Select Page

নন্দিত গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক খন্দকার নূরুল আলম

নন্দিত গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক খন্দকার নূরুল আলম

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রের প্রথম সুরকার ও সংগীত পরিচালক কে বলতে পারবেন? বলতে পারবেন কি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে সাহিত্যনির্ভর গল্প থেকে যতগুলো দর্শক ও সমালোচক নন্দিত চলচ্চিত্র হয়েছে তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রের সুরকার ও সংগীত পরিচালক কে ছিলেন?

জানি, প্রশ্ন দুটো এই প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষগুলোর কাছে বেশ কঠিন হয়ে গেছে। চোখ যে মনের কথা বলে, তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে, এত সুখ সইবো কেমন করে, আমার সকল চাওয়া তোমাকে ঘিরে, পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরণা বলো, কাঠ পুড়লে কয়লা হয়— এমন সব কালজয়ী গানের সুরস্রষ্টা খন্দকার নূরুল আলমকে আমরা ভুলে গেছি।

১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়ী মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন খন্দকার নূরুল আলম। বাবা নেসারউদ্দিন খন্দকার ও মা ফাতেমা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। বাড়ি পাশেই ছিলো সাওতাঁলিদের পাহাড়। সেখান থেকে ভেসে আসা সুর হয়তো কিশোর নুরুল আলমকে দোলা দিতো। মাকে হারান ১৯৪৮ সালে, ১২ বছর বয়সে। একই বছর পুরো পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে চলে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ১৯৫৯ সালে বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন খন্দকার নূরুল আলম। ১৯৬০ সালে তিনি ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ (এইচএমবি) গ্রামোফোন কোম্পানিতে সুরকার হিসেবে যোগদান করেন। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

‘ইস ধরতি পার’-এর মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হন এই যশস্বী সুরস্রষ্টা। ১৯৬৮ সালে ‘অন্তরঙ্গ’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’ বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সে সময় ‘যে আগুনে পুড়ি’র ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর আর থেমে থাকেননি, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ‘ওরা ১১ জন’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন খন্দকার নূরুল আলম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রায় ছয় শতাধিক গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন।

১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের মেয়ে কিশওয়ার সুলতানার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

বাংলা চলচ্চিত্রে প্রায় সব সুরকারের বিরুদ্ধে নকল সুরের গান করার অভিযোগ আছে কিন্তু খন্দকার নূরুল আলম ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম যার কোন গানের সুর নকলে অভিযোগে অভিযুক্ত হয়নি। অসংখ্য কালজয়ী ছবিতে রয়েছে তার সুর করা ও গাওয়া গান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— অন্তরঙ্গ, সংগ্রাম, জলছবি, তৃষ্ণা, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা, বিরাজ বৌ, পদ্মা মেঘনা যমুনা, শঙ্খনীল কারাগার প্রভৃতি। ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’,  ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ ও ১৯৯১ সালে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ চলচ্চিত্রের সংগীতে অবদানের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন।

গীতিকার মো. রফিকউজ্জামানের লেখা ১০০ গানের সুরকার তিনি। সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন, নিলুফার ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দীর মতো দেশসেরা কন্ঠশিল্পীরা তার সুর করা গানে কন্ঠ দিয়ে হয়েছিলেন জনপ্রিয়। তার সুরে ক্লাসিক্যাল ও মেলোডিয়াসের সংমিশ্রণ থাকতো বলেই অধিকাংশ গানগুলো যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি কণ্ঠে তোলা বেশ কষ্টসাধ্যও।

সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কার’সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন খন্দকার নূরুল আলম।

২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি এ গুণী সঙ্গীতজ্ঞ ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আজকের প্রজন্মের শিল্পীদের সৌভাগ্য হয়নি ক্লাসিক্যাল এই সুরকারের সাথে কাজ করার।

চোখ যে মনের কথা বলে

ভুল যদি হয় মধুর এমন

তুমি এমনই জাল পেতেছো

এতো সুখ সইবো কেমন করে

আমার সকল চাওয়া

আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে

ফুলের আড়ালে ছিলো

ঐ রাত ডাকে

এক দমেতে সাধু দুই দমে সন্ন্যাসী

 


মন্তব্য করুন