Select Page

‘একদিন না গাইলে দম আটকে আসে রে’, কনকচাঁপাকে বলতেন অ্যান্ড্রু কিশোর

‘একদিন না গাইলে দম আটকে আসে রে’, কনকচাঁপাকে বলতেন অ্যান্ড্রু কিশোর

[বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবিস্মরণীয় জুটি অ্যান্ড্রু কিশোর-কনকচাঁপা। পর্দার পাশাপাশি তারা মঞ্চেও ছিলেন জনপ্রিয়। সম্প্রতি অ্যান্ড্রু কিশোরের সঙ্গে গানের অভিজ্ঞতা ফেসবুকে ভক্তদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন কনক চাঁপা। সেই লেখাটি বিএমডিবি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।]

কত কথা রয়ে যায় বাকি!

আমি কিশোরদার সাথে যত প্লেব্যাক করেছি তার সমান না হলেও মঞ্চানুষ্ঠান কম করিনি। কি দেশে কি বিদেশে। অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম তাঁর সাথে এই অনুভবটা আমাকে বারবার আবেগাপ্লুত করছে।

বেশিররভাগ অনুষ্ঠানে আমি আগে গাইতাম তারপর কিশোরদা। স্বাভাবিক, জুনিয়র আগে গাইবে এটাই নিয়ম। তারপর ওনার গান গাওয়া শেষ হলে উনি মঞ্চ থেকে আমাকে ডাকতেন। বলতেন কনককে মঞ্চে আমার সাথে ডুয়েট গাইবার অনুরোধ জানাচ্ছি। কনক,আসো! আমি সবসময়ই বলতাম কিশোরদা অনুরোধ শব্দটা বইলেন না প্লিজ! কিন্তু উনি কখনো তা শোনেননি। এভাবেই ডেকে গেছেন।

মঞ্চে আমাদের দুজনেরই নিজস্ব সোজাসাপটা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়েই গাইতাম। কিন্তু আজকালকার চল(!) অনুযায়ী কিশোরদা ভাবতেন যে আরেকটু অভিনয় দরকার! সেই ভাবনাতেই “তোমায় দেখলে মনে হয়” বলতে গিয়ে আমার দিকে তাকাতে আমি লজ্জায় মরে যেতাম। মঞ্চে ডুয়েট গানে একটু প্রেমিক-প্রেমিকার অভিনয় দর্শক পছন্দ করে কিন্তু সেই অভিনয়ে আমি, কিশোরদা দুজনই ভীষণ আনাড়ি!  সবশেষে মঞ্চ জমানোর জন্য সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা গাইতে গিয়ে তোমার কানের সোনা গাইতে গাইতে দুরত্ব বজায় রেখেই আমার কানের দুলে ইঙ্গিত করতেন আঙুল উঁচিয়ে। আমি মঞ্চে লজ্জায় হাসতে থাকতাম।

একবার যেই তোমার কানের সোনা বলে আঙুল উঁচিয়েছেন ঠিক তখনই কাকতালীয়ভাবে পুশ খুলে কানের একটা দুল খুলে পড়ে গেলো! পেছনে এলইডি স্ক্রিনে দর্শক সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সবাই হেসে উঠল, পেছনে বাজনা বাজছে, কিশোরদা বলছেন “আমি কিন্তু ওর কানের দুল খুলিনি, চেয়েছি মাত্র।” আবার দর্শকদের হাসি।

আমেরিকায় আমাদের কমন প্রমোটর আলমগীর খান আলম ভাই কতবার যে আমাদের একসাথে নিয়ে গেছেন! অলি আংকেল-এর খালি বাসায় আমরা অনেক শিল্পী একসাথে থাকতাম মাস ধরে। আমি, রিজিয়া আপা, বিপাশা হায়াত, সুমনা হক আমরা পালাক্রমে রান্না করতাম। কিশোরদা বলতেন গরুর গোস্ত কনক রান্ধো। আর কেউ না, আররেএএএ! সেইরকম ঝাল দিবা যেন খেতে খেতে কাঁদতে হয়!

কতরকম গল্প যে উনি করতেন! চিটাগং এর প্রত্যন্ত অঞ্চলে উনি নাকি একটা বিশেষভাবে মাছ রান্না খেয়েছেন। শোল মাছ প্রসেস করে কলাপাতায় পেঁচিয়ে মাটির প্রলেপ দিয়ে জলন্ত উনুনে পুতে রান্না হয়। তারপর খুললে যে সুবাস বের হয় সেটা এমনভাবে বলতেন যে প্রতিবারই জিভে পানি আসত।

উনি বলতেন কনক জানো অজু কী? আমি ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তার কথা বলতাম। কিশোরদা বলতেন, তুমি তো এটা বলবেই কিন্তু তুমি কি জানো এটা কত সায়েন্টিফিক? আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো বলতাম “না”। কিশোরদার ব্যাখ্যা “অজু করার সময় আমাদের হাত ঘাড় ও পায়ের পালস পয়েন্টগুলো ভেজে। তাতে দেহ ঠান্ডা হয়। সাথে পবিত্রতাও আসে।”  আর যার জন্য উনি নিয়মিতই অজু করতেন!

আবার জিজ্ঞেস করতেন বলো তো হিন্দু বাড়িতে তুলসীগাছ কোথায় থাকে?  আমি জানিনা সূচক মাথা নাড়তেই উনি ব্যাখ্যা দিতেন। বলতেন তুলসীগাছ হলো হার্বের রানি। আমাদের লাংস এর জন্য তুলসীপাতার রস  তো বটেই তুলসীগাছ এর উপস্থিতিও খুবই উপকারী। সেজন্য প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে তুলসীগাছ  ব্রিদিং লেভেল বা বুক বরাবর  উঁচু বেদিতে লাগানো হয়। ওনার একবার সর্দি-কাশি সারছিলো না। ডক্টর বলেছেন সকালে কিশোরদা যেখানে বসে পেপার পড়েন সেখানে একটা তুলসীগাছ রাখতে।

এমন ছোট ছোট কিন্তু খুব সুন্দর ব্যাপার উনি খুব সহজে ছড়িয়ে দিতেন। স্টুডিওর সাহায্যকারী, ম্যানেজার সবাইকে এমন আদর করতেন তা বলার বাইরে। এক কাপ চা চাইতেও খুব আপন করে বলতেন আইয়ুব এক কাপ চা দে তো বাবা!

আমাদের সুরসম্রাট আলাউদ্দিন আলী ভাই-এর চেয়ে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই বয়সে ছোট অথচ আলী ভাই কিশোরদাকে আপনি করে বলতেন আর বুলবুল ভাই কিশোরদাকে তুই করে বলতেন। আমি হা করে এর রহস্য উদঘাটন এর অপচেষ্টা করতাম।

কত কিছু যে মনে পড়ছে। তিন-চার বছর আগে অনেকগুলো স্কুলের একশো বছর পূর্তির হিড়িক লাগলো। আমি আর কিশোরদা একচেটিয়া সেই অনুষ্ঠানগুলো করতে করতে সারা বাংলাদেশ ঘুরতে লাগলাম। কিশোরদা মজা করে বলতেন আহা, সেই সময় মানে একশো বছর আগে  প্রতি পাড়ায় পাড়ায় স্কুল হলো না কেনোরেএএএএ! তাহলে তো জীবন পার হয়ে যেতো অনুষ্ঠান করে করে!

গানের তৃষ্ণা তাঁর কখনওই মিটতো না। মিরপুর থেকে শ্রুতি স্টুডিওতে ঠিক সময়মতো আসতেন। কত যে হাবিজাবি গান গেয়েছি, নকল গানও গেয়েছি। দুইজন চোখ চাওয়া চাওয়ি করলে রেকর্ডিং-এর সময় চুপিচুপি বলতেন একদিন না গাইলে দম আটকে আসে রে! গাই, হয়তো এই গানটাও ভালো গান হয়ে উঠবে।

রাজশাহী গেলে যাদেরই অনুষ্ঠান হোক কিশোরদা হোস্ট হয়ে যেতেন। কী আদর যত্ন, রাজশাহী সিল্ক গিফট করা, কলাইরুটি খাওয়ানো, পদ্মার পাড়ে বেড়ানো, এই স্পেশাল চা, ওই গরম মিষ্টি এগুলো করতেন। ফেরার পথে একগাদা ডালের বড়ি, ডুমুর, আম এগুলো দিয়ে দিতেন, আহা!

একবার পদ্মার পাড়ে আমরা ব্যাটারি চালিত রিকশায় চড়লাম।কিশোরদা সামনে ড্রাইভার এর সাথে বসলেন।আমি পেছন থেকে সামনের লুকিং গ্লাসে কিশোরদার ছবি তুললাম। সে এক ঐতিহাসিক ছবি! সেই ছবিটি কমেন্টে দিলাম

একবার জামালপুর গেলাম দেওয়ানগঞ্জ একটা স্কুলের একশো বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে। ট্রেনে সে কী খাওয়ার বহর! কী নাই সেখানে, আল্লাহ!  কিশোরদা একলাই নানা খাবারের সাথে বারোটা ডিম সিদ্ধ খেলেন! আমরা হা!

কোলকাতায় কোলকাতার ছবিতে গাইতে গিয়ে একসাথে ছিলাম কয়দিন।কিশোরদার মজা করে খাওয়া তখন আমি প্রথম দেখি।বিস্ময় আমার কাটেনা।পরে আমার হা করে থাকা দেখে বলতেন শোনো আমি শুধু খাইনা, ব্যায়াম ও করি নিয়মিত এবং প্রানায়াম ও রেয়াজ। এই খাবার এমনিতেই হজম হয়ে যায়।আমার বিস্ময় কাটে।

এত হাসিখুশি মানুষটা,  আমার কন্যা ফারিয়ার গায়ে হলুদে যখন লীনু ভাই, খুরশিদ আলম ভাই, রিজিয়া আপা, আবিদা আপা, দিনাত মুন্নি, সুবীরদা, বৌদি সবাই নাচছিলো কিন্তু কিশোরদা খুবই লজ্জা পেলেন। তাকে কেউ নাচের ভেতর নিতেই পারলো না!

আমার বাসায় এক রেকর্ডিং থেকে আরেক রেকর্ডিং-এর ফাঁকে এসেছিলেন আধাঘন্টা রেস্ট নিতে। আমি চট করে ফ্রেস মিক্সড ফ্রুটস চাট মসলা আর দই মিলিয়ে খেতে দেয়ায় খুব অবাক হলেন, বললেন আরেএএএএ এই ফলার তুমি কই থেকে শিখলে! এটা আমার মায়ের হাতের ফলার।তুমি জানো এটা কত উপকারী!

আমাদের কথা ছিলো বাচ্চাদের জন্য গান গাইবো। আমি বাচ্চার কণ্ঠে। উনি বাবার কণ্ঠে।পালটাপালটি ছড়া আরকি।

তা আর হলো কই!


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন