গল্পটা আরিফিন শুভর
আরিফিন শুভ-র জার্নি একটা সময় থেকে আর একটা সময়ের উত্তরণ পর্যন্ত সাফল্যের পরিণত গল্প। এ গল্পটিতে আসতে পর্যায় আছে বিভিন্ন।
অনেকে ভাবে একজন নায়ক সরাসরি চলচ্চিত্রে তার সাফল্য আনতে পারে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই। সেরকম খুব কম ঘটে। যারা সরাসরি চলচ্চিত্রে আসে তাদেরও পাড়া-মফস্বলে কোনো না কোনো অভিনয়ের মঞ্চ বা ক্ষেত্র থাকে যেখানে হাতেখড়ি হয়। তাও যদি না হয় তবে গড গিফটেড ছাড়া আর কিছু বলা যায় না তাকে। কিছু তারকার উত্থানে ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে অন্য মাধ্যমের। সেখানে তার ভিত্তিটা তৈরি হয়। অভিজ্ঞতার জন্য দরকার হয়। চলচ্চিত্র অন্য সব মাধ্যম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাই এখানে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করতে হয়। আরিফিন শুভ-র চলচ্চিত্রে আগমনের গল্পে পূর্বের রেশটা বড় ফ্যাক্টর।
কিছু লোক একটা বিষয় বড় ভুল ব্যাখ্যা করে। তারা বলে থাকে, ‘যারা নাটক করে তাদেরকে চলচ্চিত্রে মানায় না। কিংবা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নাটক করলে তাকে ছোট ভাবা হয় অথচ নাটক বড় শিল্পের অংশ। নাটকের অ্যাটিচিউডটা চলচ্চিত্রে রাখলে তখন সমালোচনাটা চলতেই পারে। কিন্তু অভিনয়ের ভিত্তিটা আনতে নাটকের ভূমিকাও অনেক হতে পারে। আরিফিন শুভ-র ভিত্তিটা নাটক থেকেই। ramp-এ হাঁটার সময়টাও স্ট্রাগলড পিরিয়ড ছিল। আজকের ব্যস্ত প্রতিষ্ঠিত মীম-ও নাটক করত। মডেলিং করত দুজনেই। এগুলো তাদের ভিত্তি ছিল। শুভ-র নাটকের সংখ্যা ভালোই।বলতে গেলে ‘ঝগড়া, সিরিয়াস একটা কথা আছে, মাই ভ্যালেন্টাইন, বুলেট খান, শেষের কবিতার পরের কবিতা, অপেক্ষা, ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই, আমি শুধু মেয়েটাকে চিঠি দিতে চেয়েছিলাম, প্রশ্নবোধক, আমি হয়তো মানুষ নই’ এসব নাটক/টেলিফিল্মে তাকে লাইমলাইটে এনেছে। অভিনয়ের জায়গাটা পোক্ত হয়েছিল এগুলোতে। ববি-র সাথে হৃদয় খানের গাওয়া ‘ভেবে ভেবে’ মিউজিক ভিডিওতে নায়কোচিত বৈশিষ্ট্য ছিল। উল্লেখ করা ভালো ‘বুলেট খান’ নাটকটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। এ নাটকে স্টারডমকে বাজেভাবে যারা ব্যবহার করে পরিবার ও দর্শককে ছোট করে দেখে তাদের জন্য মেসেজ আছে। শুভর একটা সংলাপ ছিল ঐ নাটকে-‘আমি বুলেট খান একটাই। আর হবে না এদেশে।’ এই আত্ম-অহংকার স্টারডমের জন্য ক্ষতিকর কারণ অহংকার পতনের মূল। পরে বুলেট খান নিজের দরকারেই পরিবর্তন হয় কারণ আপনজনের সাথে দূরত্ব তৈরি করে বাঁচা যায় না। এরকম প্লট থেকে ছবি হওয়া সম্ভব। এমনকি ‘ভালোবাসি তাই’ টেলিফিল্মে বিন্দুর বিপরীতে কর্পোরেট অফিসের শুভর গেটআপ এত অসাধারণ ছিল যে তা প্রশংসনীয়। নাটকটিতে সিনেমাটিক বৈশিষ্ট্য ছিল। পরের পার্ট ‘ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই’-তে সানজিদা প্রীতির বিপরীতে শুভর চরিত্রটি স্মরণীয়। মোটর সাইকেলে শুভ, প্রীতির সিকোয়েন্সে ব্রেক ফেলের পরে শুভ প্রীতিকে তার হেলমেট পরতে দেয় ভালোবাসার মানুষকে বাঁচানোর জন্য। যারা দেখেছে কেউই ভুলবে না। আরিফিন শুভ তখন পর্যন্ত চলচ্চিত্রে না আসলেও সে বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে ছিল। তারপর তার জীবনে চলচ্চিত্র-ই শেষ ঠিকানা হলো।
তো সিনেমার প্ল্যাটফর্মে আরিফিন শুভ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থেকে একটা অবস্থানে আসতে পেরেছে। সেটা তার নিজের গুণ। তার যাত্রাটা হয়েছে এমন সময়ে যখন ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে একজন নায়কের আধিপত্য বা বাস্তবতা ছিল। শুভ ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ দিয়ে ‘আমি নিঃস্ব হয়ে যাব’ গানটিতে হাইপ তুলতে সক্ষম হয়। তার হাইট, গেটআপ, নায়কোচিত অভিনয় সব মিলিয়ে দর্শকের আগ্রহ তৈরি করে। নায়ক হবার আগেই সে কিন্তু নেগেটিভ ক্যারেক্টারে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। শুভর এই অর্জনটি তাকে পরবর্তী ফ্লোর দেয় যার ফলাফল ছিল ‘ছায়াছবি, অগ্নি, কিস্তিমাত, ওয়ার্নিং, ছুঁয়ে দিলে মন, নিয়তি, অস্তিত্ব, মুসাফির’ ছবিগুলো। ‘জাগো’ দিয়েই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ‘ছায়াছবি’ যদিও মুক্তি পায়নি তবে গানগুলোতে পূর্ণিমার বিপরীতে নায়কোচিত ছিল গানগুলোতে। ‘অগ্নি’-তে নিজের অ্যাকশন পারফেকশন প্রমাণ করেছে যার পরবর্তী উদাহরণ ‘কিস্তিমাত, মুসাফির’ ও আপকামিং ‘মৃত্যুপুরী।’ ‘নিয়তি, অস্তিত্ব’ এ দুটি মানবিক আবেদনে চ্যালেঞ্জিং চরিত্র ছিল শুভর। ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর হিটের পরে ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর মতো সুপারহিট ছবি দিয়ে শুভও প্রমাণ করেছে ঢালিউডে বর্তমানে তার চাহিদাও প্রথম সারির। ‘ওয়ার্নিং, তাঁরকাটা, ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ এগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছবি। অনেক বড় বড় তারকাদের ক্যারিয়ারেও থাকে দুর্বল ছবি সেটাই চূড়ান্ত কিছু নয়।
একটা সাক্ষাৎকারে আরিফিন শুভ ইউটিউবকে তার শিক্ষক বলেছিল। নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়াতে ও সীমাবদ্ধতা কাটাতে অনেককিছুর সাথে জড়িত থাকত সে। শুভ তার পেছনের ফেলে আসা স্ট্রাগল পিরিয়ডকে অকপটে স্বীকার করে। নিজের চিন্তার জায়গায় সে সৎ। পার্সোনালিটি বজায় রেখে চলে। তার কাছে এগুলো শেখার আছে।
আরিফিন শুভ স্টাইল, ফ্যাশন, স্টারডম সব মিলিয়ে সচেতন তারকা ছিল। তার মধ্যে আপ-টু-ডেট দর্শকের সেন্স বোঝার একটা সচেতনতাও ছিল। একটা ক্রান্তিকালের নায়ক আরিফিন শুভ যখন একজন নায়কনির্ভর ঢালিউডে একঘেয়েমি চলছিল তখনই তার আগমন এবং নিজস্বতা দিয়ে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্ত মাঝখানে ‘ভালো থেকো, একটি সিনেমার গল্প’ ছবিগুলো করে লাইমলাইটের বাইরে চলে গিয়েছিল অনেকটাই। ‘সাপলুডু’ মুক্তি পেয়েছিল এর মাঝামাঝি। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছিল শুভর অন্যতম সেরা ছবি এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। টলিউডে ‘আহারে’ ছবি দিয়ে প্রশংসায় আসে শুভ এবং এ ছবি প্রমাণ করেছে শুভর মধ্যে কিছু একটা আছে। অভিনেতার বৈশিষ্ট্যে তাকে দেখা গেছে এ ছবিতে। এছাড়া ‘বালিঘর’ নামে আরো একটি ছবি সেখানে করার কথা। ‘মিশন এক্সট্রিম’-এর হাইপ দিয়ে আবার আলোচনায় চলে আসে এবং এ ছবি মুক্তির পর এখনো বিভিন্ন সিনেমাহলে চলছে। আনফিট থেকে সাধনা করে অ্যাবস তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল মাঝখানে। ডিজিটাল সময়ের ছবির তারকাদের মধ্যে এমন চেষ্টা বিরল। শুভ-র টক অফ দ্য মোমেন্ট হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করা। এটা তাকে আলোচনায় রেখেছে এখন। ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগাল অডিশনে শুভকেই বেছে নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন তা হয়তো ছবি নির্মাণের পর বোঝা যাবে কাজ দেখে আপাতত তাকে শুভকামনা জানানোই যায়।
শাকিব খানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ধারাবাহিক গ্রহণযোগ্যতার পরে ইন্ডাস্ট্রিতে নির্ভরশীল নায়কের অভাবটা পূরণ করেছে আরিফিন শুভ। সে এগিয়ে যাক। তাকে দেখে তার মতো আরো নির্ভরশীল নায়ক আসুক ইন্ডাস্ট্রিকে লিড দেবার জন্য। পাশাপাশি ক্যারিয়ারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে তাঁকে। ইমোশনের বশবর্তী হয়ে যাতে আর কোনো দুর্বল গল্পের ছবি সিলেকশন না করে।
আরিফিন শুভ অবশ্যই আধুনিক বৈশিষ্ট্যের একজন তারকা। তাকে হয়তো ঠিকঠাক কাজে লাগানোর মতো পরিচালক আমাদের বর্তমানে কম কিন্তু কাজে লাগাতে পারলে এই সময়ের নির্ভরযোগ্য ও ধারাবাহিক স্মার্টনেস রেখে এগিয়ে যাওয়া নায়ক হতে পারবে। তার পরে যারা এসেছে তারা সবাই মূলত তারই একটা ধারাবাহিকতা। শাকিব খান পরবর্তী ইন্ডাস্ট্রি লিডের যোগ্যতায় আরিফিন শুভ প্রথমে থাকবে। ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা।