Select Page

আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা ‘শ্যামাকাব্য’

আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা ‘শ্যামাকাব্য’

শ্যামাকাব্য। পরিচালক বদরুল আনাম সৌদের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। খুব স্বাভাবিকভাবেই দুটি চলচ্চিত্রের মাঝে তুলনা চলে আসবেই। স্বীকার করতে দোষ নেই, ‘গহীন বালুচর’ প্রথমবার দেখার পর কেন জানি বুকের ভেতর স্পর্শ করেনি। হয়তো অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল। যদিও পরেরবার পূর্ণ মনোযোগের সাথে সিনেমাটি দেখি। ভালো লাগে। তবে ‘শ্যামাকাব্য’ দেখার পর বলবো, ‘গহীন বালুচর’-এর একাধিক পাড়ে আমি নির্মাতা সৌদকে পাইনি; ‘শ্যামাকাব্য’তে পেয়েছি।

এই সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে আমি একজন নির্মাতাকে পেয়েছি। একটা সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলার গল্প এতটা অবলীলায় কেউ আমাদের দেশের বড়পর্দার জন্য নির্মাণ করেছেন, ভাবাই যায় না। শেষ কবে একটা বাংলাদেশি সিনেমার পুরোটা জুড়ে এতটা শ্রুতিমধুর, অর্থবহ সংলাপ শুনেছি, মনে পড়ে না।

‘শ্যামাকাব্য’ দেখে তিনদিন মোহাবিষ্ট হয়ে তারপর সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেছি: এই সিনেমাটি সবার হলে গিয়ে একবার হলেও দেখা উচিত। এটা ঠিক, বিনোদনের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। তবে আমি সিনেমা হলে ‘রাজকুমার’-এর মত মূলধারার সিনেমা যেমন উপভোগ করতে পারি, আবার ‘শ্যামাকাব্য’র ভাঁজে ভাঁজেও বিনোদনের নির্যাস খুঁজে নিতে পারি। ভিন্ন ধারার গল্প, শ্রেষ্ঠ সংলাপ, কৌশলী নির্মাণ, চোখে-মনে প্রশান্তি জুড়িয়ে দেয়া চিত্রগ্রহণ তো রয়েছেই, তবে এই সিনেমায় আমার সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল: আবহ সংগীত/গান এবং শিল্পীদের অভিনয়। বদরুল আনাম সৌদের লেখা, ইমন সাহার সুর-সংগীতে, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও ইমন চক্রবর্তীর ‘পাখি যাও যাও’ গানটি এ সময়ের শ্রেষ্ঠ গানের মধ্যে অন্যতম। যতবার স্ক্রিনে এই গান বা গানের আবহ বেজে ওঠেছে, ততবারই অসহ্য ভালো লাগায় অজান্তে আমার চোখ ভিজেছে। মন ভিজেছে। 

‘শ্যামাকাব্য’র অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কে কার থেকে এগিয়ে ছিল, সেটা বোধ হয় কেউ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারবে না। কারণ সবাই নিজেদের অবস্থানে জ্বলজ্বল করেছেন। সুবর্ণা মুস্তাফা এবং সাবেরী আলমের কণ্ঠ ছিল দর্শকদের জন্য ‘বিশেষ’ উপহার। ছোট্ট চরিত্রে রিমি করিমকেও ভীষণ মিষ্টি লেগেছে। মীর রাব্বি তার চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। ‘ভার্সেটাইল’ শাহাদাত হোসেন যে কোনো বয়সের, যে কোনো ধরনের চরিত্রে বরাবরই শক্তিশালী। এ সিনেমাতেও তাই। এ কে আজাদ সেতু বরাবরের মতই নির্ভরশীল। জেনির বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি যতবার পর্দায় এসেছেন, মনে হয়েছে, আরেকটু থাকুক।

সাজু খাদেমকে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রে নানা স্বাদের চরিত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিষয়টি বেশ ইতিবাচক। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ কিংবা ’১৯৭১: সেইসব দিন’-এর পর ‘শ্যামাকাব্য’তেও ভিন্ন চরিত্রে সাজু খাদেম মুগ্ধ করেছেন। ইন্তেখাব দিনার আমার মত প্রায় সব দর্শকেরই প্রিয় অভিনেতা। তবে এত বছর কাজ করার পরও তার মেধার স্ফূরণ যেন শেষ হয় না। প্রায় প্রতিটি কাজেই তিনি নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরেন। ‘শ্যামাকাব্য’তেও তাই।

তবে যারা ‘শ্যামাকাব্য’ দেখেছেন, তারা সবাই বলবেন-এই সিনেমার মূল চালিকা শক্তি: ‘আজাদ’ ও ‘শ্যামা’ চরিত্রে সোহেল মন্ডল ও নীলাঞ্জনা নীলা। যেমনটি প্রযোজক সুবর্ণা মুস্তাফা দাবী করেছেন, সোহেল-নীলা তাদের ক্যারিয়ারের এখন পর্যন্ত সেরা কাজ উপহার দিয়েছেন ‘শ্যামাকাব্য’তে। আমিও এই বিবৃতিতে সহমত জানাই। ‘শ্যামাকাব্য’ দেখার আগেও ভেবেছি, সোহেল মন্ডলকে কিভাবে প্রধান চরিত্রে নেয়ার সাহস করলেন পরিচালক? আর দেখার পর ভেবেছি, ‘শ্যামাকাব্য’র ‘আজাদ’ কী অবলীলায় ভুলিয়ে দিলেন, তিনি ‘তাকদীর’-এর ‘মন্টু’, ‘হাওয়া’র ‘উরকেস’, ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর সত্য কিংবা ‘বলি’র ‘রুস্তম’! ক্লাইমেক্স দৃশ্যে সোহেল মন্ডল বিশেষভাবে তার জাত চিনিয়েছেন।

অবশ্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী সোহেল মন্ডল যে সুঅভিনেতা, সে তো আমরা শুরু থেকেই জানি। কিন্তু নীলাঞ্জনা নীলা যে তার সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করবেন বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবেন, তা কি কেউ কখনো ভেবেছিল? যদিও নীলা ‘গহীন বালুচর’-এও সুঅভিনয় করেছিলেন। তবে কেন জানি, সুঅভিনেত্রী নীলা বরাবরই বেশ আন্ডাররেটেড। ‘শ্যামাকাব্য’ দেখার পর আশা করি, সবাই নীলা বন্দনায় মুখর হবেন। এই চরিত্রে অপ্সরীর মত একজন অভিনেত্রীকে প্রয়োজন ছিল নির্মাতার, যিনি তার হাসি/ চোখ/ সংলাপ প্রক্ষেপণ দিয়ে দর্শককে ধাধার মধ্যে বেঁধে ফেলে দেবেন। নীলা ভীষণ ম্যাচুওরিটির সঙ্গে সেই গুরুদায়িত্বই হাসতে খেলতেই পালন করেছেন। আশা করছি, এই সিনেমার পর নির্মাতারা নীলাকে নিয়ে নতুন করে ভাববেন এবং নীলা নিজেও ভালো কাজে নিয়মিত হবেন।

‘শ্যামাকাব্য’ সিনেমার শেষ দিকে পরিচালক সৌদ যে ধাক্কা দিয়েছেন, তা হয়তো কেউ কেউ আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। বেশিরভাগ দর্শক পারেননি। তবে দুই শ্রেণীর দর্শকই হয়তো আমার এ কথার সঙ্গে একমত হবেন: আমরা প্রায়ই যে ‘আন্তর্জাতিক’ মানের সিনেমার কথা বলি, ‘শ্যামাকাব্য’ ঠিক তেমনই সিনেমা। বিশেষ করে ওপার বাংলায় জোরালো প্রচার-প্রচারণা করে মুক্তি পেলে ‘শ্যামাকাব্য’ পশ্চিমবঙ্গের রুচিশীল দর্শকদেরও আপন করে নেয়ার কথা। ধন্যবাদ পরিচালক-প্রযোজক এবং ‘শ্যামাকাব্য’ সিনেমার সঙ্গে জড়িত সকলকে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন