Select Page

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: নিরুপায় মানুষের বাস্তুচ্যুতির ছায়াছবি

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: নিরুপায় মানুষের বাস্তুচ্যুতির ছায়াছবি

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ নিবিড় খাটুনি ও নিষ্ঠার এক অনবদ্য দলিল। মুহাম্মদ কাইউমের বানানো (কাহিনি, পরিচালনা ও প্রযোজনা) এই ছায়াছবিটির দৃশ্যবিন্যাস চোখ আঁকড়ে রাখে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে পর্দায় চলমান দৃশ্যে পানি আর পানিহীন ফসলের প্রান্তর আর ফসলহীন মাঠের চরাচর। তবুও দর্শককে তা বেঁধে রাখে। সম্প্রতি জলপ্রবাহকে পটভূমিতে রেখে পরপর কয়েকটা ছায়াছবি বানানো হয়েছে। রহস্যময়তা থেকে শুরু করে প্রামাণ্যধর্মিতা সেসব ছবির গল্পরেখার বৈশিষ্ট্য। ছায়াছবির এই জলমগ্নতা হয়তো কাকতালীয় হবে। তবে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবিটা যে কারণে এগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র তা হচ্ছে এর গল্পপ্রবাহের ‘অনাট্যিকতা’ এবং তীব্র আটপৌরে বৈশিষ্ট্য ‘মানডেইননেস’।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ভোক্তা লোকজনের একাংশ মাঝেমধ্যেই ‘জীবনঘনিষ্ঠ’ ইত্যাদি অভিধা দিয়ে ছায়াছবিকে অলংকৃত করেন। এসব বিশেষণ বুঝতে আমার বরাবরই খুব অসুবিধা হয়। জীবনবিমুখ ছায়াছবি তেমন চিনি না বলে। সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝতে পারি যে এসব সিনেবোদ্ধা আসলে বাস্তবতাবাদী কিছু ছায়াছবিকে এই নামে অভিহিত করতে চান। প্রথমে বিকল্পধারা, পরে স্বাধীন ধারা এসব চর্চার মধ্যে ‘আর্ট বনাম কমার্স’ সিনেমাতর্কের মধ্যকার একটা সিনথেসিস হিসেবেই এই বিশেষণকে দেখা দরকার সম্ভবত। আর সাদাসিধা মানে হতে পারেÑসম্ভবত গরিব লোকজনকে প্রটাগনিস্ট বানিয়ে তৈরি করা ছবি। এর বাইরে নতুন এক উপদ্রব হয়েছিল ‘নৃবৈজ্ঞানিক’ বিশেষণ নিয়ে। শিল্পচর্চায়, বিশেষত চলচ্চিত্রীয় চর্চায় এই অভিধাটা কমবেশি ‘এক্সটিক মর্যাদা নিয়ে এসেছিল। আলোচ্য এই ছায়াছবিটি অত্যন্ত সংগ্রাম মুখর, দারিদ্র্যপীড়িত একটা অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির প্রায় বার্ষিক ঋতুচক্রের দুর্দান্ত একটা দৃশ্য দলিল হয়ে পড়েছে। চিত্রায়ণকে দেখা গেছে যাপিত জীবনের সমান্তরালে, আনুভূমিকভাবে, অনুচ্চভাবে। এর নাম যা ইচ্ছা তা দিতে পারেন দর্শককে ‘জীবনঘনিষ্ঠ’ বা ‘এথনোগ্রাফিক’ বা ‘বাস্তবতাবাদী’ যাই বলতে চান। নেহাত বর্গীকরণের বিষয় এটা নয়। নির্মাতা/গণমনুষ্য জীবনের উপলব্ধির প্রসঙ্গ এটা।

জনাব কাইউমের অন্তত তিনপ্রস্থ জীবনবৃত্তান্তের মধ্যে প্রথমটির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তিনি জাহাঙ্গীরনগরে আমার বেশ আগে পড়তেন এবং বাম রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি যত্নবান প্রকাশক হিসেবে আমার পরিচিত হন। তার নিষ্ঠা ও যত্নে একবার প্রকাশিতও হয়েছি আমি, ২০০৩ সালে।

তৃতীয় দফায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেচে দিয়ে তিনি কিছুদিন চাকরি করেন, তারও পরে ছবি বানানোতে হাত দেন। সেটা জানতাম। ছবি বানানো শেষের খবরও পেয়েছিলাম বেশ আগে। সেই ছবির প্রিমিয়ার দেখা হলো ২৯ অক্টোবর, শনিবার। সীমান্ত সম্ভারের সিনেপ্লেক্সের তিন নম্বর পর্দায়। গত বছরগুলোতে তিনি ছবি বানাচ্ছিলেন। এর মধ্যে করোনার পরিস্থিতি গেছে। তিনি ঠিক কী বানাচ্ছিলেন তা নিয়ে কৌতূহল থাকলেও কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, ফোনে বা মেসেঞ্জারে।

‘গল্প’ আছে, যদি তা ধরে নিই, তাহলে সেই গল্পটা অতিশয় হৃদয়গ্রাহী, মর্মস্পর্শী, মায়াজাগানিয়া। তবে আমি সেই দলে নই যারা কাহিনিচিত্রে ‘গল্প’ থাকতেই হবে মনে করেন। আবার প্রায় যেকোনো বিবরণীতেই যে ‘গল্প’ আছে সেই মনে করাকরিও আমার আছে। এই ছবির নির্মাতার কিছু স্পষ্ট গল্পবোধ টের পাওয়া যায়। তাতে সূক্ষ্মতা আছে, মমতা আছে, নৈর্লিপ্তিও আছে। তবে সম্ভবত এই গল্পটা দর্শকের কাছে আনতে গিয়ে কিছু জায়গায় আরও কম ‘অভিনয়ে’ পরিচালক সন্তুষ্ট থাকলে ভালো হতো বলে মনে হয়। রুকুর ছোট বোনটি পানিতে ডুবে যাওয়া যেমন নিরুত্তাপ সামলেছেন নির্মাতা, আর তাই তা দুর্দান্ত হয়েছে; অভিমানী রুকুকে সুলতান ও রুকুর মা খুঁজে পাওয়ার পর মিলন দৃশ্যে সেরকম নৈর্লিপ্তি রাখেননি নির্মাতা। হয়তো রুকুর দাদার মাধ্যমে সমাজ-সংহতি নিয়ে অত বক্তৃতাও দরকার ছিল না। ওই জায়গাগুলো বাণীধর্মী হওয়ার ঝুঁকিতে থেকেছে। রুকুর মুখে কুড়া পক্ষীর গল্পটাও বিশদভাবে বিবরিত। দর্শক এর থেকে কমে সামলাতে পারতেন। আর সেটা ঝকঝকে হতো বলে আমার মনে হয়।

সংগীত/আবহসংগীত জায়গায়-জায়গায় দুর্দান্ত; জায়গায়-জায়গায় কোলাহলপূর্ণ বলে আমার কানে লেগেছে। কিন্তু দুর্দান্ত জায়গাগুলো বরং বলি। মোটের ওপর জোড়া ঢাকের ব্যবহার (তাই তো?!) এবং মাঝামাঝি সময়ে রুকুর মায়ের স্বামী বিয়োগের ও পিতামাতার সংবাদ না পাওয়ার বেদনার ওপর পানির তেপান্তরে যে গান এসেছে, কলিজা কাঁপানো। বিয়ের গানটাও অনবদ্য। কারা গেয়েছেন এক্ষুনি জানি না। কিন্তু আগ্রহ জাগিয়েছেন। এই ছবির আবহসংগীত ও শব্দের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা অনবদ্য। তবে সম্ভবত নৈঃশব্দ্যেরওপর আরেকটু ভরসা রাখলে চারপাশের পানি আর সুতীব্র মনুষ্যজীবন আরও তীক্ষèভাবে অর্থবহ হতো।

কিন্তু এই ছায়াছবিটা কেবল দৃশ্যের কারণেই, কেবল ভূচিত্র, ঋতুচক্র, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার চিত্ররূপ দিতে পারার জন্যই আমাদের সমকালের অত্যন্ত জরুরি একটা ছায়াছবি হয়ে থাকবে। অভিনয় বা চিত্রনাট্য বা সংগীত নিয়ে আমার নিন্দামন্দগুলো দুয়েক বছর মুলতবি রাখা যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, চিত্রের যে বাজার ও ব্যবস্থাপনা, তাতে ভরসা রাখা কঠিন যে কত লোকে ছবিটা দেখবেন। এই ছবির নির্মাতা, কলাকুশলীদের (পরলোকগত গাজী মাহতাব সমেত) দর্শক পাওনা হয়ে গেছে।

তারপর সত্যিই যদি দর্শকেরা পর্দার সামনে বসে এই ছায়াছবিটা দেখতে বসেন, তারা হাওড়ের পানির ঢেউয়ের মধ্যে ট্রলারে বসে যেনবা দুলতে থাকবেন সুলতান, রুকুর মা প্রমুখের সঙ্গে। অবধারিত শ্রমবাজারে শ্রম বিক্রির জন্য রওনা দিয়েছে এই সহজ নিয়মে দুরূহভাবে গড়ে-ওঠা পরিবারের সদস্যরা। তারা পর্দায় আপনার থেকে দূরবর্তী হতে থাকবেন পানির মধ্যে। কিন্তু যদি নির্মাতা তাদেরকে আপনার দিকে নিয়ে আসতেন সেটাও একই রকম প্রাসঙ্গিক হতো। কারণ ফসল-বঞ্চিত, ঢল-পীড়িত আর দারিদ্র্য-জর্জর মানুষেরা আসলে আপনার শহরেই আসছেন।

প্রথম প্রকাশ: সময়ের আলো, নভেম্বর ২০২২


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন