Select Page

গহীন বালুচর : বাংলার গল্প

গহীন বালুচর : বাংলার গল্প

গহীন বালুচর
পরিচালনা : বদরুল আনাম সৌদ
অভিনয়ে : রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, আফরোজা বানু, ফজলুর রহমান বাবু, লুৎফর রহমান জর্জ, রুনা খান, শাহাদাত হোসেইন, জিতু আহসান, শর্মীমালা, শাহানা সুমী, তানভীর, মুন, নীলাঞ্জনা নীলা প্রমুখ।
রেটিং : ৪/৫

আজ স্বীকার করে নেই, ’গহীন বালুচর’ দেখবার আগে বেশ কিছু আশংকা ছিল। প্রথমত: সরকারী অনুদান পাওয়া ছবিগুলোতে প্রেমের গল্প বলা হয় কম। সাধারণ দর্শকের বিনোদনের জন্য উপকরণ থাকে কম। ‘গহীন বালুচর’-এ প্রেমের গল্প বালুচরের গুরুগম্ভীর গল্পের চাদরে ঢাকা পড়ে যাবে কিনা, সংশয় ছিল। এই ছবিতে জাঁদরেল সব অভিনেতারা রয়েছেন। কিন্তু প্রেমের গল্প তো টেনে নিয়ে যাবে তিন নতুন মুখ। তারা কতটা মন ছুঁয়ে যেতে পারবেন? বদরুল আনাম সৌদ পরিচালক হিসেবে এবং সুবর্ণা মুস্তাফা নির্বাহী প্রযোজক হিসেবেও চলচ্চিত্রে নতুন। তাদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে চলচ্চিত্রের দর্শকদের, বিশেষ করে এ সময়ের দর্শকদের সস্তা বিনোদন থেকে দূরে রেখে মনে রাখার মত একটি চলচ্চিত্র উপহার দিতে তারা কতটুকু সক্ষম হবেন-এই প্রশ্ন মাথায় নিয়েই ‘গহীন বালুচর’ দেখতে যাই।

আমি শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ। ইট কাঠের খাঁচায় বন্দী আমার শৈশব। এ কারণেই কিনা জানিনা গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ছবিগুলো আমাকে বেশি টানে। ‘গহীন বালুচর’ এর প্রথম দৃশ্য থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলাম এটি ভেবে, এ ছবি বাংলার মাটির গল্প। বাংলাদেশের গল্প। এ গল্পে মুঠোফোন, ফেসবুক, আইটেম গান, মারদাঙ্গা অ্যাকশন দৃশ্য, অনাকাঙ্খিত ‘ভাঁড়’ চরিত্র কিংবা নতুন কোনো চলচ্চিত্রের ভাষা শেখাবার আয়োজন নেই। এ গল্পে ‘বিশেষ গান’ আছে। তবে সেটি ‘গায়ে হলুদ’-এর গান। অ্যাকশন দৃশ্য আছে। তবে এই দৃশ্যে খল চরিত্রের হাতে অস্ত্র নেই। সুদর্শন ভিলেনের পড়নে দুধ সাদা পাঞ্জাবী। এ গল্পে দুই প্রতিপক্ষের যোগাযোগ হয়। তবে মুঠোফোনে নয়, নৌকার ওপর। এ গল্পে যিনি দর্শক হাসান, তিনিই আবার দর্শকের ঘৃণার কারণ হন। কারণ আদতে তিনিই সব সম্পর্ক জটিল করে তোলেন। বুঝতে দেরি হয় না আমার, নির্মাতা সৌদ আবহমান বাংলার এই চিরায়ত বালুচরের গহীনে লুকিয়ে থাকা মানব প্রেম, সংঘাত, মায়া, প্রতারণাকেই এক সুতোয় গাঁথতে চেয়েছেন। এই মালা গাঁথার ছলে কখনো থই থই জলে ভরা নদী, কখনো বিস্তীর্ণ আকাশ, কখনো আবার ধানক্ষেত, নৌকা, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, ঢেঁকি, কুয়ো, হারিকেন, এমনকি শীতের কুয়াশা পুরো ছবিজুড়ে আলাদা আলাদা চরিত্র হয়ে উঠেছে। বরিশালের দপদপিয়া গ্রাম কিংবা কীর্তনখোলা নদী আমাদের কাছে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবির মত ধরা দিয়েছে। এটা ঠিক, ‘গহীন বালুচর’ অজানা অচেনা আনকোড়া কোনো গল্প নয়। শেক্সপীয়রের ‘রোমিও জুলিয়েট’-এর নির্যাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী শত-সহস্র চলচ্চিত্র হয়েছে। ‘গহীন বালুচর’-ও সেই ধারায় বিয়োগান্তক প্রেমের গল্প। তবে এই চেনা গল্প দেখতে গিয়েও অপলক চেয়ে থাকতে হয়। কারণ আমাদের মন যখন যা বলতে পারে, কাহিনীকার সৌদ সেসব অনুভূতি আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণেই হয়তো চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি বেশ খেলেছেন। টানটান রেখেছেন। বেশিরভাগ চরিত্রগুলোতে এতটাই ধূসর রঙ মিশিয়েছেন যে গল্প আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকছে, শেষ দৃশ্য দেখার আগে ঠাওর করা মুশকিল হয়ে পড়ে। পরিচালক হিসেবে বদরুল আনাম সৌদ এখানেই সফল। তার গল্প বলার ধরণ দেখে দর্শক হেসেছেন, কান্নার জলে বুক ভাসিয়েছেন, গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন-একটি চলচ্চিত্র থেকে এর বেশি আর কি-ই বা চাইতে পারি আমরা? এ মুহূর্তে বেশ কিছু দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে, যেমন: চর দখল নিয়ে হানাহানির নেপথ্যের গল্প, নৌকার ওপর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আসমা (সুবর্ণা মুস্তাফা) ও লতিফের (রাইসুল ইসলাম আসাদ) আপসের বৈঠক, কিশোর শামিমের হানিফ (জিতু আহসান) ও ইসমাইল (ফজলুর রহমান বাবু)’র গোপন কথা শুনে ফেলার দৃশ্য, আড়তে হানিফ ও ইসমাইলের বাক্যলাপের মাঝে হানিফের হঠাৎ আস্ফালন, মা আসমা ও তার ছেলে সুজনের (তানভীর) বাগবিতন্ডা, বিয়ে বাড়িতে ইসমাইলের উৎকণ্ঠা, বিয়ে বাড়ির পেছনে হানিফ-মিজানের মুখোমুখি সংঘর্ষ, আসমার শোবার ঘরে কমলার (শর্মীমালা) সঙ্গে কথোপকথন এবং ছবির শেষ দৃশ্যে সাঁঝবেলাতে নিশি’র (নীলা) নিস্তব্ধতা, নিজেকে খুঁজে ফেরা-প্রতিটি দৃশ্যেই নির্মাতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, চলচ্চিত্রে তিনি থাকতে এসেছেন। বক্স অফিসের রায়ে ‘গহীন বালুচর’ কোন অবস্থানে থাকবে সময়ই বলবে। তবে চলচ্চিত্রে বদরুল আনাম সৌদের মত নির্মাতার নিয়মিত হওয়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব বেশি প্রয়োজন।

‘গহীন বালুচর’-এর যতটুকু ভালো, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই আমি দেবো নির্মাতার নির্মাণশৈলী এবং তার অভিনয়শিল্পী নির্বাচনের দক্ষতাকে। আরো ধন্যবাদ দেবো, এ ছবিতে সুবর্ণা মুস্তাফা (ব্যক্তি জীবনে নির্মাতার স্ত্রী) থাকবার পরও ছবি জুড়ে সুবর্ণা অভিনীত ‘আসমা বেগম’ চরিত্রটি প্রাধান্য বিস্তার করেনি; অন্য অনেক নির্মাতা যেখানে নিজেদের ছবিতে স্ত্রীকেই সবচেয়ে বেশি পর্দা-ব্যাপ্তি দিয়ে থাকেন। গ্রামের প্রধান হিসেবে ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে সুবর্ণা মুস্তাফার যতটুকু পর্দায় থাকা দরকার ছিল, তিনি ঠিক ততটুকুই আছেন। হাত-পা ব্যবহার না করে শুধুমাত্র মুখাবয়বের মাধ্যমে অভিব্যক্তি এবং সংলাপ প্রক্ষেপণ করতে হয়েছে তাকে। বলাই বাহুল্য, সুবর্ণা মুস্তাফা এই জটিল চরিত্রটিতে অবিশ্বাস্য অভিনয় করেছেন। ‘ডরাইছো কমলা’-এই সংলাপ শুনে শুধু কমলারই নয়, অনেক দর্শকেরও আত্মা কেঁপেছে।

তবে অভিজ্ঞ অভিনেতাদের মধ্যে ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে তিনজন আমাকে বিস্মিত করেছেন: ফজলুর রহমান বাবু, জিতু আহসান ও শাহাদাত হোসেইন। ফজলুর রহমান বাবু জাত অভিনেতা, আমাদের দেশের গর্ব-এ কথা সবসময়ই মানি। তবে ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে ‘ইসমাইল’ চরিত্রে তিনি যেন নিজেকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এ ছবিতে ‘মাতাল’ ইসমাইল-এর সংলাপ শুনে যেমন হেসেছি, ঠিক ততটাই ঘৃণা করেছি।

ঘৃণা করেছি আরো একজনকে। তিনি জিতু আহসান। নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদ সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন জিতুকে নিয়ে। প্রয়াত গুণী অভিনেতা সৈয়দ আহসান আলী সিডনির সুপুত্র জিতু, ছোট পর্দায় যার ব্যক্তিত্ব, অভিনয়-সর্বোপরি নিষ্কলঙ্ক একটি ইমেজ রয়েছে, তাকে চলচ্চিত্রে প্রধান ‘খল’ চরিত্রে ভাবাটাই সাহসের ব্যাপার। নির্মাতা সৌদ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হাত তালি পাবেন। কারণ এ ছবিতে তিনি একজন সুদর্শন ভিলেন উপহার দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত ’গহীন বালুচর’ ছবির যদি একজনকে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন করতে বলা হয়, বেশির ভাগ দর্শক এ মুহূর্তে জিতু আহসানকেই পছন্দ করবেন। ‘হানিফ শিকদার’ চরিত্রে জিতু আহসানের অভিনয়, ম্যানারিজম এক কথায় বললে ‘বিস্ময়কর। অসাধারণ’। এই হানিফ বাবা, মা, স্ত্রী কাউকেই মানে না। এক রোখা হানিফ এহেন মন্দ কাজ নেই, যা করে না। এমন একটি চরিত্র জিতু ফুটিয়ে তুলতে না পারলে পুরো ছবিই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতো। তবে জিতু পেরেছেন। পুরস্কার পাবার মত অভিনয় উপহার দিয়েছেন। আর এ কারণেই আমার আফসোস হয়েছে, আমরা কেন জিতু আহসানকে এতদিন বড় পর্দায় ব্যবহার করতে পারলাম না? ভবিষ্যতেও কি পারবো? ‘আদরের সন্তান’ ছবিতে সমু চৌধুরী কিংবা ‘চোরাবালি’ ছবিতে শহীদুজ্জামান সেলিম অথবা অতি সম্প্রতি ‘অনেক সাধের ময়না’ ও ‘রাজনীতি’ ছবিতে আনিসুর রহমান মিলন প্রশংসিত কিংবা পুরস্কৃত হবার পরও তো আমরা তাদের পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হবার সুযোগ করে দেইনি। এ ব্যর্থতা আসলে কার? ভাবতে হবে। মেধাবী অভিনেতাদের ব্যবহার করতে হবে।

শাহাদাত হোসেইন যেমন এ ছবিতে আমাকে কাঁদিয়েছেন। সন্তানহারা পিতার আকুতি শাহাদাতের চোখে-মুখে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যভাবে আমি পেয়েছি, এক কথায়-‘অপূর্ব’! আফসোস হয়, এত গুণী অভিনেতাদের আমরা ব্যবহার করিনা। আমি দেখেছি, দীর্ঘদিন বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয় করার পরও সাধারণ অনেক মানুষই ‘শাহাদাত হোসেইন’ নামটি পর্যন্ত জানেন না। অথচ আমরা ভারতের ইরফান খান, মনোজ বাজপায়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, রাজকুমার রাওদের নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলি, ফেইসবুক উত্তপ্ত করি। তবে ‘গহীন বালুচর’ শাহাদাত হোসেইনের জন্য নিশ্চিতভাবে টার্নিং পয়েন্ট। আশা করছি এ ছবিটির পর নির্মাতারা তাকে নিয়ে নতুন করে ভাববেন। নতুন নতুন চরিত্রে নিজেকে ভেঙে শাহাদাতও আমাদের মুগ্ধ করবেন।

রুনা খান যেমন এবারও আমাকে মুগ্ধ করেছেন। তার চরিত্রটি বেশ সাধারণ। খুব বেশি অভিনয় দেখাবার সুযোগ নেই। তবে প্রকৃত অভিনেতা তারাই যারা সাধারণ চরিত্রকে অসাধারণভাবে তুলে ধরতে পারেন। রুনা খান তেমনই একজন। কোনো সংলাপ না থাকলেও তিনি অভিনয় করতে পারেন। কারণ তার চোখ কথা বলে।

গুণী অভিনেত্রী শর্মীমালাও এই দলে পড়বেন। গল্পে তার চরিত্রের ওপর আলো পড়েছে খুব কম। কিন্তু এই কম সময়ের মধ্যেই শর্মীমালা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ছবি জুড়ে রাজত্ব করলেই দর্শকের কাছে পৌছে যাওয়া যায়না। দর্শকের সমর্থন পেতে হলে গুণী অভিনয়শিল্পীদের একটি কি দুটি দৃশ্যই যথেষ্ট। আফরোজা বানু, লুৎফর রহমান জর্জ কিংবা শাহানা সুমী-প্রত্যেকেই এ ছবিতে সমর্থন দিয়েছেন নবাগত অভিনয়শিল্পীদের। তবে কাহিনীকার বদরুল আনাম সৌদ বড় ধরনের কৃতিত্ব পাবেন এ কারণে, চরিত্র ছোট হোক অথবা বড়, প্রতিটি অভিনয়শিল্পীর চরিত্রের চিত্রায়ণের ব্যাপারে মনোযোগী ছিলেন তিনি।

এবার আসি নবাগত অভিনয়শিল্পী তানভীর, মুন, নীলার কথায়-যারা ‘গহীন বালুচর’ ছবির স্তম্ভ। ছবির প্রথম ভাগ পুরোটাই দখলে ছিল তানভীর ও মুনের। বিরতির পর দেখেছি নীলার সঙ্গে তানভীরের গল্প। নতুন অভিনয়শিল্পীরা প্রথমত আমার ধন্যবাদ পাবেন, কারণ তাদের অভিনয়ে কোনো জড়তা ছিল না। বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন তারা। যেমন-‘সুজন’ তানভীর মিশে যেতে চেয়েছেন গ্রামের সঙ্গে। চরিত্রের সঙ্গে। অবলীলায় পানিতে ডুব দিয়েছেন, বিরহ ব্যাথায় কাদায় মাখামাখি করেছেন, নৌকা চালিয়েছেন, এমনকি প্রেমের গভীরতা প্রকাশ করতে দুই নায়িকাকে চুম্বনও করেছেন। অবশ্যই তানভীরের কাছ থেকে আমি ‘মনপুরা’র চঞ্চল চৌধুরী কিংবা ‘সুজন সখী’র ফারুক/ সালমান শাহের অভিনয় আশা করিনি, তবে প্রথম চেষ্টা হিসেবে তানভীরের পর্দা উপস্থিতি আমাকে স্বস্তি দিয়েছে। হতাশ করেনি। একই কথা প্রযোজ্য নায়িকা মুনের ক্ষেত্রে। প্রেম কাহিনীর নায়িকা হিসেবে মুন ‘পারুল’ চরিত্রের রূপায়ণে সৎ ছিলেন। আন্তরিক ছিলেন। তবে তিন নতুন অভিনয়শিল্পীর মধ্যে কেউ যদি আমার মন জিতে নিয়ে থাকে, তিনি ‘নীলাঞ্জনা নীলা’। ঘুড়ি ওড়াবার প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত নীলা এ ছবিতে ‘অক্সিজেন’ সরবরাহ করেছেন। ‘নিশি’ চরিত্রের চঞ্চলতা, আহ্লাদীপনা, প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি, মন ভাঙা-গড়ার কঠিন সময়কে সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। ছবিতে তার পরিণতির দৃশ্যগুলোতে গুণী অভিনেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। দীর্ঘদিন পর চলচ্চিত্রের পর্দায় কোনো নতুন নায়িকাকে দেখে প্রাণ জুড়িয়েছে। অভিনয় দেখে স্বস্তি হয়েছে। নাচ দেখে মনে হয়েছে, এ নায়িকাই হতে পারে আগামী দিনের বড় তারকা। নিঃসন্দেহে নীলা ২০১৭ সালের অন্যতম সেরা আবিষ্কার। নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ, ‘গহীন বালুচর’-এর মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রিকে তিনটি নতুন মুখ উপহার দেবার জন্য। তিনি চাইলেই ঝুঁকি না নিয়ে তিনটি জনপ্রিয় মুখকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারতেন। তবে তিনি তা করেননি। সময় দিয়েছেন নতুন অভিনেতাদো গ্রুমিংয়ে। যার ফলাফল আমরা দেখেছি পর্দায়।

তবে বদরুল আনাম সৌদ শুধু পরিচালক হিসেবেই নয়, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, সম্পাদক, এমনকি গীতিকার হিসেবেও বেশ আন্তরিক ছিলেন। ‘ভালোবাসায় বুক ভাসাইয়া’র মত গান লিখেছেন তিনি। ‘কসম বলি এই কুয়াশার, সময় যদি একটু দাঁড়ায়/ বাঁধবো তোমায় আঁচলে/ বাঁধবো তোমায় খোঁপাতে/ ও বন্ধুরে, তোমার মনের খাঁচায় তুমি রেখো আমায় গোপনে, ও বন্ধুরে’-এমন অসাধারণ গানের কথা সচরাচর শোনা যায়না। তবে শুধু গীতিকারই নন, এ গানের সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইমন সাহা, শিল্পী বাপ্পা মজুমদার ও দিনাত জাহান মুন্নী-প্রত্যেকের কাজই মন ছুঁয়েছে। ইমন সাহা অনেকদিন পর নতুন করে জ্বলে উঠেছেন এ ছবিতে। শুধু ‘ভালোবাসায় বুক ভাসাইয়া’ নয়, ‘তারে দেখি আমি রোদ্দুরে’-মন ছুঁয়ে যাবার মত আরেকটি সৃষ্টি। লিজা অসাধারণ গেয়েছেন। ‘কাঞ্চা বরণ’ গানে নাজিবা বাসার ও বাকিদের নাচের সঙ্গে আমিও দুলেছি। তাল মিলিয়েছি। পর্দায় গানটি দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে আমিও বুঝি এই গায়ে হলুদের অতিথিদের একজন। ঐশী বেশ ভালো গেয়েছেন। ‘ঝড়ের মধ্যে’ গানটি চন্দন সিনহা বেশ দরদ দিয়ে গেয়েছেন। ‘চর জেগেছে’ (বাবু, মুন্নী, জয়িতা, সাব্বির, মনির) গল্পের গতি ধরে রেখেছে। তবে ‘গহীন বালুচর’ ছবির গানগুলো শুধু বিনোদন দিতেই নয়, প্রতিটি গানই গল্পকে টেনে নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে নৃত্য পরিচালক নাজিবা বাসারকেও ধন্যবাদ জানাই। সরকারী অনুদান পাওয়া কোনো ছবি থেকেই এর আগে ‘মিউজিক্যল লাভ স্টোরি’ পাইনি। বিশেষ ধন্যবাদ জানাই ইমন সাহাকে। শুধু গানের জন্য নয়, আবহ সংগীতও এ ছবির সম্পদ। চর কেন্দ্রিক প্রেমের গল্পের গতি ধরে রেখেছে এই আবহ সংগীত।

অন্যান্য কলাকুশলীদের মধ্যে বিশেষভাবে বলতে চাই ওয়াহিদা মল্লিক জলি (পোষাক পরিকল্পনা), উত্তম গুহ (শিল্প নির্দেশনা) ও কমল চন্দ্র দাসের (চিত্রগ্রহণ) কথা। ছবি জুড়ে সবার বাস্তবিক পোষাক চোখে আরাম দিয়েছে। অনেক বাংলা ছবিতেই আমরা দেখেছি স্বামী হারিয়ে স্ত্রীরা মুহূর্তেই জাদুমন্ত্রবলে সাদা শাড়ি পেয়ে যান। সাদা শাড়ি না পড়লে বুঝি শোকের প্রকাশ ঠিকভাবে হয় না। এ ধারণা ভেঙে দিয়ে এ ছবিতে রুনা খানের টকটকে লাল শাড়ি অদ্ভুত ভালো লেগেছে। তাছাড়া বিয়ের মঞ্চে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর নীলার সাজ, এলোমেলো শাড়ি ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। শিল্প নির্দেশনায় উত্তম গুহের কাজও চোখে পড়ার মত। কোনো কিছুই বাহুল্য মনে হয়নি। যখন যেখানে যতটুকু দরকার, ততটুকুই দেখিয়েছেন তিনি। কমল চন্দ্র দাসের অসাধারণ চিত্রগ্রহণ, বিশেষ করে লং শটগুলো মন কেড়েছে। খুব সরল ভাবে ভিএফএক্সের সাহায্য না নিয়ে প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি।

এত কিছুর পরও বলতে হয়, ‘গহীন বালুচর’ নিখুঁত নয়। ভালোর উল্টোপিঠে মন্দের দায়েও এ ছবিটি অভিযুক্ত হতে পারে। যেমন: ‘গহীন বালুচর’ প্রেমের ছবি। তবে সুজন-পারুলের প্রেমের মুহূর্তগুলো আরো হৃদয়গ্রাহী হতে পারতো। সুজন-পারুলের প্রেম কাহিনীর চেয়ে সুজনের প্রতি নিশির ভালো লাগা আমি বেশি অনুভব করেছি। ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে গল্পই নায়ক। তবে নায়ক তানভীর এবং নায়িকা মুনের চরিত্র আরো শক্তিশালী হতে পারতো।

তবে এটাও সত্যি, ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে এত ভালোর মাঝে এই অভিযোগগুলো আমরা নিজেরাই এড়িয়ে গেছি। কারণ সব কথার শেষ কথা, বাংলাদেশের সিনেমা হলে আমরা ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, বাংলার গল্প’-ই দেখতে চাই। সে ক্ষেত্রে ‘গহীন বালুচর’ গ্রাম বাংলাকে সেলুলয়েডের ফিতায় এমনভাবে বন্দী করেছে, দেখে বলতেই হয় ছবিটি গত বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। মূলধারার জন্য এরকম বিনোদনমূলক মৌলিক কাহিনীর ছবি ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব বেশি দরকার। যে কারণে এ ধরনের ছবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করাও আমাদের দর্শক-সমালোচকদের দায়ের মধ্যে পড়ে। নইলে দেশের সিনেমা হলে বিদেশের (দক্ষিণ ভারতের ছবির বাংলা সংস্করণ) ছবি দেখেই দিন কাটাতে হবে আমাদের। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমরা কি তা চাই?

*রিভিউটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ দৈনিক সমকালের ৪ জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত।

 


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন