শুরু করেছিলাম প্রায় ২৫ বছর আগে। কেন যেন পড়তে তখন মন বসেনি, পড়াও শেষ করা হয়নি। ছবিটি দেখতে বসে ছিলাম পনেরো বছর আগে, তাও তখন খুব একটা ভালো লাগেনি।

সেদিন প্রথমার বই মেলায় গিয়ে ‘সারেং বৌ’র ইংরেজি অনুবাদটি কিনলাম ৫০%  কমিশনে। ৪০%  কমিশন হলেও হয়তো কিনতাম না, এবং তাতে করে আবার কবে এই বিস্ময়কর শিল্পের মুখোমুখি হতাম জানি না।

শীঘ্রই আমি মূল বাংলা উপন্যাসটি পড়বো। এবং পরে উপন্যাসটি নিয়ে বিস্তৃত কিছু লিখব আশা করি। কিন্তু এখন কদম সারেং-এর সাথে ওথেলোর তুলনা করে কিছু কথা বলতে চাই। কোথায় যেন এ দুজনের একটা মিল আছে।

কদম নবিতুনের স্বামী। কদম ভালোবেসে বিয়ে করেছিল নবিতুনকে। যেমনটা ওথেলোও ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ডেসডিমোনাকে। বিয়ের পর ডেসডিমোনাকে ছেড়ে যেমন দূর দেশে চলে যায় ওথেলো, তেমনি নবিতুনকে ছেড়ে দূর সমুদ্রে কাজে চলে যায় কদম সারেংও।

ওথেলোর চলে যাওয়ায় ডেসডিমোনার কোনো আর্থিক কষ্ট হওয়ার কথা নয়, কারণ সে ভেনিসের সিনেটরের কন্যা। ওথেলো ফিরে এসেছিল শীঘ্রই, কিন্তু কদম বহু বছর নিরুদ্দেশ। বিদেশ থেকে টাকা পাঠালেও সে-টাকা আত্মসাৎ করে ফেলে গ্রামের ক্ষমতাশালী লোক লন্দুর মোড়ল। পোস্টমাস্টারকে হাত করে কদমের পাঠানো টাকা ও চিঠি লুকিয়ে ফেলে মোড়ল। চরম অভাবে পড়ে নবিতুন। মোড়ল মনে করে অভাবে পড়ে নবিতুন তাকে বিয়ে করবে। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এক ‘গুজা বুড়ি’কে বারবার নবিতুনের কাছে পাঠায় মোড়ল। নবিতুন প্রতিবারই সেই বুড়িকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

জীবন সংগ্রামে নবিতুন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে যায়, তবু কারো কাছে মাথা নিচু করে না, অপেক্ষা করে স্বামী একদিন ফিরে আসবে।

একদিন কদম ফিরে আসে। কিন্তু তার সুখের সংসারে আগুন লাগিয়ে দেয় সেই লন্দুর মোড়ল। মিথ্যে কথা বলে কদমের কান ভারী করে, আর নবিতুনের চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে দেয়। আশ্চর্য ব্যাপার এই, কদম তা বিশ্বাসও করে। যেমনটা বিশ্বাস করেছিল ওথেলো ডেসডিমোনাকে দেয়া ইয়াগুর অপবাদ।

সন্দেহের বশে ডেসডিমোনাকে ওথেলো হত্যা করে।‌ হত্যার পর পরই ওথেলো জানতে পারে ডেসডিমোনা নির্দোষ। সবই ইয়াগুর চক্রান্ত। নিজেকে হত্যার মধ্য দিয়ে ওথেলো তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।

কদম মাঝিও নবিতুনকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলো।‌ নবিতুনকে বাঁচিয়ে দেয় প্রকৃতি। এখানে এসে উপন্যাসের সাথে ছবিটির কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ছবিতে দেখা যায় নবীতুনের গায়ে লাথি মারার মুহূর্তে আকাশের দেবতা চমকে উঠে, শুরু হয় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস। অন্যদিকে উপন্যাসে দেখা যায় কদম আবার বিদেশে চলে যেতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের সৃষ্টি হয়।

যাইহোক, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পুরো অঞ্চলটি জলে ভেসে যায়। বেঁচে থাকে কেবল কদম আর নবিতুন। আদম হাওয়ার মতো নতুন করে জন্ম হয় তাদের।

এখানে উল্লেখযোগ্য যা, মৃতপ্রায় কদমকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচায় নবিতুন। এবং কেবল এই দৃশ্যটির জন্য পুরো উপন্যাসটি বা ছবিটি অসামান্য এক শিল্প হয়ে ওঠে।

ওথেলো নাটকের নায়ক ওথেলো, ভুলের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেয়ার জন্য ওথেলোর জন্য আমাদের করুণা হয়, কিন্তু সারেং বৌ উপন্যাসের নায়ক নবিতুন। শেষ পর্যন্ত নবিতুনের জন্য অবশ্য আমাদের করুণা হয় না, বরং গৌরব হয়, পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে এমন লড়াকু নারী বিরল।

এখানে একটা কথা বললে দৃষ্টতা প্রকাশ হতে পারে, হয়তো তা ৪০০ বছর সময়ের ব্যবধানের কারণেই, ‘ওথেলো’র তুলনায় ‘সারেং বৌ’ অনেক বেশি শিল্পগুণ সম্পন্ন। ভুল বোঝার পর ওথেলোর আর্তনাদ আর আত্মহতি ছাড়া ওথেলো পুরো নাটকটিই ক্লান্তিকর। তা ছাড়া ওথেলো কেন ইয়াগুর কথা এমন অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। শুধুমাত্র একটি রুমাল হারানোর কারণে স্ত্রীকে এমনভাবে হত্যা করা একটু অতি- নাটকীয় বটে। অন্যদিকে শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাসটি অনেক বেশি সংযত। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি যে প্রাকৃতিক তাণ্ডব সৃষ্টি করলেন তা অভিনব। সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে দুনিয়াকে তিনি আবার নতুন করে গড়তে চেয়েছিলেন।

এটা শুধু ৪০০ বছর ব্যবধানে দুজন সাহিত্যিকের পার্থক্য নয়, এটা পৃথিবীর দুটো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার পার্থক্য, দুটো দর্শনের পার্থক্য।

‘ওথেলো’ কেবল ট্রাজেডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু ‘সারেং বৌ’ এক নতুন দিনের দিশা দেখায়।

আব্দুল জব্বারের গাওয়া অবিস্মরণীয় গানটির জন্য ছবিটি বিখ্যাত, কিন্তু ছবিটি তার নিজ গুণেই বিখ্যাত হওয়া উচিত।‌ যদিও ছবিটির নির্মাণ অত্যন্ত দুর্বল। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’ বানানোর প্রায় ১০ বছর আগে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি বানিয়েছিলেন জহির রায়হান। নির্মাণগত দিকের তুলনা করলে ‘সারেং বৌ’র তুলনায় ‘জীবন থেকে নেয়া’ অনেক বেশি শক্তিশালী ছবি।  যাই হোক, তারপরও যে আব্দুল্লাহ আল মামুন  সে- সময় ছবিটি নির্মাণ করেছেন এটা একটা অসামান্য  ব্যাপার।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কামরুল আহসান

লেখক, গবেষক ও নাট্যকার

মন্তব্য করুন