কোক স্টুডিও বাংলা: ‘লীলাবালি’র উৎস নিয়ে মৌসুমী ভৌমিকের প্রশ্ন
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুবই জনপ্রিয় একটি গান ‘লীলাবালি’। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এই গ্রামীণ বিয়ের গানের ব্যবহার অর্ধ শত বছরের বেশি। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বা ইবনে মিজানের ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’ বা হুমায়ূন আহমেদের ‘দুই দুয়ারী’ সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে। এছাড়া অসংখ্যবার একক ট্র্যাক আকারে রেকর্ড করা হয়েছে। সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলা রিমেক করেছে গানটি। সেখানে ব্যবহৃত শব্দ ও রচয়িতা নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা করেছেন বিখ্যাত গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক। তুলেছেন কিছু প্রশ্নও। পড়ুন লেখাটি—
তুমি খুশি থাকো
Innocently ই দিনটা শুরু হয়েছিল। এমনিই একটা গান শুনছিলাম, পরজীবী শহরের গান, ভাবছিলাম কী স্বচ্ছন্দে গান গায় এই মেয়েটা, মাশা ইসলাম, such an enormous talent. আরও ইন্টারেস্টিং লাগে আমার এই গানটা কারণ ওতে ঠিক আমার একটা গানের মতন কিছু লাইন রয়েছে, ‘আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?’ কিন্তু ভিন্ন কন্টেক্সটে, ভিন্ন তাগিদ থেকে লেখা। আমি সেই সব ভাবছিলাম। সময়ের কথা ভাবছিলাম, সময়ের উচ্চারণের কথা। তারপর এটা সেটা দেখছিলাম। (আমার যখন লেখার ডেডলাইন থাকে আমি তখন না লিখে এভাবে সময় নষ্ট করি। তারপর stressed হয়ে যাই।)
কিন্তু যাই হোক, আস্তে আস্তে সকালটা সিরিয়াস হয়ে গেল কী ভাবে যেন। হেই সামহালোর রিহার্সালের ভিডিও, তারপর লীলাবালি… এবং আমি আটকে গেলাম।
১৯৭৩-এর তিতাস একটি নদীর নামে ঋত্বিক ঘটক এই গানটা ব্যবহার করেছিলেন, মানে লীলাবালি। কোথায় পেয়েছিলেন আমি জানি না, আছে হয়তো কোথাও লেখা, আমি অত ডিটেল তো জানি না। তবে বিয়ের গীত হিসেবেই নিশ্চয় পেয়েছিলেন। উনি এপার ওপারের কত শিল্পীর সঙ্গেই তো কাজ করেছেন। আর নিজেও সারা জীবন ভাগ হয়েই থেকেছেন, অনসূয়াসম। ১৯৭৩-এর আগে কেউ এই গান আর কোথাও ব্যবহার করেছেন কি না জানি না। প্রথম খটকা লাগলো, Accredited to Radharaman দেখে। কী জানি? এমন evidence তো অনেক খুঁজে কোথাও পেলাম না।
তিতাসে ঋত্বিক অজস্র গান ব্যবহার করেন, সিনেমাটাই যেন একটা মহাফেজখানার মতন। সেটা উপন্যাসের কারণেই। উপন্যাসে আরো বেশি গানের কথা আছে। তবে, এ কথা আমি মানি যে ১৯৭৩-এ একজন ফিল্মমেকার যদি একটা আঞ্চলিক বিয়ের গান তাঁর কাজের ভিতরে রাখতে পারেন তাহলে তার পঞ্চাশ বছর পর এ যুগের বহু গুণী শিল্পীর সমাবেশে, কোক স্টুডিও বাংলাতে সেই গান তাঁরা তাঁদের মতন করে ব্যবহার করবেন, কিছুই সেখানে বলার থাকতে পারে না। স্বপন বসু গেয়েছেন, লোপামুদ্রা, if they could, then so can Coke. It is alright. শোনা না শোনা আমার ওপর, এখন অনেক চয়েস দুনিয়াতে, শোনার বা না শোনার স্বাধীনতাও খানিক কিনতে পাওয়া যায় বাজারে (যদিও আসলে আমাদের শোনার দেখা কোনো freedomই নেই আর, আমরা বাধ্য হই দেখতে, পড়তে শুনতে, কিন্তু সেটা একটা ভিন্ন আলোচনা)
It is alright, it is alright, আমি নিজেকে বলি। হেই সামহালোই পার হয়ে গেল, তেভাগা, বনবিবি, হইহই করে পার হলো। সেখানে এই লীলাবালি তো তুশ্চু। People love it. Millions love it. একটা বিশাল, বি-শা-আ-ল ইন্ডাস্ট্রি, বিশাল এবং বিশ্বায়িত আমরা এখন । সত্যি কথা বলতে কী, এত আনন্দ আমি কোথা রাখি নাথ?
অসুবিধা আমার একটা ছোট জায়গায়। আর তা নিয়ে আমার সারাটা দিন আমি কাটিয়ে দিলাম। নতুন সংস্করণে ‘বালি, লীলা, লীলা, বালি, বালি, বালি, লীলা লীলা, …’ একরকমের prelude দিয়ে শুরু হয়, খানিক লোপাকে অনুসরণ করে। চলুক, অসুবিধা নাই। মুশকিল হলো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। সাবটাইটেল আসতে শুরু করেছে। আমি জানতাম কথাটা তো বড় যুবতী । তাই খটকা লাগে। বড় যুবতী? ভর-যুবতী, in her fullness of youth? আমাকে কেউ শুধরে দেন। বর অয়ুবাতি, অর্থাৎ groom is coming. আশা করি তিনি ঠিক বলেছেন। ময়মনসিংহের ভাষা বললেন। আমি খুঁজে যে টেক্সট পেয়েছিলাম তাতে বড় যুবতীই ছিল। আর কোকের সাবটাইটেলেও বর (বড় নয়) যুবতী আছে। কিন্তু আমি নিশ্চয় ভুল বুঝছি । তাই আমি আমার সংশয় নিয়েই বাকি কথা লিখছি।
আমি interpretation নিয়ে কিছু বলছি না। বেসিক কথাগুলো নিয়ে বলছি।
তিতাসের খুব ভাল একটা প্রিন্ট পাওয়া যায় archive.org-এ, লীলাবালি গানটা দোলের পর কিশোরের হঠাৎ বিয়ের দৃশ্যে আসে, সে দৃশ্য একদম সাবলাইম। So intense, so physical. আসে, এসে মিলিয়ে যায়। সাবটাইটেলে লেখা আছে, ‘Beloved bride, how shall I adorn you?’ And that is what it is. It is a song about adorning the bride. It is a women’s song, and it is a song about that inner courtyard of women. An exclusive space. বর যুবতী, অথবা বড় যুবতী অথবা ভরঅ যুবতী অথবা বর অয়ুবাতি, যাই হোক, এই exclusive space সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায় এই মঞ্চায়নে।
রাধারমন প্রসঙ্গে আমি সুষমা দাস মাসিমাকে ফোন করলাম। এই একটু আগে। মাসিমার এখন ৯৩। ওঁকে যারা চেনেন না, দেখে নেবেন, সিলেটে থাকেন। একুশে পদক পেয়েছিলেন বলে না, এত বড় একজন শিল্পীর খবর একটুখানি জানলেও আসলে পূণ্য হয়, সুখ দুঃখের খবর রাখলে তো বাড়তি সোয়াব হয়। মাসিমা বললেন, এই গান এক শ’ ভাগ রাধারমনের না। এই কথা বললেন, আমি ফোনের কথা রেকর্ড করে রাখলাম। আসলে, কতদিন আর শুনতে পাবো জানি না তো। ওঁর কথা শুনতে পাওয়াও আমার আশীর্বাদের মতন লাগে। কথা তো লীলাবালিতে আটকে থাকে না, একথা সে কথা, এ গান সে গান, একটা জীবন্ত কথা-বলা আর্কাইভের ভিতরে ঢুকে যাই যেন।
কেউ লিখেছেন এই গান হুমায়ূন আহমেদের। দেখলাম দুই দুয়ারি সিনেমার গানের ভিডিও, তাতে তেমনই লেখা আছে। ঠিকই আছে, Whatsapp Universityতে এমনই পঠনপাঠন চলে, অসুবিধা নাই। দিন তো ভালই চলে যাচ্ছে। আমরা সবাই হ্যাপি থাকছি।