Select Page

বটবৃক্ষ বুঝি এমনি হয়!

বটবৃক্ষ বুঝি এমনি হয়!

প্রতিদিন সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়। ঠিক তেমনি প্রতিদিন প্রিয়জন/গুণীজনের মৃত্যুর সংবাদ শোনা এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের শোক সংবাদের কাছে গতকালের সংবাদ ফিকে হয়ে যায়। স্মৃতিকণায় ধুলো জমতে থাকে। তবে কখনো এমনো হয়, কিছু মহীরূহের চলে যাওয়া মেনে নিতে সময় লাগে। ক্ষণে ক্ষণে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বারংবার দোয়া নিঃসৃত হয়। শ্রদ্ধেয় আলী যাকের তেমনই এক বটবৃক্ষ; তার প্রয়াণ তেমনই দাগ ফেলবার মত একটি বিশেষ ঘটনা আমাদের সবার জন্য।

আমি অতি ক্ষুদ্র একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। আমার এই গুণী জনের সাথে খুব বেশি যে স্মৃতি রয়েছে, তা নয়। সে যোগ্যতাও কখনো আমার হয়নি। তবে ভাবতে ভালো লাগে, শ্রদ্ধেয় আলী যাকের এবং আমি একই কলেজে (নটরডেম) শিক্ষা লাভ করেছি। তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখাও নটরডেম কলেজে, ১২ নভেম্বর ১৯৯৯। কলেজের ৫০তম সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে আলী যাকের এসেছিলেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় থেকে ‘অচলায়তন’ নাটক নিয়ে। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তিনি দলের সঙ্গে অভিনয় করবেন আর আমি তৎকালীন ছাত্র হিসেবে নটরডেম সাংস্কৃতিক ক্লাবের সভাপতি হয়ে অন্য এক পরিবেশনায় কবিতা আবৃত্তি করবো। সাজঘরে দীর্ঘাঙ্গী আলী যাকেরের সাথে সেদিনই প্রথম দেখা হয়েছিল। সেদিনই প্রথম কোনো তারকার অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। জানিয়েছিলেন, ’৬২ সালে এইচএসসি পাস করেছিলেন। আমার তুলনায় বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় কত এগিয়ে। অথচ মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে আমার ঠিক বিপরীত চেয়ারে বসে এমন বিনয়ী কণ্ঠে কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিলো আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। যেন দুজনেরই একই পরিচয়: শিল্পী।

ঠিক তার ৬ মাস পর আবারো দেখা হয় তাঁর সাথে। নওরতন কলোনীতে এশিয়াটিকের অফিসে। নটরডেম কলেজ সাংস্কৃতিক ক্লাব তখন ১২টি কলেজকে নিয়ে ১ম সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করেছিল। এশিয়াটিকের ব্র্যান্ড ক্লোজআপ টাইটেল স্পন্সর ও পেপসি বিশেষ স্পন্সর হিসেবে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। উৎসবের বিশেষ ম্যাগাজিন ‘শাশ্বত’র জন্য এশিয়াটিক প্রধান আলী যাকের স্যারের মুখবন্ধ প্রয়োজন। কিন্তু তিনি নিজে লিখতে চাইলেন না। আমাকে তার কার্যালয়ের টপ ফ্লোরে নিজের রুমে ডেকে বললেন, ‘আপনি আমার হয়ে লিখুন। কিছু সময়ের জন্য আলী যাকের হয়ে যান। পছন্দ না হলে আমি তো আছিই’। প্রায় ১৫ মিনিট সময় নিয়ে আমি কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছিলাম, ‘আলী যাকেরের বাণী’। ভাবতে ভালো লাগে, আলী যাকের স্যার সেদিন আমার ৫৫০ শব্দের লেখায় নিজের স্বাক্ষর ছাড়া আর একটিও কলমের আঁচড় ফেলেননি।

২০০৫ সালের রোজার ঈদের পর দৈনিক প্রথম আলোতে আমার লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘নাটকের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন’। পরবর্তী সপ্তাহে অন্য আরেকটি প্রতিবেদন (এবার ঈদে কার কোন নাটক ভালো লেগেছে) তৈরির জন্য আলী যাকের স্যারকে আমি কল করি। সেদিনই তার সাথে আমার ফোনে প্রথম কথা। আমাকে বা আমার নাম মনে রাখার কোনো কারণ নেই তার। কিন্তু আমি যখন আমার পরিচয় দিলাম, পর মুহূর্তেই তিনি অবাক করে বললেন, ‘আমি আপনার লেখা পড়েছি। নাটকের সৌজন্যে বিজ্ঞাপন-লেখাটি খুব ভালো হয়েছে।’-বিজ্ঞাপন সংস্থার একজন মহারথী এরপর আমার লেখা নিয়ে তার বিশ্লেষণমূলক নানান কথা শেয়ার করেন। কেন জানি সে মুহূর্তে মনে হয়েছিল, জীবন সার্থক। আলী যাকেরের মত একজন আমার মত অতি ক্ষুদ্র লেখকের লেখা এত মনোযোগ দিয়ে পড়েন! তাও সেটি নিজ মুখে স্বীকার করেন! বটবৃক্ষ বুঝি এমনি হয়!

২০০৯ সালের ঈদে আলী যাকের-অপি করিম অভিনীত একটি নাটক দেখে আমি থমকে যাই। নাটকের নাম ‘একবার মুগ্ধ হতে চাই’। কারণ নাটকের বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল মতিঝিল এজিবি কলোনীতে। শুধু তাই নয়, যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আলী যাকের-অপি করিম সংলাপ বিনিময় করেন, সে বাড়ির ৪ তলাতেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা! প্রকৃতি এভাবেই কিছু রহস্য বা কাকতাল ঘটনায় জড়িয়ে মানুষকে মুগ্ধ করে, চমকে দেয়।

আমি যেমন চমকে গিয়েছিলাম গত বছরের ১০ এপ্রিল আলী যাকের স্যারের বাসায় গিয়ে। আমার কর্মস্থলের সাথে লাগোয়া তাঁর বাসভবন। ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’-এর আজীবন সম্মাননার চিত্রধারণের উদ্দেশ্যে আমরা ক’জন তাঁর বাসা ও ছাদে গিয়েছিলাম। ছাদ থেকে বনানী কবরস্থানের শত-শত কবর দেখা যাচ্ছিলো। আমি আপন মনে মুঠোফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিলাম। পাশ থেকে আলী যাকের স্যার এসে বলেন, ‘কিরকম গা ছমছমে অনুভূতি হয়, তাই না? একদিন ওখানেই মিলিয়ে যেতে হবে আমাদের।’ এরপর তিনি বেশ কিছু গল্প শোনালেন চিত্রধারণের ফাঁকে। অনুরোধ করেছিলাম, একদিন মাছরাঙা টেলিভিশনের স্টুডিওতে ক্যামেরার সামনে সেসব গল্প শুনতে চাই। তিনি বলেছিলেন, শরীর সমর্থন করলে অবশ্যই আসবেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং অক্টোবর-নভেম্বরে ইরেশ যাকের ভাইয়ের সহযোগিতায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের শ্রদ্ধেয় এমডি স্যার অঞ্জন চৌধুরীও সর্বাত্মক আন্তরিকতা দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাঙা সকাল’ অনুষ্ঠানের জন্য স্টুডিও থেকে বেরিয়ে ‘বিশেষ পর্ব’ হিসেবে তার বাড়িতে ধারণ করা যেতে পারে। যদি তাও সম্ভব না হয়, আমাদের অফিসে তাকে আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে আসবো। তিনি স্যারের ব্যক্তিগত রুমে বসে বিশ্রাম নেবেন। প্রয়োজনে আমরা সঞ্চালকরা তার থেকে ৩ ফুট নয়, ৬ ফুট দূরত্বে থাকবো। আমাদের নির্দিষ্ট সোফার পরিবর্তে তার ব্যক্তিগত হুইল চেয়ারেও ধারণ করা যেতে পারে। কথা ছিল, শরীর কিছুটা সুস্থ হলেই আমাদের অনুরোধ তিনি রাখবেন। তবে নিষ্ঠুর প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছিল অন্য চিত্রনাট্য। চলে গেলেন আলী যাকের-দ্য আলী যাকের।

বৃহস্পতিবার রাতে আলী যাকের স্যারের প্রতিবেশী তারিক আনাম খান-নিমা রহমান দম্পতির কাছেই শুনেছিলাম, আলী যাকের স্যারের শরীরে করোনা আক্রমনের কথা। অনুরোধ করেছিলাম, প্লাজমা বা কোনো ধরনের সহযোগিতায় যেন আমাকে স্মরণ করা হয়। নিমা ভাবী বলেছিলেন, অবশ্যই জানাবেন। শুক্রবার ভোর বেলাতে ইরেশ ভাইকেও হোয়াটস আপ করে অনুরোধ করেছিলাম, প্লাজমা লাগলে যাতে জানানো হয়। অপরপ্রান্ত থেকে কোনো রিপ্লাই আসেনি। তবে আধ ঘন্টা পর অন্য মাধ্যম থেকে জানতে পারি, দ্য আলী যাকের পবিত্র দিনে সুন্দর ভোরে আমাদের সবার মায়া ছেড়ে চলে গেছেন দূর আকাশে। অবশ্য মায়ার বাধন ছিন্ন করা কি অত সহজ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মুস্তাফা, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন ফরীদি, নায়ক রাজ রাজ্জাক সহ কিংবদন্তী অনেকেই তো এখনো আমাদের মাঝে বিরাজ করেন। আমাদের কাজে, আলোচনায়, স্মৃতিতে প্রতিনিয়তই তো তারা বেঁচে আছেন। আলী যাকেরের মত ক্ষণজন্মারাও অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতা, মহানুভবতা, বিনয়, শিক্ষা, মানব প্রেম, দেশপ্রেমের কল্যাণে। আমি নিশ্চিত, এক আকাশের অনেক তারার মাঝে আলী যাকের নামের তারাটি অবশ্যই জ্বলজ্বল করবে পৃথিবী বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

আকাশের ওপারে ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় আলী যাকের। আমরা সবাই সঙ্গী হতে আসছি, আজ অথবা আগামীকাল।


মন্তব্য করুন