Select Page

কালো তালিকায় ফেরদৌস আরা / দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গানে ঠোঁট মেলালাম

কালো তালিকায় ফেরদৌস আরা / দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গানে ঠোঁট মেলালাম

চ্যানেল আইয়ে নজরুল সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরাকে নিয়মিত দেখা যায়। অন্য চ্যানেলে কালে-ভদ্রে দেখা যেতো না এমন নয়। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে গত ১৫ বছর গাইতে পারেননি তিনি। কালে তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছিল এ গুণী শিল্পীকে।

ফেরদৌস আরা জানান, ‍“একদিন বিটিভির প্রধানকে এ বিষয়ে বললাম, ‘আমাকে নিতে হবে না। শুধু জানতে চাই, কে আমাকে ডাকতে নিষেধ করেছে, আর কারণটা কী?’ তিনি আমাকে বলেন, ‘আপনাকে কেন বাদ দেওয়া হবে?’ তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যান। একসময় জানতে পারি, নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ আমি নই, আমার স্বামী। আমার স্বামী ড. রফিকুল মোহামেদ কোনো এক সময়ে কোনো জেলার ডিসি ছিলেন। তাই মনে করা হতো, তিনি বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সরকারি চাকরি করে তিনি যদি কোনো অন্যায় করেন, তাহলে সে শাস্তি তিনি পাবেন। শিল্পীকে কেন শাস্তি দেওয়া হলো।”

এমনকি সরকারি অনুষ্ঠানে নাম রেখেও কেটে দেওয়ার মতো অপমানজনক ঘটেছে এ শিল্পীর সঙ্গে। ফেরদৌস আরা বলেন, “বাংলাদেশ থেকে সাংস্কৃতিক দল প্যারিসে যাবে অনুষ্ঠান করতে। আমাকে জানানো হলো, আমার নাম আছে। প্যারিসের রাষ্ট্রদূত ও তাঁর স্ত্রীও আমাকে ফোন করে বললেন, ‘আপনাকে কিন্তু আসতে হবে।’ পুরো প্রস্তুতি নেওয়ার পর দেখি, আমার কাছে আর ফোন আসে না। পরে আমাকে জানানো হয়, আপনার নাম কাটা গেছে। দুবাইয়ে এক সরকারি অনুষ্ঠানের জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে বলার দুদিন পর আমাকে জানানো হলো, অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে। পরে দেখি অনেকেই সেই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে এসেছে। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে।”

তবে এ গায়িকা এমন এক ঘটনা বলেছেন, তা শুনলে হতবাক হতে হয়। যা অভাবনীয় ভাবলেও ঘটেছে। ফেরদৌস আরা বলেন, “শিল্পকলা নিয়েও বাজে অভিজ্ঞতা আছে আমার। অনেক বছর আগে আর্মি স্টেডিয়ামে শিল্পকলার একটি অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অনুষ্ঠানের আগের দিন রিহার্সালের সময় দেখি, শিল্পকলার শীর্ষস্থানীয়রা তাঁদের কাছের মানুষদের প্রথম সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমাকে আর আবিদা সুলতানাকে দিলেন ১০০ জনের পেছনে এক কোনায়। পরের দিন আমি শিল্পকলার প্রধান ও তাঁর সঙ্গীদের হাসতে হাসতে বললাম, ‘মাঝখানে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা কারা? এত দিন আমরা কি তাহলে ঘাস কাটলাম?’ এরপর আমাকে তাঁরা অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলেন। তাঁদের ব্যবহারে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সেই অবস্থায় সোহরাব নামের একজন আমার চোখের সামনে আঙুল তাক করে চিৎকার করে বলে, ‘অত বড় চোখ দিয়ে আমাকে খেয়ে ফেলবেন নাকি?’ এমন অবস্থায় (রেজওয়ানা চৌধুরী) বন্যা আপার একজন শিক্ষার্থী এসে বলে, ‘ভেরি গুড, একদম উচিত শিক্ষা দিয়েছেন।’ সেদিন আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। এরপর আমাকে বলে, ‘চলে যান।’ কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, প্রোগ্রাম শেষ করে না গেলে আমার আরও ক্ষতি হতে পারে। আমাকে উল্টো দোষ দেওয়া হবে। তাই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষ সারিতে কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গানে ঠোঁট মেলালাম। এর পর থেকে আর কোনো দিন শিল্পকলার পথে পা দিইনি। আমাকেও কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি।”

১৫ বছরের পর বঞ্ছনার সয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি বিটিভি ও বেতারে কণ্ঠ দিলেন ফেরদৌস আর। তিনি বলেন, “দীর্ঘ ১৫ বছর পর আবার বিটিভি ও বেতারে গাইলাম। শিল্পী তৈরিতে এ প্রতিষ্ঠান দুটির ভূমিকা অনেক। আমাদের সংগীতের আঁতুড়ঘর বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার। এখানে অনুষ্ঠান করেই আমাদের পরিচিতি এসেছে। এখানে আবার গাইতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে।”

ঢাকা পোস্টকে দেয়া ফেরদৌস আরার সাক্ষাৎকার থেকে


মন্তব্য করুন