ওয়ান অ্যান্ড অনলি এটিএম শামসুজ্জামান
এটিএম শামসুজ্জামান বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে একাই একটি অধ্যায়। দেশীয় ছবিকে নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁর মতো কিংবদন্তিকে তুলে ধরতে লিখতে লিখতে অনেক লেখা যাবে তবু তাঁর বর্ণনা সম্পূর্ণ হবে না। অনেক ছবি, অনেক গল্প তাঁর।
এটিএম মোটের উপর ‘একই অঙ্গে বহুরূপ’-এর অার্টিস্ট। অভিনেতা, কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, প্রযোজক এবং পরিচালক। খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, কাজী জহির তাঁদের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন। তাঁর পর্দার পেছনের পর্দা বিষয়ক সৃজনশীলতার অনেককিছুই পাঠক, দর্শকদের অজানা। এটা তাঁর বিরল কৃতিত্ব।
মূল নাম আবু তাহের শামসুজ্জামান। জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, নোয়াখালিতে। স্কুলে তাঁর বন্ধু ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীরমিত্র। মঞ্চে কাজ করতেন ছাত্রজীবন থেকে। অভিনয়টা সেজন্যই রক্তে মিশে গেছে।
উল্লেখযোগ্য ছবি :
নয়ণমনি, গোলাপি এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, হারানো মানিক, নদের চাঁদ, ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, অনন্ত প্রেম, শহর থেকে দূরে, অভিমান, ওয়াদা, সাম্পানওয়ালা, আসামী, বাজিমাত, সূর্যদীঘল বাড়ি, শেষ উত্তর, জনতা এক্সপ্রেস, কথা দিলাম, ভালো মানুষ, বদনাম, দেনা পাওনা, সিকান্দার, কালো গোলাপ, পুরস্কার, মেহমান, এতটুকু আশা, দায়ী কে, সময় কথা বলে, এখনই সময়, লাল কাজল, পরিবর্তন, প্রিন্সেস টিনা খান, ফুলেশ্বরী, ইন্সপেক্টর, মায়ের আঁচল, পাগলী, রামের সুমতি, অভাগী, উসিলা, কুসুমকলি, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, চণ্ডিদাস ও রজকিনী, মর্যাদা, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, যাদুর বাঁশি, লাঠিয়াল, পদ্মা মেঘনা যমুনা, দোলনা, ঢাকা-৮৬, অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক, ভাই, ঘৃণা, অচেনা, আসামী গ্রেফতার, বদসুরত, বস্তির মেয়ে, জামাই শ্বশুর, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, ভাই, আধিয়ার, ম্যাডাম ফুলি, মনে পড়ে তোমাকে, ভণ্ড, মিনিস্টার, শাস্তি, হাজার বছর ধরে, মোল্লাবাড়ির বউ, এবাদত, ডাক্তারবাড়ি, আমার স্বপ্ন তুমি, চুঁড়িওয়ালা, মন বসে না পড়ার টেবিলে, কুসুম কুসুম প্রেম, আয়না, রাত্রির যাত্রী।
সর্বশেষ অভিনীত ছবি – আলফা।
এটিএমের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে তিনি একইসাথে সিরিয়াস অভিনয় যেমন পারেন তেমনি সিরিয়াসনেসের ভেতরেও কমেডি ঢুকিয়ে দর্শক হাসাতে পারেন। এমন ছবি আছে তিনি ভয়ঙ্কর ভিলেন যেমন- চেতনা, বদসুরত আবার এমন ছবি আছে তিনি সরল সোজা যেমন- দায়ী কে আবার এমন ছবিও আছে নিখাদ কমেডিয়ান যেমন- মোল্লাবাড়ির বউ। এই ধরনের কম্বিনেশন একমাত্র তাঁর মধ্যেই অাছে।
দেশীয় ছবির আশির দশকের বিখ্যাত পত্রিকা ‘চিত্রালী’-তে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল তখনকার ব্যস্ত শিল্পী এটিএমকে নিয়ে। বলা হয়েছিল-‘এটিএম ছাড়া ছবি জমে না।’ তাঁকে নিয়ে অল্প কথায় এটাই ছিল যথার্থ উপায় তাঁকে তুলে ধরার। আর ছবি জমানোর বিষয়টা তাঁর মাল্টিডাইমেনশনাল ক্যারেক্টার প্লে করার দক্ষতা থেকেই বলা হয়েছিল। মূল খলনায়ক হয়ে যেমন পর্দা কাঁপিয়েছেন আবার সহ-খলনায়ক হয়েও ‘ঘৃণা’-র মতো ছবিতে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কমেডিতে তাঁর জুটি ছিল হুমায়ুন ফরীদির সাথে। ‘ভণ্ড’ ছবিতে তাঁর বিশ বছরের মুরগি চুরির অভিজ্ঞতার অভিনয় কে ভুলতে পারে! ফরীদির সাথে এ ছবিতে ‘ঐ টানা টানা চোখ দুটো দেখ’ গানটি অসাধারণ। এছাড়া দুজনের কমেডিতে ‘ম্যাডাম ফুলি, মনে পড়ে তোমাকে’ ছবিগুলো স্মরণীয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেক্টারাইজেশন আছে তাঁর :
১. দায়ী কে – ১৯৮৮ সালে ‘দায়ী কে’ ছবিতে এটিএম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রথমবার। এ ছবিটির কথা এটিএম বিভিন্ন সময়ে একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। তাঁর ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠতম অভিনয় ছিল এ ছবিতে। নাম-পরিচয়হীন এক লোকের আত্মপরিচয় খোঁজার মাধ্যমে জীবনের কঠোর বাস্তবতা দেখানো হয়েছে ছবিতে। নিজের বাবাকে খুন করে এটিএম কারণ তাঁর বাবা তাঁর মাকে ঠকিয়েছিল এবং ছেলেকে করেছে পরিচয়হীন। পুলিশ নিয়ে যাবার আগে ইলিয়াস কাঞ্চন-অণ্জু ঘোষের ছেলেকে বলে-‘জীবনভর সবার লাত্থি গুতা খাইয়া বড় হইছি অাইজ শ্যাষ লাত্থিটা তুই দে।’ বলেই বাচ্চার পা তুলে নিজের কপালে মারে। অসম্ভব টাচি ছিল। পরিচালক আফতাব খান টুলুর বেস্ট কাজ এ ছবি।
২. ভালো মানুষ – চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এ ছবিতে তাঁর চরিত্রটি প্রশংসিত হয়েছিল। মেয়ে পাচারকারী সংস্থার সাথে যুক্ত ছিল। সাগরপাড়ে কোনো মেয়ে দেখলে বলতেন-‘একা নাকি?’ তাঁর মুখে এ সংলাপটি জনপ্রিয় হয়ে যায়।
৩. চাঁপা ডাঙ্গার বউ – তিনি এ ছবিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রত্যাশা করেছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে নায়করাজ রাজ্জাক নির্মিত এ ছবিতে বাড়ির বড়কর্তার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছোটভাই মহাতাবের সাথে তার বিরোধ বাঁধে।
৪. হাজার বছর ধরে – জহির রায়হানের উপন্যাস থেকে সুচন্দা নির্মিত এ ছবিতে তাঁর মকবুলের চরিত্রটি কালজয়ী হয়ে গেছে। উপন্যাসের মতোই জীবন্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি ছাড়া আর কাউকে দিয়ে চরিত্রটি সম্ভব ছিল না।
৫. মোল্লাবাড়ির বউ – এ ছবিতে তিনি আরেকবার নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। গ্রাম্য কাঠমোল্লার চরিত্রে প্রথমত কমেডি দ্বিতীয়ত সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার :
দায়ী কে (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা) – ১৯৮৮
ম্যাডাম ফুলি (শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা) – ২০০০
চুঁড়িওয়ালা (শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা) – ২০০১
মন বসে না পড়ার টেবিলে (শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা) – ২০১০
চোরাবালি (শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা) – ২০১২
তিনি ‘মোল্লাবাড়ির বউ, হাজার বছর ধরে’ ছবিগুলোর জন্যও জাতীয় পুরস্কার ডিজার্ভ করেন।
একুশে পদক পেয়েছেন ২০১৫ সালে।
মাছরাঙা টিভিতে ‘খলনায়ক’ নামে একটা অনুষ্ঠানে স্যুটিং অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন এটিএম। জসিমের সাথে একটা ফাইট সিকোয়েন্স, ছিল। ফাইটে কিভাবে কি করতে হবে এটা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়েছিলেন। জসিম হালকা করতে বণেছিল-‘ভাই, এটা কোনো ব্যাপারই না। অামি অাপনাকে ঘুষি দেয়ার আগে পড়ে যাবেন।’ কিন্তু হলো তার উল্টোটা। জসিম ফাইটে পাঞ্চ দেবার সময় পড়ে যাবার বদলে এটিএম মুখ এগিয়ে দেন ভুল করে অতএব জসিমের ইয়া বড় ঘুষিতে এটিএমের নাক ছানাবড়া..:-D
পরিচালক এটিএম শামসুজ্জামান একটিমাত্র ছবিতে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন সেটা অনেকে দশটা ছবিতেও পারে না। কমার্শিয়াল ছবিতেও মেসেজ দেবার ভালো সুযোগ আছে প্রমাণ করেছেন। তাঁর নির্মিত ‘এবাদত’ ছবিটি ইসলাম ধর্মের যথার্থ ব্যবহার বিভিন্ন কার্যকারণসূত্রে হয়েছে। অসাধারণ ছবি। ছবিটি দেখে মনে হয়েছে তাঁর আরো ছবি নির্মাণ করা উচিত। তাঁর গল্প থেকে নির্মিত হয়েছিল ‘মোল্লাবাড়ির বউ’ ছবি। পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলুকে একদিন বললেন-‘তোমার ক্যামেরা কথা বলে। আমি গল্প দিচ্ছি ছবি বানাও।’ লাভলু বলেছিলেন-‘আমি কি পারব?’ তিনি সাহস দেন। তারপর নির্মিত হলো ছবি এবং দর্শক সাদরে গ্রহণ করল। এখন এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবি।
তিনি বাংলা নাটকেও জনপ্রিয় মুখ। ‘রঙের মানুষ, ভবের হাট, পত্রমিতালী, শীলবাড়ি, ভোদাই, টেটমেন’ নাটকগুলো স্মরণীয়। হানিফ সংকেতের ‘পুত্রদায়’ এর মতো নাটক তো আছেই।
২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
এটিএম শামসুজ্জামান কিংবদন্তি। নাম শুধু নয় প্রতিষ্ঠান তিনি। অনেক গুণের সমষ্টিতে একজন এটিএম শামসুজ্জামান মেলে। যত কথাই বলি না কেন তাঁকে বিশ্লেষণের জন্য আরো বাদ পড়ে যাবে। তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
ছবি; ফিরোজ এম হাসান