Select Page

সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসার আদ্যোপান্ত

সেলুলয়েডে মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসার আদ্যোপান্ত

আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ বা এ প্রেক্ষাপট নিয়ে সিনেমা নির্মাণের শুরু চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ এর মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালের আগস্টে সদ্য স্বাধীন দেশে রিলিজ পাওয়া সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল স্বরূপ। একই বছরের ৮ নভেম্বর মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত বহুল প্রশংসিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’।

আগুনের পরশমণি ছবির দৃশ্য

দেশ স্বাধীনের ঠিক এক বছর পর ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় ও চতুর্থ চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও ‘বাঘা বাঙালী’। পরিচালনায় যথাক্রমে মমতাজ আলী ও আনন্দ। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ ও আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’। ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ তিন বছরে মোট দশটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল।

১৯৭৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কোনো সিনেমা রিলিজ পায়নি বলেই জেনেছি। ১৯৭৬ সালে ‘মেঘের অনেক রং’ নামের একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন পরিচালক হারুনর রশীদ। ৫ বছরের বিরতি দিয়ে ১৯৮১ সালে ‘কলমীলতা’ নামের একটি আলোচিত সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন নির্মাতা শহীদুল হক খান। লম্বা বিরতি দিয়ে হারুনর রশীদ পরিচালিত ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’ নামের একটি সিনেমা বানান, একই বছরে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত ‘একাত্তরের যিশু’ রিলিজ পায়। নন্দিত এই চলচ্চিত্রটি প্রশংসা কুড়ায় বোদ্ধা দর্শকদের।

ওরা ১১ জন ছবির দৃশ্য

তবে ১৯৯৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার আলোকে নির্মিত একটি সিনেমা সাধারণ দর্শকদের মাঝে আলোড়ন তুলেছিল। ‘আগুনের পরশমণি’ নামের ক্ল্যাসিক সিনেমাটি বানিয়েছিলেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ। একই বছরে ‘সিপাহী’ নিয়ে কাজী হায়াৎ হাজির হয়েছিলেন দর্শকদের সামনে।

১৯৯৬ সালে আরেক গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল বানিয়েছিলেন ‘নদীর নাম মধুমতি’ নামের অসাধারণ চলচ্চিত্র। তবে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করা চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে আমাদের উপহার দেন আরেকটি কালজয়ী সিনেমা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। একই বছরের আরেকটি সুনির্মিত সিনেমা খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘এখনো অনেক রাত’।

১৯৯৯ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যরকম এক বিষয়বস্তু স্ক্রিনে নান্দনিকভাবে উঠে এসেছিল। ২০০২ সালে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ আমাদের চলচ্চিত্রকে নিয়ে যায় অস্কার আয়োজনে। প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইট আয়োজনে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে ফিপরেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচকদের পুরস্কার লাভ করে। যা দেশের স্বাধীনতা এবং ত্যাগের প্রতি সম্মানের বিষয়।

হাঙর নদী গ্রেনেড

মাঝে বাণিজ্যিকভাবে রিলিজ না দেয়া বেশকিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য বা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ হলেও ২০০৪ সালে ‘মেঘের পরে মেঘ’ নামের আরেকটি আলোচিত এবং প্রশংসিত সিনেমা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। একই বছরে দশ বছর পরে আবারো একটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প নিয়ে হাজির হন হুমায়ূন আহমেদ ‘শ্যামল ছায়া’ সিনেমার মাধ্যমে। নব্বই দশকের অন্যতম আলোচিত এবং প্রশংসিত অভিনেতা তৌকির আহমেদ হাজির হন তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ নিয়ে। শূন্য দশকে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প নিয়ে নির্মিত অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে ‘জয়যাত্রা’ একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নেয় এর নির্মাণগুণে। ২০০৬ সালে চাষী নজরুল ইসলাম ‘ধ্রুবতারা’ নামে আরো একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। মোরশেদুল ইসলাম হাজির হন ’খেলাঘর’ নামের আরেকটি সিনেমা নিয়ে।

২০০৭ সালে তরুণ নির্মাতা খিজির হায়াত খান ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ বানিয়ে প্রশংসা কুড়ান। একই বছরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যরকম এক গল্প স্ক্রিনে হাজির করেন আরেক প্রশংসিত নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। ‘স্পার্টাকাস৭১’ নামের টিভি ফিকশনটি ব্যাপক প্রশংসা পায় দর্শকদের কাছ থেকে।

২০১০ সালে মুশফিকুর রহমান গুলজার বানিয়েছিলেন ‘নিঝুম অরণ্যে’। তানভীর মোকাম্মেল উপহার দেন সুনির্মিত ‘রাবেয়া’। তবে গত এক যুগের হিসেব যদি করা হয়, তবে ২০১১ সালে রিলিজ পাওয়া দুটি ক্ল্যাসিক তকমা পাওয়া সিনেমা এ প্রজন্মের মনেও জায়গা করে নেয়। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত ‘গেরিলা’র প্রশংসার পাশাপাশি কিশোরদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। পাশাপাশি বদরুল আলম সৌদের ‘খন্ডগল্প ১৯৭১’ এবং রুবাইয়াত হোসেনের পরিচালনায় ‘মেহেরজান’ সাড়া জাগায় আন্তর্জাতিক নানা ফেস্টিভ্যালে।

২০১২ সালে মাসুদ আখন্দের ‘পিতা’ এবং ২০১৩ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবন ঢুলি’, মিজানুর রহমানের ‘৭১ এর গেরিলা’ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমা হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৪ সালে রিলিজ পায় জাহিদুর রহমান অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’, গোলাম মোস্তফা শিমুলের ‘অনুক্রোশ’ ও শাহ আলম কিরণের ‘একাত্তরের মা জননী’। ২০১৫ সালে মোরশেদুল ইসলামের ‘অনিল বাগচীর একদিন’, সোহেল আরমানের ‘এইতো প্রেম’, মানিক মানবিকের ‘শোভনের স্বাধীনতা’, সুমন ধরের ‘অমি ও আইসক্রিম’ মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ভালো কাজ বলে জায়গা করে নিয়েছিল।

মেঘের অনেক রং

২০১৬ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, মুশফিকুর রহমান গুলজার ‘লাল সবুজের সুর’ এবং মান্নান হীরার ‘একাত্তরের সুর’ নামে মোট তিনটি সিনেমা রিলিজ পায়। ২০১৭ সালে রিলিজ পাওয়া ফাখরুল আরেফিন খানের ‘ভুবন মাঝি’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত অন্যতম আলোচিত কাজ। তাহের শিপনের ‘একাত্তরের নিশান’ নামের একটি চলচ্চিত্র একই বছরে রিলিজ পায়। ২০১৮ সালে আবির পরিচালিত ‘পোস্টমাস্টার ৭১’ নামের একটি সিনেমা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসেবে রিলিজ পায়। মাসুদ পথিক ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ নামের সিনেমা নিয়ে হাজির হন ২০১৯ সালে।

২০২০ সালে তানভীর মোকাম্মেলের ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ সুনির্মিত চলচ্চিত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল। ২০২১ সালে তৌকির আহমেদের ‘স্ফুলিঙ্গ’ আলোচনায় আসে। একই বছরে হাবিবুর রহমানের ‘অলাতচক্র’, শাহরিয়ার নাজিম জয়ের ‘প্রিয় কমলা’, নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’ মুক্তি পায়।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসেবে ২০২২ সালে মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘আশীর্বাদ’, মিজানুর রহমানের ‘৭১ এর একখন্ড ইতিহাস’, এম সাখাওয়াতের ‘বীরাঙ্গনা ৭১’ ও রায়হান রাফীর ‘দামাল’ রিলিজ পায়। ২০২৩ সালে খিজির হায়াত খানের ‘ওরা ৭ জন’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রণক্ষেত্রের গল্প বলে ভিন্ন এক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ফাখরুল আরেফিন খান ‘জেকে ১৯৭১’, অনন্য মামুনের ‘রেডিও’, পঙ্কজ পালিতের ‘একটি না বলা গল্প’, অরণ্য আনোয়ারের ‘মা’, রোজিনার ‘ফিরে দেখা’, রিলিজ পেয়েছে। তবে বছরের শেষ ভাগে রিলিজ পাওয়া হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প পুরোপুরি নতুন এক ঘরানার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করে যা সাধারণ দর্শকদের মাঝেও আলোচনা এবং প্রশংসায় স্থান করে নেয়। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের ওপর হওয়া অমানবিক জুলুম এর বিষয়টা উঠে এসেছে স্বল্প পরিসরে। এর বাইরে প্রামাণ্যচিত্র ঘরানার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’, তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।

আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর ঘটনা যেভাবে বা যতটা সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের সেলুলয়েডের স্ক্রিনে তুলে ধরা উচিত ছিল, সেটা হয়েছে কিনা বা হলেও মান বা সংখ্যার দিক থেকে সেটা যথাযথ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়!


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন