Select Page

কাটপিসের যুগে এ জে মিন্টুর প্রতিবাদ ‘বাপের টাকা’

কাটপিসের যুগে এ জে মিন্টুর প্রতিবাদ ‘বাপের টাকা’

তখন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে ধীরে ধীরে এক শ্রেণীর অসাধু প্রযোজক ও পরিচালকদের কারণে ‘কাটপিস’ নামের যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার অপকৌশল জেঁকে বসেছে। সিনেমা হল থেকে মহিলা দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলো। মেহেদী, ঝুমকা, মুনমুন, ময়ূরীরা একের পর এক চলচ্চিত্রে লাউ, কুমড়া, কচু গাছ, কলা, মূলা,জাম্বুরা, বেগুন সহ যাবতীয় তরিতরকারি ও ফলমূল নিয়ে নৃত্যকলা দেখিয়ে যৌন সুড়সুড়ি দিতে লাগলেন।

খলনায়ক ডিপজল ঢাকাইয়া ভাষায় ‘সিস্টেম কইরা দিমু’, ‘পুত কইরা দিমু’, ‘মাইঙ্কারে মাইঙ্কা কি বাত্তি জালাইলি’ টাইপের খিস্তি খেউর সংলাপ দিতে লাগলেন। প্রভাবশালী অসাধু প্রযোজক পরিচালকদের কাছে গুণী পরিচালক ও শিল্পীরা অসহায় হয়ে পড়ছিল। সি বা ডি গ্রেডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কদর বাড়তে শুরু করলো।

ঠিক এমন একটি সময় সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হলে ‘বাপের টাকা’ নামের একটি চলচ্চিত্র দেখতে গেলাম আমরা কয়েক বন্ধু। চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক, কারণ এটি পরিচালনা করছেন বাংলা চলচ্চিত্রের মাস্টার মেকার এ জে মিন্টু, যিনি কোনদিন দর্শকদের হতাশ করেননি ।

‘বাপের টাকা’র পোস্টারটাও ছিল আকর্ষণীয়… স্যুটেট বুটেট সানীর চারপাশে অসংখ্য টাকা উড়ছে, ডানপাশে বড় মলিন ও করুন চাহনি আলমগীরের এবং বামপাশে এক চোখ টিপে রহস্য চাহনি হুমায়ূন ফরীদি এবং পোস্টারের এক কোণায় মৌসুমী দোলনায় দোল খাচ্ছে কি ভাবনা চোখে মুখে নিয়ে ।

আরেকটি পোস্টার ছিল কাঠের একটি জ্বলন্ত টুকরা দিয়ে সানী বেশ আয়েশি ভঙ্গিমায় সিগারেট ধরাচ্ছে, বেশ বড় একটি অংশ জুড়ে মৌসুমীর অশ্রুভেজা চোখ এবং বাম পাশে আলমগীরের মাথায় মাটির টুকরি এবং ফরীদি ভিক্ষার থালা নিয়ে ভিক্ষা করছে। এমন নান্দনিকভাবে মিন্টু পোস্টারের মাধ্যমে ছবিটি সম্পর্কে দর্শকদের কিছু বলতে চেয়েছেন, বুঝাতে চেয়েছেন। সিনেমার পোস্টার শুধু চোখে দেখার খুব সাধারণ কিছু নয়, এরও আলাদা ভাষা আছে, আলাদা শৈল্পিকতা আছে যা সবাই ফুটিয়ে তুলতে পারে না (আজকের সিনেমার পোস্টারগুলো তো একদমই নয়), কিন্তু সেইসময়ে আমাদের গুণী পরিচালক ও পোস্টার আঁকিয়েরা পারতেন ।

বিকেল তিনটার শো দেখতে আমরা যথারীতি নন্দিতা সিনেমা হলে হাজির। হলের সামনে অসংখ্য দর্শকদের জটলা যার মাঝে পরিবারসহ নারী দর্শকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কারণ সেই সময়ে নারী দর্শকরা ধীরে ধীরে হলবিমুখ হয়ে যাচ্ছিলেন যাদের ‘বাপের টাকা’ চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে অনেকদিন পর দেখা পেলাম।

বেশ চড়া দামেই টিকেট কেটে আমরা হলে প্রবেশ করলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর হলের পর্দা উঠলো, দর্শকদের করতালি সিনেমা শুরু হবে ……অবশেষে শুরু হল । দেশ সেরা শিল্পপতি আলমগীর ও তাঁর একমাত্র আদরের সন্তান। সানীর মা খুব ছোটবেলাতেই মারা যায়। ফলে সানী বড় হয়েছে বাড়ির কেয়ারটেকার আনোয়ার হোসেনের স্নেহে আর আলমগীরের টাকায়। একমাত্র ছেলেকে মায়ের অভাব বুঝতে না দিতে সানী যখন যা চেয়েছে তাঁর বেশি কিছু আলমগীর সবসময় দিয়ে গেছে।

আলমগীর সবসময় ছিল ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ফলে আলমগীরকে খুব কাছে সানী কমই পেয়েছে। সানী বড় হতে হতে বুঝেছে যে তাঁর বাবার অনেক অনেক টাকা যা দিয়ে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। দুহাতে টাকা অপচয় করাটা সানীর শখে পরিণত হয়। অবস্থা এমন হয় যে গায়ে কিংবা পোশাকে একটু ধুলো পড়লেও রুমাল বা টিস্যুর বদলে সানী পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে সেটা দিয়ে হাত মুছে তা নির্দ্বিধায় ফেলে দেয় আর অন্যরা সেই টাকা কুড়িয়ে নেয়। দিনদিন সানীর বখাটেপনা, বিলাসিতা বেড়েই চলেছে। কলেজে সানীর বন্ধুরা যখন পরীক্ষার ফলাফল জানতে ব্যস্ত , সানী তখন অট্টহাসি হাসে, পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে কি হবে? সানী কি কোথাও চাকরি করবে? আরে, সানী তো মানুষকে চাকরি দিবে। অনেক বিএ , এমএ পাশ সানীর পিছনে স্যার স্যার বলে ঘুরবে।

একদিন আলমগীর সানীকে ইচ্ছে করেই একটি জমির নিলামের ডাকে সাথে করে নিয়ে যায় যেন সানী ধীরে ধীরে ব্যবসা বাণিজ্য বুঝতে শিখে। সেই নিলামে গিয়ে সানী ৩০ লক্ষ টাকার জমি ১ কোটি টাকায় কিনে নিয়ে আলমগীরকেও বিস্মিত করে দেয়। কারণ সানী চায়নি আর কেউ নিলামে জমিটা কিনুক। অর্থাৎ এখানেও সানী টাকার গরম দেখাতে এসেছে যা আলমগীর ভালো চোখে নেয়নি। ঐ নিলামেই পরিচয় হয় মৌসুমীর সাথে যিনি তাঁর মরহুম বাবার নামে একটি হাসপাতাল করার জন্য জায়গাটি কিনতে এসেছিলেন কিন্তু সানীর কারণে পারেনি।

সেই নিলাম অনুষ্ঠান শেষে সানীর অভদ্রতার আচরণে বিরক্ত হয়ে মৌসুমী সানীর গালে একটি চড় মারে যা সানীকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলে। সানী মৌসুমীর সাথে বদলে যাওয়ার অভিনয় করে এবং মৌসুমীকে ঐ জায়গাটি বিনামূল্য দিয়ে মৌসুমীর স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকার ইচ্ছে পোষণ করে। সানীর মিথ্যা অভিনয়ে মৌসুমী সানীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দুজনের মধ্য প্রেম হয়। এরই মাঝে সানীর সাথে পরিচয় হয় আপাদমস্তক এক টাঊট বাটপার ফরীদির সাথে যার পেশাই হলো প্রতারণা করা। ফরীদি খুব তাড়াতাড়ি সানীর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। মৌসুমী যখন সানীকে বিয়ের কথা বলে তখনই সানীর আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় যা মৌসুমী এতদিন ধরতে পারেনি। সানী চড়ের প্রতিশোধ নিতে এতদিন মৌসুমীর সাথে ভালবাসার অভিনয় করেছিল বলে স্বীকার করে মৌসুমীকে তাড়িয়ে দেয়।

এভাবে সানীর একের পর এক অধপতন দেখে এক রাতে মাতাল সানীকে আলমগীর শাসন করতে গেলে পিতা পুত্রের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সানী আলমগীরকে বলে দেয় তাঁর মতো পিতার কোন প্রয়োজন নেই, সে শুধু টাকা ও সম্পত্তি পেলেই খুশি। আলমগীর সানীর উপর অভিমান করে সেই রাতেই ঘর ছেড়ে চলে যায় এবং খুব সাধারণ এক শ্রমিকের জীবন শুরু করে। সকালে সানী আনোয়ার হোসেনের মুখে আলমগীরের চলে যাওয়ার কথা শুনে একটুও বিচলিত হয়নি বরং ভেবে নিয়েছে দুইদিন পর ঠিকই চলে আসবে। কিন্তু আলমগীর তো আর ফিরে আসেনা। সানী বাবার অবর্তমানে ব্যবসার হাল ধরে কিন্ত কিছুই ঠিক মতো চালাতে পারেনা। শুধু টাকা খরচ করতে থাকে। একদিন একটি কারখানায় দুর্ঘটনা বশত আগুন লাগলে সানী সেই কারখানার আগুনের একখণ্ড দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে ‘আগুন লেগেছে তো কি হয়েছে? ইনস্যুরেন্সের টাকা দিয়ে আবার সব বানাতে পারবে’। এদিকে একের পর এক ফ্যাক্টরি বন্ধ হতে থাকে সানীর ব্যর্থতায়। ইন্সুরেন্স কোম্পানি তদন্ত করে আগুন নেভাতে গাফিলতি পাওয়ায় টাকা দিবেনা জানিয়ে দেয়। ব্যাংকের দেনা পরিশোধ না করায় একের পর এক প্রতিষ্ঠান নিলামে উঠে। সানী তাঁর বন্ধু বান্ধব কারো কাছে কোন টাকা ধার পায়না। একে একে সবাই সানীর কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। সানী যখন সব হারিয়ে নিঃস্ব ও প্রায় পথের ফকির ঠিক তখনই আনোয়ার হোসেন সানীকে বলে ‘ বড় সাহেব চলে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল সানী যদি কখনও খুব বিপদের সম্মুখিন হয় তখন যেন দোতলার নামাজের ঘরে যায় ‘।

আনোয়ার হোসেনের কথামতো সানী তাঁর বাবার নামাজের ঘরে গিয়ে দেখে ফলস সিলিংয়ের সাথে গলায় ফাঁস দেয়ার একটি দড়ি ঝুলানো আছে। সানী মনে করে বাবা হয়তো তাঁকে আত্মহত্যা করে সবকিছু থেকে রেহাই পাওয়ার পথ দেখিয়ে গেছে। সানী তাঁর বাবার ইচ্ছে মতো সেই দড়িতে ঝুলতে গেলেই ফলস সিলিং ভেঙ্গে অসংখ্য টাকার বান্ডিল মেঝেতে বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। সানীর চোখে মুখে বিস্ময় ধরা দেয়!!!! সানী খুঁজে পায় বেঁচে থাকার নতুন পথ। সেই টাকা দিয়ে সানী আবার নতুন করে সব একে একে গড়তে থাকে এবং সানী সম্পূর্ণ বদলে যায়। যে সানী টাকা দুহাতে উড়াতে ভালোবাসতো, যে সানী টাকা দিয়ে সব কিছু পাওয়ার দাপট দেখাতো, অহংকার করতো সেই সানী সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ। …. এভাবেই সানী নতুন এক মানুষ হয়ে যায় এবং আলমগীরকে ঘরে ফিরিয়ে আনে। মৌসুমীকেও সানী সত্যি সত্যি ভালোবাসতে শিখে …… আলমগীর, সানী ও মৌসুমীর মিলনের এবং প্রতারক ফরীদিকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ‘বাপের টাকা’ নামের অদ্ভুত, অসাধারণ একটি চলচ্চিত্রের।

অশ্লীলতার যুগেও মাস্টার মেকার এ জে মিন্টু দর্শকদের উপহার দিয়েছিলেন একটি অসাধারন গল্পের অসাধারণ চলচ্চিত্র যা দেখে প্রতিটি দর্শকই সেদিন সিনেমা হল থেকে মনে অনেক তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরেছিল । ছবিটির সবচেয়ে শক্তিশালি দিক ছিল গল্প ও চিত্রনাট্যর অসাধারন সংমিশ্রন। মিন্টু খুব যত্ন নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন যা প্রতিটি দৃশ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্পীদের কাছ থেকে তাঁদের সেরা অভিনয়টা কিভাবে আদায় করে নিতে হয় সেটা মিন্টু প্রমাণ করেছেন। অভিনয়ে অপরিপক্ক সানীর সেরা অভিনয় সমৃদ্ধ সিনেমা হলো ‘বাপের টাকা’। ছবিটির গল্প, শিল্পীদের অভিনয় আর মিন্টুর মুন্সিয়ানার সাথে গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ও আলম খানের সুর করা গানগুলোও ছিল দারুণ। সেই সময় পত্রিকায় জেনেছিলাম যে এ জে মিন্টু প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে ‘বাপের টাকা’ চলচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন যা ছিল সেই সময়ের সর্বাধিক বাজেটে নির্মিত চলচ্চিত্র।

অশ্লীল সিনেমার যুগেও এমন পরিছন্ন সিনেমা নির্মিত হতে পারে সেটা মিন্টু প্রমাণ করলেন। খলনায়কের খিস্তি খেউর, যৌন সুড়সুড়ি দেয়া একাধিক দৃশ্য, অকারণ ঢিসুম ঢিসুম ছাড়াই দর্শকদের টানা তিনঘন্টা সিনেমা হলে বসিয়ে রাখা যায় ‘বাপের টাকা’ তার এক দারুন উদাহরন। দর্শকরা ভেবেছিল, অসাধু প্রযোজক পরিচালকরা এ জে মিন্টুর মতো অসাধারণ পরিচালকদের কাছে ঠিকই পরাজিত হবে এবং চলচ্চিত্রে সুস্থধারার দারুণ দারুণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে। কিন্তু বিধিবাম !!!! এমন একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও এ জে মিন্টু সেদিন অশুভ শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিলেন।

মাস্টার মেকার বিদায় বেলাতেও প্রমাণ করে গেলেন তিনি সত্যি সত্যি বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মাস্টার মেকার’ যার মতো পরিচালক দ্বিতীয়য় আরেকজন আর আসবে না। চলচ্চিত্র শুধুই নিছক বিনোদন নয়, চলচ্চিত্র দিয়ে জীবনের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বার্তাও দেয়া যায় সেটা ‘বাপের টাকা’ দিয়ে তিনি আরও একবার প্রমাণ করেছিলেন। যারা বলে পুরনো পরিচালকদের দিয়ে আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয় তাঁদেরকে বলবো যদি পারেন শুধু একবার ‘বাপের টাকা’ চলচ্চিত্রটি দেখে নিবে , এমন আধুনিক গল্পের আধুনিক চলচ্চিত্র গত ১৫ বছরে আসা নিত্য নতুন তথা কথিত মেধাবি পরিচালকরাও নির্মাণ করে দেখাতে পারেনি

যেখানেই থাকুন, সব সময় সুস্থ ও ভালো থাকুন প্রিয় মাস্টার মেকার এ জে মিন্টু।


মন্তব্য করুন