Select Page

বিকল্প দৃশ্যমালার কি প্রকল্প থাকতে হয় না?

বিকল্প দৃশ্যমালার কি প্রকল্প থাকতে হয় না?

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ভিস্যুয়াল উৎপাদন, সুস্থতার মায়াকান্না এবং টিভি কারখানার দাসত্ব

২০২০ সালে বিএফডিসির দুটি ফ্লোর ভাঙা শুরু হয়। যেখানে শপিংমল হওয়ার কথা ছিল

প্রস্তাবনা

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ভিস্যুয়াল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু দাবি করা হচ্ছে। দাবিগুলো করছেন, বলাই বাহুল্য, এসব বুদ্ধিবৃত্তিক-উৎপাদের নির্মাতারা। ‘ভিস্যুয়াল উৎপাদ’ পদমালা ব্যবহারের মাধ্যমে আমি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানাদির সম্ভাব্য সীমারেখা লোপাট করে দিতে ইচ্ছুক এমন মনে হওয়া অসঙ্গত নয়। এবং এই অভিযোগটাকে প্রাণপণে খারিজ করতেও আমি বসব না; তবে অভিযোগটাকে বড়জোর দেখব একটা পূর্বতন বর্গবিভাজনের প্রতি দায়বদ্ধ একটা ভঙ্গি হিসেবে। নচেৎ কেন এবং কীভাবে আমি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের বর্গবিভাজন নিয়ে তেমন কোনো সংমিশ্রণ ছাড়াই ভিস্যুয়াল উৎপাদ বলে সমন্বিত এলাকাকে নির্দেশ করতে পারি তা বোঝা এমন কঠিন কিছু নয়। হ্যাঁ, কথা আসলে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়েই হচ্ছে- এর কারিগরি বাস্তবতা এবং অর্থোন্মুখতা সমেত। দাবিগুলোকে নিয়ে পেশাদার একটা গবেষণা নিশ্চয় সম্ভব, তবে আপাততঃ খুব সাধারণ বোধবুদ্ধির পর্যবেক্ষণ থেকে দাবিগুলোর একটা তালিকা বানানো সম্ভব।

দাবিগুলো, সংক্ষেপে, এরকম:

ক) দর্শকের বিচারবোধ সামর্থ্য নাদানপ্রায় এবং তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে ‘ভালো’ কিছু বানানো নির্মাতাদের পক্ষে বিশেষ সম্ভব হয়ে ওঠে না।

খ) এফডিসি নামক প্রতিষ্ঠানটি থেকে সংস্কৃতিবোধবিবর্জিত মালামাল উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশের ভিস্যুয়াল দুনিয়ার জন্য এটা একটা নাহক সমস্যা বটে।

গ) পক্ষান্তরে, সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন মানুষজন ‘বিকল্পধারা’র চলচ্চিত্র নাম্নী গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক মালামাল উৎপন্ন করে থাকেন। তাঁরাই দেশের সংস্কৃতির দেখভাল, যা এবং যতটুকু করার, করছেন।

ঘ) টেলিভিশন নামক শিল্পে বিপুল পরিমাণ ‘সম্ভাবনাময়’ মাথা নিরন্তর খেটে চলেছেন। এই খাটাখাটনি থেকে তাঁরা নতুন ধরনের ভিস্যুয়াল-পণ্য তৈরি করে দর্শকরুচিতে অবদান রেখে চলেছেন।

ঙ) নয়া নয়া ব্যক্তিমালিকানাধীন স্যাটেলাইট চ্যানেল বাজারে এসে সাংস্কৃতিক এলাকা পরিব্যাপ্ত করেছে এবং ‘সুস্থ প্রতিযোগিতা’র মধ্য দিয়ে এসবের সুফল সাংস্কৃতিক-ভোক্তাকুল পেতে শুরু করেছেন।

চ) চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি দিকের উন্নতি এবং ব্যয়হ্রাসের কারণে ছবি বানানো আগের থেকে সহজতর ও আয়ত্বাধীন হয়েছে।

এই তালিকার মধ্যেই যে সকল দাবিনামা উল্লেখ করা গেল তা নয়। তবে ভিস্যুয়াল নির্মিতির পরিমণ্ডল বুঝতে এগুলো বেশ কার্যকরী হবে। দাবিগুলোর মধ্যে পরস্পর বিরোধিতার বিষয়টা কোনোরকম শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্য ছাড়াই বোঝা সম্ভব হয়। একই সঙ্গে দাবিগুলোর কোনো কোনোটির মধ্যে কৌলিণ্যের ছাপও খুব স্পষ্ট। কৌলিণ্যের এই বোধটিও বর্তমান টীকাটির পাটাতন গড়ে দিতে সাহায্য করেছে, কারণ সেটির অসারতা অনুধাবন ছাড়া বাংলাদেশের ভিস্যুয়াল দুনিয়া নিয়ে কোনো অবস্থান তৈরি, ও ব্যক্ত, করা নিরর্থক বলে বিবেচনা করি আমি।          

প্রকৃত চলচ্চিত্র!

গোড়াতেই আমার তরফে এই সতর্কতা আমি ঘোষণা করেছি যে আমার ভূমিকা চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন উৎপাদসমূহের সীমানা লোপাটকারী হিসেবে ধার্য হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ হাজির করা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কী চলচ্চিত্র হয়ে উঠছে এবং কী হয়ে উঠছে না তার একটা সংজ্ঞানির্ধারণী তর্ক বাংলাদেশের বিদ্বোৎসাহী সাংস্কৃতিক মহলে বিরাজমান। যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপাদের ইতিহাস-নিষ্ঠা থেকে এই তর্কটির আবশ্যকতা আছে বলে মেনে নেয়া সম্ভব। কিন্তু এখানে যে বিষয়টা কৌতূহলোদ্দীপক তা হচ্ছে সংজ্ঞাগ্রহীরা নিজেরা যখন চলচ্চিত্র বানান তখন সেই চলচ্চিত্রগুলোও তাঁদের নির্ধারিত সংজ্ঞায় চলচ্চিত্র পরিমণ্ডলে খারিজ হবার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে, তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই। তেমনি নির্মাতার সমমনা চলচ্চিত্র-বোদ্ধা ও নির্মাতারাও সেই ছবিকে পর্যাপ্ত শিল্পমর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করেন না। শেষের এই বৈশিষ্ট্যটিকে আপাতগ্রাহ্যে ব্যক্তিগত কিংবা ব্যক্তিত্বের সংকট হিসেবে দেখার ভ্রান্তি নিমেষেই ঘটে যেতে পারে। কিন্তু একটা ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যদি কোনো আচরণপ্রণালী বিধিমালার মতো ক্রিয়াশীল থাকে তাকে ‘ব্যক্তিক’ বলে খাটো করা যেতে পারে কীভাবে!

একটা ভাষামালা হিসেবে আমি শনাক্ত করতে চাই, এই প্রবণতার মধ্যে, ‘প্রকৃত চলচ্চিত্র’কে। কখনো কখনো, লক্ষ্য করে দেখলে, ‘সুস্থ চলচ্চিত্র’ হিসেবে কিছু একটা বলা হয়। আবারো, আপাতগ্রাহ্যে মনে করা যেতে পারে যে এই দুই ভাষাভঙ্গি দিয়ে একই বিষয় ইঙ্গিত করা হচ্ছে। কিন্তু অন্যত্র খতিয়ে দেখানো সম্ভব যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য এ দুয়ের মধ্যে আছে যেমন, তেমনিই এই ভঙ্গি-প্রকাশকেরা মিলেমিশে চলচ্চিত্র তথা ভিস্যুয়াল দুনিয়া নিয়ে একটা অখণ্ড কিছু বোঝানো হয়েও থাকে। ‘সুস্থ চলচ্চিত্র’ নিয়ে যেসব ধারণা কাজ করে তা কোনো না কোনোভাবে অশ্লীলতার ডিসকোর্সের ওপর দাঁড়ানো। অশ্লীলতার ডিসকোর্সকে অধুনা বছরগুলোতে অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে হাজির থাকতে দেখা যাচ্ছে। এফডিসির উৎপাদিত দৃশ্যগত সামগ্রীকে পরীক্ষণ ও খারিজ করে দিতে এই ডিসকোর্স ধন্বন্তরী দাওয়াইয়ের মতো কাজ করেছে। এফডিসি বিরুদ্ধ একটা দৃষ্টিভঙ্গি হবার কারণেই একে কেবল অন্যপক্ষের ভিস্যুয়াল দুনিয়ার খারিজকার হিসেবে দেখা ঠিক হবে না, বরং এই দৃষ্টিভঙ্গি কাঠামোগতভাবেই নিজপক্ষীয় ভিস্যুয়াল উৎপাদনের সাফাইকারী হিসেবে বিদ্যমান। এই তাত্ত্বিক অনুকল্পটি কিছুটা জটিল বটে, তবে একে উপলব্ধির মাধ্যমেই ভিস্যুয়াল দুনিয়ার ‘প্রকৃত চলচ্চিত্র’পন্থী এবং ‘সুস্থ চলচ্চিত্র’পন্থীদের আঁতাত ও সদ্ভাবের জমিনটাকে চিনে নেয়া সম্ভব।

‘সুস্থ চলচ্চিত্র’ যেখানে নৈতিকতার ওপর দাঁড়ানো একটা ভাষা ও চিন্তামালা, ‘প্রকৃত চলচ্চিত্র’ সেখানে জ্ঞানগত দম্ভের ওপর দাঁড়ানো ভাষা ও চিন্তামালা। এই জ্ঞান কীভাবে পোক্ত কিংবা, বিপরীতে, তা নয়; এই জ্ঞানের শিক্ষাতত্ত্বীয় ভিত্তির পূর্বানুমান ও ঐতিহাসিকতা কী সেগুলো স্বতন্ত্র সব জিজ্ঞাসা। কিংবা আদতেই এই জ্ঞানের দম্ভযোগ আবশ্যক কি না, না কি আবশ্যক স্বদেশী চলচ্চিত্র প্রণালী গড়ে তোলার জন্য একটা অবধারিতভাবে আধুনিকতাবাদী প্রচেষ্টা সেসব আবার রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কৌতূহল এগুলো নিয়ে নয়; বড়জোর এটা ইঙ্গিত করানোর মধ্যে নিহিত থাকছে যে ‘প্রকৃত চলচ্চিত্র’ ঘোষণাওয়ালাদের তৎপরতা ও বিকাশের ক্ষেত্রে ইওরোপীয় ও ইন্ডিয়ান দূতাবাস এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর বিস্ময়কর ভূমিকা আছে। সংশ্লিষ্টরা সেটা টের পান বা না পান, মানুন বা নাই মানুন- এই বোধের ভিত্তি এরকমই।

‘প্রকৃত চলচ্চিত্র’ বিষয়ক আলোচনা, এক হিসেবে, পর্যালোচকের। ইওরোকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র-নন্দনবোধ, পর্যালোকেরা আত্মগতভাবে নিশ্চিত যে, তাঁদের পর্যাপ্ত গড়ে উঠেছে। ফলতঃ তাঁদের কর্মকাণ্ডের একাংশ হচ্ছে পরস্পরের কাছে নিজেদের দর্শকত্বের পরিধি বিষয়ে জানান দেয়া- বারংবার উচ্চারিত হয় সেসব ফরাসি বা রুশ বা ইংরেজি ছায়াছবির নাম যেগুলো গতকালের চলচ্চিত্র বিষয়ক আরেকটা আড্ডাতেই আড্ডাকারেরা একদফা নিয়েছেন, প্রায় একই উচ্ছ্বাস আর প্রগলভতা সমেত। এই ভাবনাপন্থীদের কার্যক্রমের অপর অংশ, বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে উৎপাদিত ‘বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র’ যে গুণগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ে ওঠেনি সেটার রায় দিতে থাকা। প্রায়শঃ, এই ভাবনাপন্থীরা নিজেরা চলচ্চিত্রকার বিধায়, এসব কর্মকাণ্ড খুব নিমেষেই কার্যত একটা আত্মহননমূলক ক্রোধে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। কিন্তু, আগেই যেমনটা বলেছি, মূল্যবোধাশ্রয়ী ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্রের অনুসন্ধান এবং উচ্চমূল্য নানন্দিকতাশ্রয়ী ‘প্রকৃত’ চলচ্চিত্রের অনুসন্ধান শেষতক এককাট্টা হয়ে পড়বার সুযোগ নেয় এফডিসির উৎপাদন বিষয়ে সমধর্মী বিদ্বেষ প্রকাশের মাধ্যমে। অধিকন্তু, এরা এফডিসি কিংবা মোটের ওপর ভিস্যুয়াল উৎপাদন প্রক্রিয়া বিষয়ে ক্রিটিক্যাল ভাবনা ভাবতে অনীহা প্রকাশের মাধ্যমেও একাকার থাকেন।       

ভিস্যুয়াল উৎপাদন প্রক্রিয়া

আমার প্রকাশিত অবস্থান থেকে আমাকে গড়ে এফডিসির চলচ্চিত্রের অনুরাগী মনে করা নেহায়েৎ অনাচার হবে। তবে এরকমটাই ঘটেছিল বছর আষ্টেক আগে। অশ্লীলতা বিষয়ে ঢাকায় তখন উত্তুঙ্গ সাংস্কৃতিক তৎপরতা। প্রগতিশীল এবং/কিংবা বামপন্থী ধারার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মীরা তখন ঢাকাই চলচ্চিত্র থেকে অশ্লীলতা খেদিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ময়দানে সামিল। অবস্থার তীব্রতা এতটাই যে খোদ ডিপজল ও তাঁর প্রযোজক-মিত্ররা পর্যন্ত শামিয়ানা টাঙিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র থেকে অশ্লীলতা দূর করবার ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। এরকম গুরুগম্ভীর সর্বময় তৎপরতার মধ্যে কতিপয় নায়িকাকে যাবতীয় সমস্যার মুখ্য চাবিকাঠি হিসেবে আবিষ্কার করা হলো। আমার পক্ষে বিশেষ কোনো পত্রপত্রিকা আশ্রয় করা সহজ ছিল না যদিও, আমি এই বজ্রআঁটুনির অশ্লীলতা-যুদ্ধ নিয়ে পদ্ধতিগত কিছু জিজ্ঞাসা তুলেছিলাম, কটাক্ষের ভঙ্গিতে। লেখাটি দৈনিক সংবাদ-এ, ঘটনাচক্রে, প্রকাশিত হবার পর পরিচিত মানুষজনকে অস্বস্তি বোধ করতে দেখেছি। তাঁদের কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেই বসেন যে আমি ঢাকাই ছায়াছবিকে ছাড় দিয়ে ফেলছি কিনা।

একটা উৎপাদন ব্যবস্থাকে ছাড় দেয়ার আমি কোন ছার?!

প্রায়শই চলচ্চিত্র/মিডিয়া কর্মীরা এবং এসব বিষয়ে বিশ্লেষকগণ পর্যাপ্তভাবে গুলিয়ে ফেলেন যে আলাপ হচ্ছে কী নিয়ে। সাংস্কৃতিক রূপ-লক্ষণা নিয়ে আলাপ আর তার কারিগরি এবং লগ্নী বিষয়ক আলাপ দুইটা স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। অধিকন্তু, একটাকে বুঝতে চাইলে অন্যটাকে পর্যাপ্তভাবে বোঝার আবশ্যকতা আছে। বিশেষত সাংস্কৃতিক রূপ-লক্ষণা নিয়ে আলাপ গড়ে তুলতে চাইলে একটা বিশেষ রাষ্ট্রে, একটা বিশেষ সময়ে, সাংস্কৃতিক কারখানা কীভাবে ক্রিয়াশীল আছে সেই বিষয়ে সংমিশ্রিত হওয়া বিশেষ আবশ্যক। ঢাকাকেন্দ্রিক ভিস্যুয়াল ক্রিটিকগণ (অবশ্যই নির্মাতারা একাংশ সমেত, যেহেতু ঢাকায় এই বর্গসমূহ একাকার) কিছুতেই সহজে এই দায়িত্ব স্বীকার করেন না।

হালনাগাদ ঢাকায় ভিস্যুয়াল উৎপাদনে দুটো বড় বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আগের আলাপের জের ধরেই বলা যায়, এ দুটো হচ্ছে যথাক্রমে টেলিভিশন চ্যানেলের উল্লম্ফন এবং ডিজিটাল কারিগরি। শেষোক্তটাকে আবার উৎপাদনের সহজায়ন এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হিসেবে ভেঙে দেখার সুযোগ রয়েছে। এর মানে দাঁড়াল, সকলেই যদিও জানি এই সহজ সমীকরণ: প্রথমত, একের পর এক টেলিভিশন চ্যানেল হবার কারণে ব্রডকাস্টিং ঘণ্টা একটা উত্তুঙ্গ জায়গায় পৌঁছেছে এবং দৃশ্যমালার উৎপাদন সেই হারে বেড়ে যাবার দরকার পড়ছে; দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল কারিগরিতে দৃশ্যগ্রহণ ও সংযোজনের জন্য বিস্তর অবকাশ পাওয়া সম্ভব এবং ত্রুটি মেরামতিতে পূর্বতন কারিগরি ব্যবস্থার থেকে অনেক অনেক সহজতর স্থাপনা পাওয়া গেছে; তৃতীয়ত, দৃশ্যমালা উৎপাদন ব্যয় অন্তত সেলুলয়েড কালের থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে গেছে। এই বাস্তবতা চলচ্চিত্র প্রবাহের জন্য আসলেই ভিন্ন।

ফলে, বিস্ময়ের না যে, গত বছরগুলোতে ‘সিনেমার’ বিপরীতে/বহির্বাটিতে ‘নাটক’ আর একটা জেনেরিক বর্গ হিসেবে থাকতে পারেনি যেমনটা তামাম স্যাটেলাইট পূর্বকালে ছিল, এমনকি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের প্রথমভাগেও। এখন কার্যকরী বর্গ হিসেবে যেগুলো এসেছে তার একটা সাধারণ তালিকা হতে পারে এরকম: সিরিয়াল, টেলিফিল্ম, প্রমোশনাল, ডকুমেন্টারি, ডকুফিকশন, ডিজিটাল ফিল্ম; ভুলে যাবার আগে বলা দরবার এমনকি এ্যাডফিল্ম। লক্ষণীয় যে কখনো কখনো একটা পদমালা এসে অন্যটাকে প্রায় মৃত্যুমুখে ফেলে দেয়। উদাহরণ হিসেবে ‘ডিজিটাল ফিল্ম’ এসে ‘টেলিফিল্ম’কে, আমি অনুমান করি, খারিজ করে দিচ্ছে। বিষয়টা এই নয় যে টেলিফিল্ম আর কিছুকে বলা হবে না বরং বিষয়টা এরকম যে একজন নির্মাতা এ দুয়ের মধ্যে নিজের উৎপাদটিকে একটা বিশেষ নামেই ডাকতে চাইবেন অন্যটার তুলনায়। যদি আমরা সাংস্কৃতিক রূপ-লক্ষণা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি তাহলে ‘সিনেমা’ বা ‘চলচ্চিত্র’ এর বিপরীতার্থক/ভিন্নার্থক এতগুলো পদ সৃষ্টি হওয়াকে খোদ একটা গুরুতর ধাক্কা হিসেবে পাঠ করা সম্ভব। এই পর্যন্ত এসে কেউ ব্যতিব্যস্ত হয়ে মনে করিয়ে দিতে পারেন “না, না, চলচ্চিত্র এখনো ফুরিয়ে যায় নাই।” নিশ্চিত করা দরকার যে চলচ্চিত্রে অপমৃত্যু কিংবা নবজন্ম বিষয়ে আমি সামান্যই দুর্ভাবিত। আমার আগ্রহ, পেশাগত কারণেই, ভিস্যুয়াল সামগ্রীর বিবিধ উৎপাদন নিয়ে, এর বৈচিত্র্য ও অন্তর্তর্ক নিয়ে, বিপণন ব্যবস্থা কীভাবে ভিস্যুয়াল নীতিমালা গড়ে দিচ্ছে তা নিয়ে, এবং কীভাবে একটা পরিবর্তিত অবস্থা নয়া নয়া সাংস্কৃতিক বর্গ তৈরি করে নয়া অর্থ সঞ্চালন করছে তা নিয়ে।

কে কাহারে করে!

একজন সার্বভৌম ভোক্তা হিসেবে, কোনটি চলচ্চিত্র কিংবা কোনটি না সেই বিষয় নিয়ে আমার কোনো দুর্ভাবনা হয় না। তেমনি কোনটা ‘রুচিশীল’ কিংবা কোনটি ‘অরুচিকর’ টিভি অনুষ্ঠান তা নিয়েও। হয় না কারণ দেখা বা না-দেখার এখতিয়ার আমার এখনো সংরক্ষিত আছে। কিন্তু একজন বিশ্লেষক হিসেবে, আমি না-ভেবে পারি না কী উপায়ে ভিস্যুয়াল নির্মাতা এবং পর্যালোচকদের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ বর্গবিভ্রাটের একটা উৎসবে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা চলচ্চিত্র বানাবেন নাকি বিজ্ঞাপনচিত্র বানাবেন এ বিষয়ে তাঁদের কাছে আব্দার করার কোনো কারণ নেই। সর্বোপরি এটা একটা সেমিখোলা বাজার। কিন্তু খুব ঝামেলা বাধে যখন তাঁরা চলচ্চিত্রের ওই কথিত নন্দন-উচ্ছ্বাস সমেত নিজের বিজ্ঞাপনচিত্রটি নিয়ে কথা কইতে থাকেন। যে লেগ্যাসিটির দায়দায়িত্ব নেহায়েৎ তাঁদের কাঁধেই নিয়েছিলেন তাঁরা, সিন্দাবাদের ভূতের মতো এখন সেটা কাঁধে চেপে থাকার কারণে দর্শককে মুর্দাবাহী বানানোর থেকে ভিন্ন এটা নয়। আবার অন্যদিকে, খুবই সমস্যা হয় যখন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা নিজেরা আকাট, নিষ্প্রাণ এবং এলোমেলো ছবি বানান, এফডিসির প্রতি অটুট রুচি-বিদ্বেষ সমেত।

এরকম একটা সময়ে অন্ততঃ দুটো বিষয় কর্তব্য মনে হয়, প্রশ্নমনস্কভাবে।

এক, বুঝতে চেষ্টা করা যে কীভাবে টেলিভিশন পুঁজি ঢাকার ভিস্যুয়াল দৃষ্টিভঙ্গির রূপকার হিসেবে দাঁড়িয়েছে এবং কীভাবে সজ্ঞান-অজ্ঞান নির্মাতারা সেই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার প্রজা হয়ে উঠছেন।

দুই, কেন এবং কীভাবে এফডিসির চলচ্চিত্র ‘ক্ষতিকর’ সেই বিষয়ে একটা অমূল্যাবোধাশ্রয়ী, অবিচারমনস্ক খতিয়ান তৈরি করা, এবং কীভাবে সেই কারখানার রূপবদল সম্ভব, যদি আদৌ হয়, তার একটা রূপরেখা বানানো।

‘বিকল্পে’র মিশন যদি সর্ববিহারী, অ-প্রস্তুত, আত্মপ্রসন্ন এবং কেবলাবিহীন হয়, তাহলে বিকল্প ধারাকে বুকে করে বসে থাকার বান্দা আমি না।

রচনা: ফেব্রুয়ারি ২০০৯, প্রকাশ: ম্যুভিয়ানার কোনো এক সংখ্যা ২০০৯ (২৬.১১.২০-তে কসরৎ করে সংযোজিত) 


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন