Select Page

কমন খাসলতের তালাশে আনকমন ‘আদিম’

কমন খাসলতের তালাশে আনকমন ‘আদিম’

দলনেতার হাতে দাড়ি-গোঁফ উঠছে উঠছে বয়সী মোবাইল চোর মাইর খায়, এবং রাগে-অপমানে লাল হয়ে পরিত্যক্ত একটা জায়গায় আসে। মনের শান্তির দরকার তার, অথবা প্রতিশোধের পরিকল্পনার জন্য নিরিবিলি জায়গা। কিন্তু আগে থেকে বসে আছে এক পাগলা ও কুকুর। পাগল লোকটা মনের সুখে কুকুররে রুটি খাওয়াচ্ছে। অনেকক্ষণ ‘মায়া-মমতা’র এই আদিখ্যেতা দেখে কিশোর চোরের সহ্য হইল না। কুকুরটারে লাত্থি মেরে বিদায় করল। তবুও কিশোররে কিছু বলে না পাগল। বরং প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকায়। সময় গড়ায়ে যায়, মোবাইল চোর বিড়ি বা কোনো মাদক টানছে, পাগলটা আগের জায়গায় বসে আছে। এক সময় ও গিয়ে পাগলরে বিড়ি অফার করে। এরপর দুজনে মিলে টানতে থাকে।

পুরো দৃশ্যটার মধ্যে কুকুরের কান্নার শব্দ ছাড়া কোনো সংলাপ নাই। ‘আদিম’ সিনেমার এই দৃশ্য দুইবার দেখা হইছে আমার। ছবির এই অংশের সঙ্গে মূল গল্পের তেমন সম্পর্ক নাই। আবার টঙ্গী রেল স্টেশন কেন্দ্রিক সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে সংগতি বিধানের চেষ্টা আকারেও দেখা যায়। এই দৃশ্যে আমি ভীষণ মুগ্ধ। আর সবকিছু বাদ দিলেও সংলাপহীন এই দৃশ্য ‘আদিম’ সিনেমাকে সুউচ্চ একটা জায়গায় রাখবে। হয়তো একটা দৃশ্য দিয়েও একটা সিনেমারে সিনেমা হিসেবে বিবেচনায় রাখা যায়। ‘আদিম’ সেই অমূল্য রতনের দেখা পাইছে।

‘আদিম’ এমনিতেই ইউনিক জায়গায় থাকবে। যেখানে এমন একটি স্থান-কাল ও মানুষরে উসিলা করে গল্প তুলে ধরা হইছে; যা বাংলা সিনেমায় আপনি পাবেন না। আবার পাইলেও ‘আদিম’-এর মতো করে পাইবেন না। বাণিজ্যিক ও আর্ট ঘরানার বিভাজনের মাঝে এই সব মানুষের কিছু গল্প আছে। কিন্তু টাইপ বা ধরন বিবেচনায় ক্লিশে গল্পের পুনরাবৃত্তি করে নাই ‘আদিম’। ওই ক্লিশেপনার উদ্ভব সিনেমা থেকে সমাজে নাকি সমাজ থেকে সিনেমায়- এই মুশিবিদা একটু গোলকধাঁধা হইতে পারে। এবং মনে হইতে পারে বাস্তবিক যা ঘটে তার পুনরুৎপাদন আছে এবং নির্মাতা শ্রেণীগত চালু বায়াসনেসগুলো এড়ায়া যেতে পারছে।

এই ভাবনার ভেতর একটা জটিলতা হইলো, সিনেমা বা আরো বড় পরিসরে সিনেমারে ‘বাস্তবতার’ চিত্র বইলে একটা ফাঁদ তৈয়ারের চেষ্টা। সিনেমারে আর সিনেমা থাকতে না দেয়া। বাস্তবতার যে হলিস্টিক অবস্থা সেটা মোটামুটি অনির্ণিত, টুকরো আকারে যতটুকুর স্বাদ আমরা পাই, তারেই তো পুরো ফল মনে হয়। সেই আলাপও আপাতত দরকার নাই। কিন্তু নির্বাচিত, বারবার লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মাধ্যমে ঝকঝকে তকতকে যেই ছবি, তা বাস্তবের প্রতিরূপ যদি হয়, আর বাস্তবকে যদি আমি এমনিতেই দেখি; আসলে তারে দেখাটা কেন দরকার? সিনেমার পর্দায়। অথবা টিভি বা ওটিটিতে।

বরং এই সিনেমা এমন কিছু ইমোশনকে ডিল করছে বা ভাষা দিছে; যাকে আমরা এভাবে ভাবতে পারি না সাধারণত। ‘আদিম’ শব্দটা স্রেফ বস্তির বাসিন্দাদের মাঝে আটকে রাখারও মানে হয় নাই। আদ্যিকাল থেকে মানুষের যে খাসলত বিদ্যমান হিসেবে আমরা জানি, সেই জায়গা থেকে দেখাটাই ভালো। যদি স্থান হিসেবে বস্তি বা রেল স্টেশনকে দেখি, কিন্তু মানুষ আকারে সেখানকার বাসিন্দাদের আসলে রাখা যায় না। বরং মানুষকে কোনো একটা পাত্রে রেখে দেখার একটা চেষ্টা আছে। এমনও হতে পারে, এই গল্প উঁচা উঁচা দালানের মানুষের ভেতর দিয়ে দেখাতে গেলে বিভীমিষা তৈয়ার হয়, শ্বাসকষ্ট হইতে পারে। এটা বোধহয় এড়ানো গেল। ফলে গরিবের খালি খাদ্য আর যৌনতা লাগে, এই সিনেমার আলাপ তা না। এই সিনেমায় অভাব-অনটন অর্থে যতটুকু গরিবি, ততটুকু ঘি-মধুর দাম বাড়লে অন্য ক্লাশেও দেখি।

সোহাগীর প্রতি ল্যাংড়ার আকর্ষণ সিনেমার গল্পরে টেনে নিয়ে গেছে। ল্যাংড়াকে মূল চরিত্র হিসেবে হাজিরও করে। তার ভেতর খল একটা বিষয় আছে বটে; আবার সেটারে নাই করে দিয়ে সোহাগীর সঙ্গে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখে। মানে, আগে যা যা ভুল, তা মানুষ যেভাবে ঠিক করতে চায়; তেমন স্বপ্ন দেখে। এবং আমাদের প্রতিটা অপরাধ যেভাবে ভুল সেভাবে সে শুধরাতে চায়। ঠিক সোহাগীর প্রতি শরীরী টান সেটাকে অস্বীকার না করলেও এমন না পুরোপুরি; ছবির শেষ দিকে আবার যখন রেল স্টেশনে ফিরে আসে- এভাবে তো আসার কথা না; তার ভেতর যে-ই আর্তি ও অসহায়তা দেখা যায় তাকে আমরা ‘বাস্তব’ বলে ব্যাখ্যা করতে পারি না এই বলে যে, এই ঘটনার ভেতর মানুষ তার জটিলতাকে এমন স্তরে প্রকাশ করে, যার কারণে সে শুধু ‘মানুষ’ই হয়ে উঠে। যার অন্য একটা মানুষ দরকার। এখানে মানুষ এক ও আদিম। যেখানে তাকে বিচার করতে হয় সহানুভূতি দিয়ে। ল্যাংড়া এই ভেঙে পড়ারে গভীরতরভাবে তুলে ধরেছেন যুবরাজ শামীম। ল্যাংড়ার পরিণতি যতটা না তার ওপর অন্য মানুষের ক্ষোভজাত, তার চেয়ে মনে হয় এই অনির্ণিত পরিস্থিতিকে ডিল করার আর ঝুঁকি নিতেছেন না পরিচালক। একই স্বস্তি দর্শকের মনেও উদ্রেক হইতে পারে।

এখানে একটা স্বপ্নের দৃশ্য আছে; যেখানে ল্যাংড়া দেখে সোহাগী বউ সেজেছে। পর মুহূর্তে সে বলে, আমি তো কালোর বউ। ল্যাংড়া ঘুম ভাঙতেই বেদিশা হয়ে পড়ে। আর আবহে শোনা যায়, সঙ্গী খুঁজতে থাকা বিড়ালের কান্না। নির্মাণের নাটকীয়তা আছে বটে। যে নাটকীয়তা জীবনে আমরা রাখি না। এখানে সিনেমা বাস্তব কিনা সেই প্রশ্ন বাদ দিয়ে আরো বড় কিছুর সঙ্গে এক হতে চায়। যে জীবন মানুষের, তা কুকুর-বিড়ালেরও। এই রকম একটা অবস্থার ভেতর মানুষকে তার বাইরে সকল অবস্থার ভেতর বিবেচনা করতে হয়।

তবে এ সিনেমার যে বিষয়টা একটু অদ্ভুত; সেটা বলার আগে আরেকটা কথা নিই, সোহাগীর চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আরেকটু ডিটেইলস থাকতে পারত এবং এত হইহই কাণ্ড ঘটার পরও পাশের ঘরের বুড়ি যখন জিগাসা করে, বউয়ের সঙ্গে কালা কোনো ঝামেলা হইছে কিনা, এটা নির্মাতার বড়সড় অসাবধানতাকে সামনে আনে।

যা বলছিলাম, সোহাগীর চলে যাওয়া আবার ফিরে এসে স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করার বিষয়টা এতই স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য যে, এই ধরনের ঘটনায় যে সোশ্যাল ক্রাইসিস তৈরি হয় বলে অনুমান করা যায়, তাকে একদম ভিন্ন ডাইমেনশনে দেখা গেছে। এই যে ভুল ও তার শুধরে নেয়ার যে ভাবনাটা তা অনেক কিছু সহজ করে দেয়। অথবা এমনও হতে পারে, আরেকটু ভালো অপশন পেলে সোহাগী আবার চলে যাবে। কিন্তু এখানে সোহাগী বা তার স্বামীর মাঝে কোনো ডিলেমা নাই কেন? এতটা সহজে জীবনের বড় জটিলতাকে সামলে উঠা সহজ না আসলে। সম্ভবত মানুষের নির্ভরশীলতার জায়গা এমনই। প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেয়া। এই সহজতার হদিস ততটা ডিটেইলস নাই; বাট কনভিন্সিং।

একইসঙ্গে পুরো গল্পের ভেতর রাজনীতি বা ধর্মের সরাসরি উপস্থিতি নাই। রাজনৈতিক অনুপস্থিতির মাধ্যমে এও দেখানো হয়েছে, নাগরিক হিসেবে কোনো ধরনের মর্যাদা ছাড়াই রাষ্ট্র এই সব মানুষদের কোথায় রেখেছে। এবং এখানকার যাবতীয় অপরাধপ্রবণতার দায়ও রাষ্ট্রের। বস্তিকে স্রেফ অপরাধের আখড়া বলে ঘৃণাই ছড়ানো হয়। ‘আদিম’ সেই চেহারাটা খুলে দিয়েছে। আর ভক্তিবাদ অর্থে এক ধরনের ধর্মের উপস্থিতি আছে। সেটা বেশ সুন্দরভাবে উঠে আসছে। এবং মোটের ওপর কনভিন্সিং একটা জায়গায় থাকা গল্প নিয়ে কোনো আক্ষেপ নাই। একই কারণে সিনেমাটা আমাদের জীবনের উপরিতলের সঙ্গে ডিল করতে গিয়ে ইউনির্ভাসল কোনো খাসলতের অনুসন্ধান করে; তার তল কতটা পায় তা আমরা দেখি। এবং এই গল্প এভাবে না বললে হয়তো বলাই হতো না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বিএমডিবির সহপ্রতিষ্ঠাতা

মন্তব্য করুন