গাজীপুরের সিনেমা হল: ভালো-মন্দ?
হল রিভিউয়ের এই কিস্তিতে হাজির হয়েছি গাজীপুর জেলায় টিকে থাকা সিনেমা হল নিয়ে। ছবি দেখা বা বিনোদন পাওয়ার পরিবেশ সম্পর্কে জানবো আজ।এখানে কালের পরিক্রমায় নতুন/পুরোনো সিনেমা চালিয়ে সচল রয়েছে। লেখাটি তৈরি করতে সাহায্য করেছেন মুসাফির হৃদয় ও স্থানীয় সিনেমাপ্রেমীরা। কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না পড়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
গাজীপুর জেলায় মোট ৫টি উপজেলা গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালিগঞ্জ উপজেলা। চলুন কোন কোন সিনেমা হল টিকে আছে সে বিষয়ে যাওয়া যাক-
গাজীপুর সদর: এ উপজেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪টি সিনেমাহল টিকে আছে।
ক. চম্পাকলি সিনেমা
খ. বর্ষা সিনেমা
গ. উল্কা সিনেমা
ঘ. ঝুমুর সিনেমা
চম্পাকলি আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ হল। আনুমানিক ১২০০ আসন রয়েছে। এটি টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় অবস্থিত। পরিবেশ মধ্যমমানের হলেও পুরো গাজীপুর জেলায় যত সিনেমা হল আছে তন্মধ্যে চম্পাকলির পরিবেশ সবচেয়ে ভালো!
এটা এক ধরনের ওপেন সিক্রেট, বর্তমানে এফডিসিভিক্তিক ফিল্ম ব্যবসার অনেকখানি এই সিনেমা হলের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, ছবির কোয়ালিটি যত খারাপই হোক, এখানকার সিনেপ্রেমীরা প্রচন্ড ডেডিকেশনের সাথে বাংলা সিনেমা দেখে। নিয়মিত দর্শক এখানে বেশি হয় বলে চম্পাকলি সিনেমাহলের টিকেট সেলও হয় তুলনামূলক বেশি। আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই হলের পাশে পূর্বে আনারকলি নামে আরেকটি বৃহদাকারের হল ছিল, তবে সেটি প্রায় ৩-৪ বছর আগে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। দুটি হলের মালিক একজনই, স্থানীয় রাজনীতিবিদ সালাউদ্দিন সরকার।
চম্পাকলির পর পরিবেশের দিক থেকে বর্ষার অবস্থান। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সামান্য দুরে দক্ষিণ দিকে অবস্থিত মধ্যমমানের এই হলটি। এর ড্রেস সার্কেলের পরিবেশ বেশ ভালো, রিয়েল ক্লাস মোটামুটি। বর্ষাকে অনেকে মজা করে জাজের অলিখিত ঘাঁটি বলে! প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রযোজিত কিংবা পরিবেশিত সকল ছবি প্রথম সপ্তাহেই এই হলে প্রদর্শিত হয়। তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য নতুন ছবিও এ সিনেমাহলে প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
এরপর আছে জয়দেবপুরে ঝুমুর সিনেমা হল, যদিও বর্তমানে প্রচন্ডভাবে দর্শকখরায় ভুগছে। কারণ হিসেবে স্থানীয়দের কাছে যা শুনলাম, সামান্য দু’পয়সা লাভের খাতিরে এখানে এককালে প্রচুর বাজে ছবি চালানো হয়েছে। যার কারণে সিনেমা হলের নিয়মিত দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। একই কারণে জয়দেবপুর এলাকার চান্দনা ও নন্দিতা সিনেমা হল থেকে দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এই দুটি হল বর্তমানে যথাক্রমে গোডাউন ও টেইলার্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বছরখানেক আগে অশ্লীল সিনেমা প্রদর্শনের দায়ে ঝুমুর সিনেমাহল সাময়িক সিলগালা করলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ থাকে। এরপর হলের সামনের অংশটুকু চেইন শপ স্বপ্ন ভাড়া নিলে হলটির পুনরায় সংস্কার করে মধ্যমমানের পরিবেশে আনা হয় এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়। এখনো এখানে মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই দেহব্যবসা হয় বলে শোনা যায়।
পরিবেশের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে চৌরাস্তায় অবস্থিত উল্কা। অশ্লীল ও বাজে ছবি চালানোর জন্য এই হল বেশ কুখ্যাত! পূর্বে বেশ কয়েকবার এই হলকে সিলগালা করা হয়েছে। বর্তমানে তারা নতুন/পুরোনো ছবি মিলমিশ করে সিনেমাহল চালাচ্ছেন। ভেতরকার পরিবেশ ততটা সুবিধার মনে হয়নি, তাই এটিকে নিম্নমানের ক্যাটাগরিতে রাখা যায়।
কালিয়াকৈর উপজেলা: এ উপজেলায় মোট সিনেমা হল আছে ৩টি।
ক. সাগর সিনেমা
খ. রজনী সিনেমা
গ. মোহনা সিনেমা
দুঃখের বিষয় হলো তিনটি হলই চরম রুগ্ন অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে ফেলা হতে পারে। এতে করে কালিয়াকৈর উপজেলা সিনেমা হল শূন্য হয়ে যাবে।
সাগর সিনেমাহলের অবস্থান কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ডে, এ হলটি নিয়মিত নতুন ছবি প্রদর্শন করে। মোহনার অবস্থান কোনাবাড়ী এলাকার মৌচাক নামক এলাকায় , এখানে মাঝেমধ্যে নতুন ও বেশিরভাগ সময় পুরোনো ছবি প্রদর্শন হয়ে থাকে।
বাকি থাকা রজনী সিনেমাহলের অবস্থান চন্দ্রা এলাকার খাড়া ঝরা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দুরে। পুরো গাজীপুর জেলার সবথেকে ছোট সিনেমাহল এটি। এই হলটি মূলত সাধারণ ঘরবাড়ির মতো অর্থাৎ, ইট-বালু-সিমেন্টের দেয়াল ও টিনের চালা দিয়ে তৈরী। এখানে নতুন/পুরোনো ছবি মিলমিশ করে চালানো হয়। সাগর, মোহনা ও রজনী; এই তিন হলকে পরিবেশ অনুসারে নিম্ন-মধ্যমমানের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়।
শ্রীপুর উপজেলা: এই উপজেলায় মাত্র দুটি সিনেমাহল বর্তমানে টিকে আছে।
ক. বনরূপা সিনেমা
খ. শাপলা সিনেমা
বনরূপা মাওনা চৌরাস্তায় অবস্থিত, অন্যদিকে শাপলা শ্রীপুর বাসস্ট্যান্ডে। বনরূপা বর্তমানে যৌবন পেরিয়ে বৃদ্ধদশা পার করছে, যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হলের পরিবেশও ততটা সুবিধার না, ভেতরে বসার জায়গা, পর্দা, সাউন্ড… কোনোটাই সন্তোষজনক না। অন্যদিকে শাপলা সিনেমা হলের পরিবেশ তুলনামূলক ভালো, তবে তা সামান্যই। পর্দা, সাউন্ড মোটামুটি ধরনের হলেও দর্শকদের বসার জন্য এখানেও ভাঙাচোরা আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই দুইটি হলকে যথাক্রমে অতি নিম্নমানের ও নিম্নমানের ক্যাটাগরিতে রাখা যায়।
কাপাসিয়া উপজেলা: এই উপজেলায় মোট দুইটি হল রয়েছে।
ক. মনোরম সিনেমা
খ. রুনা সিনেমা
মনোরম কাপাসিয়া বাজারে অবস্থিত, অন্যদিকে রুনা চালাবাজারে অবস্থিত। শ্রীপুর উপজেলার হলগুলোর মতো এ হল দুটিও রুগ্নদশায় ভুগছে। দর্শক উপস্থিতির অভাবে মনোরমে মাত্র দুটি শো চলে, সকাল ও রাতের শো হয় না। মূলত গত দশকের ব্যাপকভাবে অশ্লীল সিনেমা প্রদর্শনের কারণেই সাধারণ জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এরপর আবার একটা সময় জুড়ে প্রচুর নকল ছবির প্রদর্শন এসিনেমাহলগুলির মূল ক্ষতিটা করে দিয়ে গেছে। এছাড়াও এখানকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এর আগে বাজে ছবি প্রদর্শনের জের ধরে বেশ কয়েকবার সিনেমাহল ভাঙচুর করেছে বলে শোনা যায়। তাই অনেকে শঙ্কিত হয়ে আর সিনেমাহলমুখী হচ্ছে না।
কালিগঞ্জ উপজেলা: এই উপজেলায় কোনো সিনেমা হল অবশিষ্ট আছে- এমন কোনো খোঁজ পাইনি। গাজীপুরের একমাত্র হলবিহীন উপজেলা।