ওয়েবে দিনারের নতুন ইনিংস
ওটিটির কল্যাণে দেশের অনেক গুণী ও দক্ষ অভিনয়শিল্পী নতুন করে আলোচনায়। ভিন্ন গল্পে ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় নতুনভাবে তাদের আলোচনায় এনেছে, দর্শকদের কাছেও প্রশংসা পাচ্ছেন। তেমনই এক নাম হলো ইন্তেখাব দিনার।
গত বছর ‘দ্বিখণ্ডিত’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘লাইট ক্যামেরা অবজেকশন’, ‘তিথির অসুখ’ বা সম্প্রতি রিলিজ পাওয়া ‘নিখোঁজ’ এবং এবারের ঈদে ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ পাওয়া ‘দৌড়’— সবমিলিয়ে বলা যায়, আমরা যেন এক নতুন তীক্ষ্ণধার অভিনেতার দেখা পেয়েছি ওটিটির কল্যাণে।
মঞ্চে অভিনয়ের হাত-খড়ির পরে সালাউদ্দিন লাভলুর পরিচালনায় ‘গোর’ নাটকের মধ্য দিয়ে টেলিভিশনে আগমন ঘটলেও আফসানা মিমির মেগা ধারাবাহিক ‘বন্ধন’-এ অভিনয় করে পরিচিতি পান তিনি। ‘অফবিট’ নাটকটিও তার ক্যারিয়ারের অন্যতম আলোচিত কাজ। এরপর ইন্তেখাব দিনার নিয়মিত কাজ করে গেছেন। বেশ কিছু ফিকশনে তার অভিনয় আলোচনায়ও এসেছে। তারপরও ঠিক যতোটা আলোচনা বা প্রশংসা তার প্রাপ্য ছিলো তা তিনি পাননি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে, দেশের যে কয়জন আন্ডাররেটেড শিল্পী আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম ইন্তেখাব দিনার।
‘চরকি’তে প্রচারিত নন্দিত ও প্রশংসিত অমনিবাস সিরিজ ‘ঊনলৌকিক’র শেষ এপিসোড ‘দ্বিখণ্ডিত’ ছিলো পুরাই ওয়ান ম্যান শো। আর এই ব্যক্তিটি হলেন ইন্তেখাব দিনার। মোস্তাক আহমেদ নামক চরিত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ছোট একটা চাকরি করা ব্যক্তির ভূমিকায় একদিন দুপুরবেলা তিনি হাজির হন থানায়, উদ্দেশ্য জিডি করবেন। কিন্তু জিডি করার পূর্বে হাজির এসআই’র টেবিলে। তারপর থেকেই অনবরত বলে যাচ্ছেন সত্য এবং আজব কিছু ঘটনা। একে একে নিজের হাতে থাকা একটা ফাইল থেকে প্রমাণ সহকারে চারটি অদ্ভুত ঘটনা বললেন। একজন মন্ত্রীর একই সময়ে দুটি জায়গায় উপস্থিতি, এভারেস্টে হিলারি স্টেপস, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভাগের সময়কার একটা স্থিরচিত্র এবং সেন্সর বোর্ডের একটি ঘটনা এই চারটি বিষয়ে তার বক্তব্য এসআই তো বটেই দর্শকদের এক ভ্রমের ভেতর ফেলে দেয়। ভ্রমটা এতোটাই শক্তিশালী যে যে, একটা সময় মোস্তফা আহমেদের উপস্থিতি নিয়েই একটা প্রশ্ন রেখে যায়। এমন একটি চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার যা করে দেখিয়েছিলেন তা ছিলো এক কথায় মনোমুগ্ধকর। ২৪ মিনিটের এই ফিকশনে তিনি একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকান। তার ক্যারিয়ারের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট এই ‘দ্বিখণ্ডিত’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এরপর একই প্ল্যাটফর্মে ওয়েবফিল্ম ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’তে হাজির হলেন একটি নেগেটিভ চরিত্র। যতোটা সময় স্ক্রিনে ছিলেন তার শক্তিশালী অভিনয় দিয়ে আমাদের চমকে দিয়েছেন। এক মন্দ লোকের দুষ্টু হাসি, ক্ষুরধার চাহনি, বডি ল্যাংগুয়েজ সবই চমকপ্রদ ছিলো। সুমন আনোয়ার, ফজলুর রহমান বাবুর মতো অভিনেতাদের সাথে তাল মিলিয়েই অভিনয় করেছেন।
মাঝে ‘তিথির অসুখ’ ফিকশনেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। তার চরিত্রটি গল্পে আলাদা মাত্রা যোগ করে। তবে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’র আরেকটি অমনিবাস সিরিজ ‘জাগো বাহে’র একটি পর্ব ‘লাইটস, ক্যামেরা… অবজেকশন’-এ একজন স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অভিনয় অসাধারণ অভিনয় করে আবারো আলোচনায় আসেন ইন্তেখাব দিনার। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই ফিকশনে জেনারেল রাও ফরমান আলী চরিত্রে তার অভিনয়ে মুগ্ধ হননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। জহির রায়হানের ভূমিকায় আরেক শক্তিশালী অভিনেতা মুস্তফা মনোয়ারের সাথে তার ওয়ান টু ওয়ান পারফরম্যান্স ছিলো এক কথায় মনোমুগ্ধকর। ফিকশনে তার কথাবার্তা, হাঁটাচলা, অঙ্গভঙ্গি সবই ছিল আপ টু দ্য মার্ক।
এই ধারাবাহিকতায় এরপর হাজির হন চরকির ‘নিখোঁজ’ ওয়েব সিরিজে। দুই দশক আগে হারিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির গল্পে গোয়েন্দা অফিসার হামিদুর রহমান হিসেবে আবারো নিজের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে হাজির হলেন তিনি। একজনের ওপর একটা কেসের জন্যে সন্দেহ করা গোয়েন্দা অফিসার হামিদুর রহমান সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরার জন্যে যেভাবে ফাঁদ পাতলেন এবং সেটা সেলুলয়েডে ঠিকঠাক উপস্থাপন করলেন তা অনবদ্য। চৌকস গোয়েন্দা অফিসার হামিদুর রহমান চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার প্রমাণ দিলেন তার দেবার আছে অনেক কিছুই। গল্পে তার পরিবার আর কর্মজীবন যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা এককথায় দারুণ। এই চরিত্রে ইন্তেখাব দিনারকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন নির্মাতা রিহান রহমান। আফসানা মিমি, শতাব্দী ওয়াদুদ, শিল্পী সরকার অপুর মতো সিনিয়র ও নিজের সমসাময়িক দক্ষ শিল্পীদের পাশাপাশি শ্যামল মাওলা, খায়রুল বাসার, অর্চিতা স্পর্শিয়া বা মাসুম রেজওয়ানের মতো এই সময়ের মেধাবীদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও একটা ফিকশনে নিজের চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেটার রেশ রেখে যাওয়া কম কথা নয়। এই কাজটা অসাধারণ সুন্দর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে খুব সহজেই করে দেখালেন এই গুনী ও পরিশ্রমী অভিনেতা।
হইচইয়ে এর কিছুদিন আগেই আশফাক নিপুণের প্রশংসিত এবং আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘সাবরিনা’তেও মেহজাবীন এবং অর্ষার পাশাপাশি ইন্তেখাব দিনারও তার শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবেই। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই এবার তিনি হাজির হলেন ‘দৌড়’ নিয়ে।
রায়হান খানের পরিচালনায় ‘দৌড়’ একভাবে অন্যতম গুণী অভিনেতা মোশাররফ করিমের ওয়ান ম্যান শো হলেও তার পাশে আলো ছড়িয়েছেন যে কয়জন তাদের মধ্যে শীর্ষ নামটা হলো ইন্তেখাব দিনার। অহনা কন্সট্রাকশনস’ এর ম্যানেজার আকমল চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার মাঝে মাঝেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন তার বস রুহুল আমিন রূপে একের পর এক ছক্কা পেটানো মোশাররফ করিমকে। সিরিজে মোশাররফ করিম তথা রুহুল আমিনের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে ব্যবসার জায়গা তো বটেই এমনকি অনেক ব্যক্তিগত বিষয়েও সব কাজের কাজী হিসেবে আকমল রূপে ইন্তেখাব দিনার এতোটাই প্রাণবন্ত ছিলেন যে, তাকে একবারের জন্য ও আকমল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়নি। তার করা কোনো ভুলে রুহল আমিনের গালাগাল, চড়ের হুমকি, অকথ্য ব্যবহার সবই তিনি সামাল দিয়েছেন তার অভাবনীয় এবং সাবলীল এক্সপ্রেশন এবং বডি ল্যাংগুয়েজের মধ্য দিয়ে। আকমল সাহেবের মতো এরকম চরিত্র আমাদের সমাজে বা জীবনে কখনো না কখনো আমরা সবাই কম বেশি দেখি কিন্তু সেভাবে গ্রাহ্য বা লক্ষ্য করিনা। তবে রায়হান খানের পরিচালনায় ইন্তেখাব দিনার সেটা দেখিয়ে দিলেন তার সহজাত এবং সাবলীল অভিনয় দক্ষতার মধ্য দিয়ে।
নয় এপিসোডের এই সিরিজ দেখার পর মনে হয়েছে যদি আকমল চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার এতো অসাধারণ না হতো তাহলে হয়তো রুহুল আমিন রূপে মোশাররফ করিম এতো সাবলীল হতে পারতেন না। তেমনটা আবার উল্টোভাবেও খুব সত্য। এক সহশিল্পীর পারফরম্যান্সের ওপর অন্যদের পারফরম্যান্সের অনেক কিছুই নির্ভর করে। আর এই কথাটা নতুনভাবে আমাদের দেখিয়ে দিলো ‘দৌড়’-এর দুই চরিত্র। তাই তো মোশাররফ করিম, তারিক আনাম খান, ইরফান সাজ্জাদের মতো ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের অভিনেতাদের মাঝেও ইন্তেখাব দিনার নিজের দক্ষতা দিয়ে লাইমলাইট অনেকটাই নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন নিজের স্বতন্ত্র প্রতিভার জোরে।
ওটিটি প্লাটফর্ম আমাদের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে পরিবর্তন এনেছে, বেশকিছু ভালো কাজ দেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা, গল্পকার এবং নির্মাতারা কনটেন্ট এবং চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন এসব এখন যেমন সত্য তেমনি ইন্তেখাব দিনারেএর মতন একজন সুঅভিনেতার নতুনভাবে প্রত্যাবর্তন এই ওটিটির মাধ্যমেই এটাও সত্য। সামনের দিনেও শক্তিশালী এই অভিনেতাকে আমরা আরো ব্যতিক্রমী এবং ভিন্নধর্মী কাজে দেখতে পাবো এটাই কামনা।