চম্পার কাছে ঋণী মান্না ও আমরা
বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি প্রজন্মের শেষ মহানায়ক চিত্রনায়ক প্রয়াত মান্না সম্পর্কে অনেকে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক কথাই বলেন। অনেকে মান্নার উত্থান ও একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে শুধু কাজী হায়াতের নাম উচ্চারণ করেন যা অর্ধ সত্য পুরো সত্য নয়।
কাজী হায়াৎ মান্নাকে দিয়ে একাধিক কালজয়ী চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছিলেন সত্য যা মান্নাকে আলাদাভাবে দর্শকপ্রিয়তা দিয়েছিল এবং মান্নাকে চলচ্চিত্রে একটি ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল কিন্তু ৭ বছর একটানা দ্বিতীয় সারির নায়ক হিসেবে কাজ করে একক নায়ক হিসেবে শক্ত ভিত্তি গড়ার পেছনে শুধু কাজী হায়াৎ নয় আরও একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতা ছিল যা না থাকলে এককভাবে কাজী হায়াতের পক্ষে সম্ভব ছিল না মান্নাকে দ্বিতীয় সারির নায়ক থেকে সোনালি প্রজন্মের শেষ মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার।
অথচ আমরা কাজী হায়াত ছাড়া বাকিদের কথা কেউই বলিনা। আজ আপনাদের সেই একাধিক ব্যক্তির মধ্য থেকে একজনের কথা সংক্ষেপে বলবো।
১৯৯১ সাল। মান্না তখনও আমাদের কাছে দ্বিতীয় সারির খুব সাধারণ একজন চিত্রনায়ক। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ এই কবছরে মান্নার ক্যারিয়ারে পাগলী, তওবা, ছোট বউ, নিস্পাপ, বাদশা ভাই, বাপবেটা ৪২০, যন্ত্রণা সহ বেশকিছু ভালো ও সফল চলচ্চিত্র ছিল যার সবগুলোতে (কাজী হায়াতের যন্ত্রণা ব্যতিত) মান্না ছিল দ্বিতীয় নায়ক।
১৯৮৬ সালে আলমগীরের ‘নিষ্পাপ’ সিনেমায় সর্বপ্রথম মান্না-চম্পা একসাথে অভিনয় করেছিলেন যদিও সেই সিনেমায় চম্পার নায়ক ছিলেন আলমগীর ও জসিম।
চলচ্চিত্রে যখন চম্পা কাঞ্চনের সাথে জুটি বেঁধে দারুণ সময় পাড় করছিলেন। বলতে গেলে মান্নার চেয়ে তখন চম্পা অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত। সেই মুহূর্তে পরিচালক মোস্তফা আনোয়ার তখন প্রথম সারির জনপ্রিয় নায়িকা চম্পার সাথে মান্নাকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘কাসেম মালার প্রেম’ নামের একটি ফোক গল্পের চলচ্চিত্র।
চম্পা চাইলে সেদিন মান্নার সাথে চলচ্চিত্রটি না করলেও পারতেন কিন্তু তিনি ছিলেন চরম পেশাদার একজন অভিনেত্রী তাই ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার সময়ও দ্বিতীয় সারির নায়ক মান্নার সাথে অভিনয় করতে রাজী হলেন।
মোস্তফা আনোয়ারের নির্মাণশৈলী, আবু তাহেরের মন মাতানো ফোক গান এবং মান্না-চম্পার অভিনয় মিলিয়ে ‘কাসেম মালার প্রেম’ হয়ে গেলো সুপার ডুপার হিট যা ছিল আশাতীত ব্যবসা। এই ‘কাসেম মালার প্রেম’ চলচ্চিত্রটি দিয়ে নতুন এক মান্নার জন্ম হয় সেদিন এবং পরিচালকদের কাছে মান্না-চম্পা নতুন একটি সফল জুটি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
এ চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সফলতা দেখে মনতাজুর রহমান আকবর, বুলবুল আহমেদ, অশোক ঘোষ, সাইফুল আজম কাশেম, শাহ আলম কিরণসহ একাধিক পরিচালক মান্না-চম্পাকে নিয়ে নতুন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে লাগলেন।
মোস্তফা আনোয়ার প্রথম ছবির পরপরই নির্মাণ করেন ‘অন্ধ প্রেম’ নামের আরেকটি আধুনিক রোমান্টিক চলচ্চিত্র যেখানেও তিনি সফল হয়েছিলেন। চম্পা-কাঞ্চনের সাথে চলচ্চিত্র কমিয়ে দিয়ে মান্নার সাথে একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করলেন এবং দারুণ সফলও হলেন যার ফলে কাঞ্চনের সাথে তখন দিতির আরেকটি সুপারহিট জুটি গড়ে উঠে। ততদিনে চলচ্চিত্রে নতুন মুখগুলোও সফল হতে শুরু করলেও একদিকে মান্না-চম্পা অন্যদিকে কাঞ্চন-দিতি একের পর এক সুপারহিট চলচ্চিত্র উপহার দিতে লাগলেন।
বুলবুল আহমেদের ‘গরম হাওয়া’, মনতাজুর রহমান আকবরের ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘বাবার আদেশ’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘খলনায়ক’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘গরীবের বন্ধু’, কাজী হায়াতের ‘দেশপ্রেমিক’, সাইফুল আজম কাশেমের ‘সাক্ষাৎ’, অশোক ঘোষের ‘শাদি মোবারক’, নূর হোসেন বলাইয়ের ‘শেষ খেলা’, এফ আই মানিকের ‘বিশাল আক্রমণ’ চলচ্চিত্রগুলো মান্না-চম্পা জুটিকে করে দিলো সুপারহিট ও জনপ্রিয় একটি জুটি আর নায়ক মান্না পেয়ে গেলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
৭ বছর ধরে দ্বিতীয় সারির নায়ক মান্না হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রের মহাব্যস্ত একজন প্রধম সারির নায়ক। দেখতে দেখতে মান্না একসময় হয়ে গেলেন প্রযোজক পরিচালকদের কাছে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ১ নম্বর নায়ক যা মান্না মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত টানা প্রায় ১০ বছর ধরে রেখেছিলেন ।
আমি মান্নার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে সেদিন মোস্তফা আনোয়ারের ‘কাসেম মালার প্রেম’’ চলচ্চিত্রে যদি ক্যারিয়ারে তুঙ্গে থাকা প্রথমম সারির চিত্রনায়িকা চম্পা অভিনয় করতে রাজী না হতেন কিংবা চম্পা যদি মান্নার সাথে এতোগুলো চলচ্চিত্র না করতেন তাহলে মান্নাকে দিয়ে কাজী হায়াৎ একা মান্নার চলার পথটা মসৃণ করতে পারতেন না।
মান্নার উত্থানের পেছনে কাজী হায়াতের অবদান যেমন আছে তেমনি চম্পার মতো আরও কজন মানুষের সাহসী পদক্ষেপগুলোও রয়েছে যার কথা আমরা কেউই বলি না। কাজী হায়াৎ শুধু জনপ্রিয় মান্নার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সাহায্য করছিলেন কিন্তু একজন মান্নাকে জনপ্রিয় ও সফল করার পেছনে চম্পার মতো একজন বড় মাপের অভিনেত্রী, মোস্তফা আনোয়ার, মনতাজুর রহমান আকবরদের মতো পরিচালকদের ভূমিকা বিশাল যা অস্বীকার করা মানে মহানায়ক মান্নাকেই অপমান করা।