Select Page

কৈশোর-যৌবনের প্রেমিকা মনিকা শুধুই স্মৃতি!

কৈশোর-যৌবনের প্রেমিকা মনিকা শুধুই স্মৃতি!

অনেকেই আমার কাছে ‘মনিকা’র গল্প শুনতে চেয়েছিলেন, অনেক দিন ধরেই। বিএমডিবির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ওয়াহিদ সুজন ভাই ফোনে আলাপের একপর্যায়ে মনিকা সম্পর্কে লিখতে বলেছিলেন, কারণ ওনার কাছেও নাকি অনেকে জানতে চেয়েছিলেন।

আমরা মনিকা সিনেমা হলে ছবি সংগ্রহ করতে পারি নাই। এ ক্ষেত্রে দর্শক আমাদের সাহায্য করতে পারেন

মনিকা হলো আমার অসাধারণ কৈশোর, যৌবনের অসংখ্য স্মৃতিময় এক প্রেমিকা যার অস্তিত্ব আজ শুধুই আমার সব সুখস্মৃতি জুড়ে, বাস্তবে নেই।

শৈশবে বাবা-মা, খালাদের মাধ্যমেই মনিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। সেই থেকে কত শতবার যে মনিকার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম তা গুনে বলতে পারবো না। কৈশোরে কখনো একা একা, কখনো বন্ধুদের নিয়ে দলবলসহ মনিকার কাছে যেতাম।

মনিকার সঙ্গে ঠিক কবে, কখন প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেই দিনক্ষণটা ঠিক বলতে পারবো না। তবে এইটুকু মনে আছে ওয়াসিম-অঞ্জনার সাদাকালো কোন একটি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম পরিবারের সঙ্গে।

সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ পার হয়ে কানিশাইল রোডে একটু ভেতরে ঢুকলেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মনিকা বা সবার প্রিয় মনিকা সিনেমা হল। ওই রোডের এক সময় নামই হয়ে গিয়েছিল মনিকা সিনেমা রোড। মনিকায় যাবো বললেই রিকশাওয়ালা চোখ বন্ধ করে সিলেট শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে সোজা হলের সামনে নিয়ে আসতো।

মনিকায় শত শত সিনেমা দেখেছিলাম; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— দুই পয়সার আলতা, কসাই, ঈমান, কুরবানি, অভিযান, দেশ বিদেশ, নেপালী মেয়ে, তুফানমেইল, অস্বীকার, লড়াকু, অপেক্ষা, বিরোধ, বীরপুরুষ, মারকশা, শুভদা, শরীফ বদমায়েশ, জীবনধারা, আইন আদালত, জেল হাজত, প্রহরী, দুর্নাম, শর্ত, দুনিয়া, ব্যবধান, হিসাব চাই, বাপের বেটা, ঝিনুকমালা, শিমুল পারুল, স্ত্রী স্বপ্ন, স্বামীর আদেশ, হালচাল, আক্রোশ, মর্যাদা, ভাইজান, বজ্রপাত, লাখে একটা, বিস্ফোরণ, আমিই শাহেনশাহ, বিপ্লব, বজ্রমুষ্ঠি, আজাদ, ইনকিলাব, ঘেরাও, টপ রংবাজ, চাঁদনী, সন্ত্রাস, মা মাটি দেশ, লাভ ইন আমেরিকা, অর্জন, চোখের পানি, ত্রাস, চাঁদাবাজ , মায়ের কান্না , রুবেল আমার নাম, অকর্মা, দিনমজুর, উত্থান-পতন, সোহরাব রুস্তম, কারণ, বিশাল, ঘরের শত্রু, শত্রু ভয়ংকর, গরীবের বন্ধু, আন্দোলন, রুটি, আগুনের পরশমণি, কমান্ডার, ঘাতক, মাটির কসম, ভয়ংকর সাতদিন,  চরম আঘাত, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, প্রেম দিওয়ানা, ডিসকো ড্যান্সার, আত্ম অহংকার, স্বজন, রাগ অনুরাগ,  লড়াই, সম্পর্ক, প্রেমযুদ্ধ, বিচার হবে, দেনমোহর, হুলিয়া, প্রিয় তুমি, মুক্তির সংগ্রাম, দোস্ত আমার দুশমন, কে আমার বাবা, বিষদাঁত, মূর্খ মানব, লৌহ মানব, ঘেরাও, বীরযোদ্ধা, আখেরি মোকাবেলা, শেষ খেলা, পাগল মন, বালিকা হলো বধূ, সাক্ষী প্রমাণ, স্ত্রী হত্যা, খলনায়ক, বিদ্রোহী কন্যা, সত্যর মৃত্যু নেই, মায়ের অধিকার, ভণ্ড,  লুটতরাজ, তেজী, ধর, নায়ক, ভিলেন, পাগলাঘণ্টা, নরপিশাচ, শান্ত কেন মাস্তান, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, লাঠি,  কুখ্যাত খুনী, ভয়ানক সংঘর্ষ , জীবন এক সংঘর্ষ, জানের দুশমন, আজকের সন্ত্রাসী, খবর আছে, ইতিহাস,  বর্তমান, ঈমানদার মাস্তান, টপ সম্রাট, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা  এবং  ব্যাচেলর।

সেই সময় আমার মতো নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কাছে মনিকা সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল মার্শাল আর্ট হিরো রুবেলের সিনেমাগুলোর জন্য। কারণ রুবেলের যে সিনেমাই মুক্তি পেতো সেটা মনিকায় প্রদর্শিত হতো মুক্তির দিন বা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। এ সফলতা দেখে পরবর্তীতে সিলেটের অন্যান্য সিনেমা হলগুলোও ধীরে ধীরে রুবেলের সিনেমা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নামে।

আরেকটা ব্যাপার হলো, তৎকালীন সময়ের বক্স অফিস কাঁপানো বছরের সেরা সব সিনেমাগুলোই মনিকায় প্রদর্শিত হতো যেমন; লড়াকু, বিপ্লব, বজ্রমুষ্ঠি, পাগল মন, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, তুমি আমার, বিক্ষোভ, প্রেম দিওয়ানা, শান্ত কেন মাস্তান, খবর আছে, তেজী, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, কুখ্যাত খুনী, ইতিহাস, শ্রাবণ মেঘের দিনের মতো আরও অসংখ্য বছরের সেরা ব্যবসা সফল সিনেমা মুক্তির পর সিলেটের মনিকা সিনেমা হলেই প্রদর্শিত হয়েছিল। মনিকা প্রথম সপ্তাহে যে সিনেমা প্রদর্শন করতো ঠিক একই সিনেমা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সুরমা নদীর ওপারে থাকা একমাত্র সিনেমা হল কাকলী প্রদর্শন করতো। কোন কারণে প্রথম সপ্তাহে কোন নতুন সিনেমা দেখা মিস করলে সেটা দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা কাকলীতে দেখতাম।

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দর্শকদের দীর্ঘ সারি, ব্ল্যাকারদের  এই লাগবো ডিসি, ডিসি আওয়াজে মুখরিত থাকতো মনিকা সিনেমা হলের চারপাশ। একদিন মনিকাকেই কেন্দ্র করেই আশপাশের চায়ের দোকান, অডিও ক্যাসেটের দোকানগুলো রমরমা ব্যবসা করেছিল। কত দিন স্কুল পালিয়ে, কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছি তার হিসাব নেই। আজ মনিকা সিনেমা হল নেই। আজ সেখানে গড়ে উঠেছে মিনারেল ওয়াটারের কোম্পানি। আজ মনিকার আশপাশে থাকা দোকানগুলোর রমরমা ব্যবসাও নেই। নেই সকাল থেকে গভীর রাত অবধি লোকজনের আনাগোনা। চারদিকে সুনসান নীরবতা, সবার মাঝে শুধু দীর্ঘশ্বাস। আজ মনিকা সিনেমা হল শুধু আমার মতো সেদিনকার অসংখ্য সিনেমা দর্শকদের কাছে শুধুই সুখস্মৃতি; যা আর কখনো ফিরে পাবো না এবং আর কোন প্রজন্ম মনিকা সিনেমা হলকে পাবে না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন