Select Page

স্বল্পদৈর্ঘ্য গল্পে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র

স্বল্পদৈর্ঘ্য গল্পে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র

দাগ হৃদয়ে
ধরন : রোম্যান্টিক-অ্যাকশন-ড্রামা
পরিচালক : তারেক শিকদার
প্রযোজনা : ভিশন প্লাস লি.
কাস্ট : বাপ্পী চৌধুরী (সোহাগ), বিদ্যা সিনহা মিম (সোহানা/নির্জন), আঁচল আঁখি (নাবিলা), শতাব্দী ওয়াদুদ (নিপু), ডি.জে সোহেল (রাজা), অরুনা বিশ্বাস (সোহাগের মা), রিনা খান (সোহানা ও নাবিলার মা) প্রমুখ।
শুভমুক্তি : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

নামকরণ : ঠিক কী বললে নামকরণের সার্থকতা ফুটে উঠবে তা আমার মুখে আসছে না; যদি স্পয়লার হয়ে যায়। তাও কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করি..

লন্ডনে পড়ুয়া এক বাংলাদেশি ছেলে কোনো  মাধ্যমে তারই স্বদেশি একজন অখ্যাত চিত্রশিল্পীর কিছু চিত্রকর্ম খুজে পান। চিত্রকর্মগুলো এতোটাই সুন্দর যে এগুলা তার মনে অর্থ্যাৎ হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এই ছিল নামের যথার্থতা। যদিও সেন্সর পাওয়ার আগে ছবির নাম ছিল ‘দাগ’, সেন্সরে গিয়ে নাম পরিবর্তন হয়ে হলো ‘দাগ হৃদয়ে’।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : গল্পের নায়ক সোহাগ; যিনি লন্ডনে লেখাপড়া করার সময় পার্টটাইম জব করতো কোন এক আর্ট গ্যালারিতে। সেখানে বাংলাদেশি কোন চিত্রশিল্পীর আঁকা কয়েকটা ল্যান্ডস্কেপ দেখে ভালো লেগে যায়; সে মনে করে চিত্রশিল্পী নিশ্চিত সুন্দর মনমানসিকতার কোন মেয়ে মানুষ। সে সেই চিত্রশিল্পীকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।

একসময় সে খুঁজতে খুঁজতে সিলেটে চলে আসলে সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় গল্পের দুই নায়িকা সোহানা ও নাবিলার সাথে, যারা আত্মিক ও পারিবারিক সূত্রে এক সূতোয় গাঁথা। তারা জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে একে অপরকে। দুই নায়িকার নানা ঘটানার মধ্যেই সোহাগ খুঁজতে থাকে তার স্বপ্নের চিত্রশিল্পীকে। খুঁজতে গিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে একই এলাকার একাধিক মন্দ মানুষের সাথে; গল্প মোড় নেয় পারিবারিক ও রোমাঞ্চকর সব ঘটনার দিকে।

ছবির গল্প লিখেছেন প্রযোজক কামাল আহমেদ; চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন মো. রফিকুজ্জামান। গল্পের আইডিয়াটি খারাপ লাগেনি, খারাপ লেগেছে দায়সারা অগোছালো চিত্রনাট্য। সোহাগ কীভাবে জানলো সেই চিত্রশিল্পী সিলেটেই থাকে, সে ব্যপারে পরিষ্কার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। আবার নাবিলার সাথে পরিচয় হবার পর তার সাথে হওয়া ঘটনাবলী নিয়েও সুস্পষ্ট কোনো লজিক খুঁজে পাইনি। মানে জোর করে গল্প এদিক-সেদিক করে লজিককে একদম এতিম বানিয়ে দিয়েছে।

একরাশ হতাশা নিয়েই বলছি, খুবই বাজে এবং ম্যাড়মেড়ে হয়েছে এ ছবির চিত্রনাট্য। ছবির প্রথমার্ধতে তাও পর্দার সামনে আটকে থাকা যায়, দ্বিতীয়ার্ধ রীতিমতো ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। আর সংলাপের কাজ মোটামুটি চললেও অতিরঞ্জিত ভাবটা রয়েই গেছে। পাওয়ারফুল ডায়ালগ তেমন পাইনি, উপরন্তু আশি-নব্বই দশকের ছবির মতো বড় বড় ডায়ালগে ভরিয়ে রাখা হয়েছে ছবি।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩০

পরিচালনা ও অভিনয় : এটি পরিচালক তারেক সিকদারের প্রথম ছবি। গুণী পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের সহকারী হিসেবে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। অন্তত আশা করেছিলাম অন্য ৮/১০ দশজন নতুন পরিচালকের তুলনায় তিনি কিছুটা হলেও পরিপক্কতা দেখাতে পারবেন। কিন্তু না, তেমন কিছুই হয়নি। অন্যসব পুরনো এফডিসির পরিচালকের মতোই তিনি ফর্মূলা প্রয়োগ করেছেন মাত্র। ৫ টা গানের শ্যুট নাও, ৩ টা ফাইট সিন রাখো, নায়ক-নায়িকা-ভিলেন সবার আলাদা আলাদা এন্ট্রি সিন রাখো, তিন/চারটি কমেডি-ড্রামা সিন রাখো; ব্যস! দেড় ঘন্টা শেষ। বাকি এক ঘন্টা সবকিছু টেনে লম্বা করো। এই হলো ফর্মূলা সিনেমা।

সেরা অভিনেতা বাছাই করতে গেলে বেশ বেগই পেতে হবে। রিনা খান ছাড়া তেমন কারো অভিনয়ই আমার পূর্বের তুলনায় ভালো লাগেনি; আগের মতোই লেগেছে। আবার রিনা খানও যে একদম কাঁপিয়ে দিয়েছেন তেমনটাও না, অনেকদিন পর তাকে বড়পর্দায় দজ্জাল মা-এর চরিত্রে দেখলাম তাই এনজয় করতে পেরেছি।

বাপ্পী চৌধুরী বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ এ বলেছেন, ছবি দেখে তার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে, তিনি শুধরে নিবেন। সে জন্যই বলছি, তার বাংলা এবং ইংরেজী শব্দচয়নে অনেক দুর্বলতা আছে। এটা শোধরাতে হবে। ভয়েসে প্রবলেম তো সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, এটার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। এছাড়া শরীর কমিয়ে আরো স্লিম হতে হবে। যেকোনো চরিত্র পর্দায় উপস্থাপনের সময় ঐরকম ‘বাচ্চা-বাচ্চা’ টাইপ স্বভাব দেখানো যাবে না। এগুলো যদি শোধরানো যায়, তবে এখনকার বাপ্পীর তুলনায় ভবিষ্যতের বাপ্পী কয়েকগুণ পরিণত মনে হবে।

ছবির দুই নায়িকা বিদ্যা সিনহা মিম এবং আঁচল আঁখি প্রায় সমান স্ক্রিনটাইম পেয়েছেন, এটা অবশ্যই একটা ভালো দিক। মিমের অভিনয় মোটামুটি লেগেছে। আঁচলকে অনেকদিন পর বড়পর্দায় দেখলাম, তার শরীরের অতিরিক্ত মেদ খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। এমনিতে তার অভিনয়ও মোটামুটি, তাকে বেশকিছু অ্যাকশন দৃশ্যেও দেখা গেছে।

রিনা খানের সাথে ছবির বাকি দুই ভিলেন হলেন শতাব্দী ওয়াদুদ ও ডি.জে সোহেল। তাদের রোলগুলো এতোটাই দূর্বল ছিল যে প্রায় সময়ই তারা হারিয়ে গিয়েছেন। একইকথা অরুনা বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও, তাকেও খুব কম সময় স্ক্রিনে দেখা গেছে।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৪০

কারিগরি : অন্য দশটা ছবি যদি গল্প কিংবা অভিনয়ের দিক থেকে দূর্বল হয়, চেষ্টা করে কারিগরি দিক দিয়ে সেই দুর্বলতাগুলো ঢেকে ফেলার। এই ছবির কারিগরি দিক বরং অন্যান্য দিকগুলিকে দুর্বল করেছে। ভালো লাগার বিষয় ছিল মাত্র দুটি – সবার ড্রেসআপ ও লোকেশন।

পুরো ছবিটি সিলেটে শ্যুট করা। চা-বাগান, পাহাড়-টিলা, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তাসহ অনেক কিছুই দেখলাম; কিন্তু কিছুতেই মন ভরেনি ভালো সিনেমাটোগ্রাফি এবং এডিটিংয়ের অভাবে। কালার গ্রেডিং উন্নত লাগেনি। প্রথমার্ধে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ বেশ ভালো, কিন্তু সেই ভালোলাগাটা কেন জানি ছবির দ্বিতীয়ার্ধে আর কাজ করেনি। এখন কেউ যদি বলে ছবি তিন বছর আগে শ্যুট করা তাই এতো কারিগরি দৈন্যদশা, সেটা খোঁড়া যুক্তিই মনে হবে। কারণ, ২০১৬ থেকে আমাদের ছবির সিনেমাটোগ্রাফি এবং এডিটিংয়ের লেভেল একটা ভালো পর্যায়ে  এসে দাড়িয়েছিল। বাপ্পী’র ‘ওয়ান ওয়ে’ কিংবা ‘আমি তোমার হতে চাই’ দেখুন, আপনা-আপনিই উত্তর পাওয়া যায়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৩০

বিনোদন : গান রয়েছে ৫টি। তার মধ্যে ইমরান ও ঐশীর গাওয়া ‘হৃদয়ে এতোদিন’ ভালো লেগেছে। এছাড়া ‘ভালোবাসার বর্ণমালা’ মোটামুটি। বাকি একটি গানও ভালো লাগেনি। তবে আইটেম সং বাদে বাকি গানের লিরিক্স ভালো ছিল, কোনো বাজে বা আজগুবি শব্দের ব্যবহার হয়নি।

বাপ্পী-মিম জুটি এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো বড়পর্দায় হাজির হলেন। বাপ্পী-আঁচল জুটি সংখ্যার দিক থেকে আরো বেশি, নবমবারের মতো। দুটি রসায়নই মোটামুটি ভালো লেগেছে। চিত্রনাট্য আরো ভালো হলে হয়তো তাদের কেমিস্ট্রি আরেকটু জমতো।

ছবিতে বিনোদনের মাত্রা খুবই কম। প্রথম দিকে দুই নায়িকা ও এক নায়কের প্রেম বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখনই ধীরে ধীরে গল্প চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করা হয় তখনই জিনিসটা বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে যায়। আর শেষ ক্লাইম্যাক্সের কথা আর কী বলবো.. ডামি অস্ত্র তো কত ছবিতেই ব্যবহার করতে দেখলাম। কিন্তু এমন সস্তা খেলনা বন্দুক, শর্টগানের ব্যবহার অন্তত বিগত কয়েক বছরের মধ্যে দেখিনি। আর ছবির শেষটাও হয়েছে খুবই পরিচিত স্টাইলে। নব্বই দশকের ছবিতে বাপ্পারাজের প্রেমিকার সাথে আরেক নায়ক থাকলে ক্লাইম্যাক্সে বাপ্পারাজের যা হতো, এক্ষেত্রেও তাই।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ২০

ব্যক্তিগত : এই ছবি নিয়ে প্রযোজক-বাপ্পী কথা কাটাকাটি, প্রযোজক-মিম বাকবিতন্ডা, প্রযোজক-আঁচল রাগারাগি। এতোসব ঝামেলার পরও কীভাবে যে ছবিটা মুক্তি পেলো, তাও আবার তিন বছরের মধ্যে, সেটিই বড় বিষ্ময়ের ব্যপার! অথচ আমরা অতীতেই দেখেছি, সামান্য প্রযোজক-পরিচালক ঝামেলা হলেই ‘ছায়া-ছবি’ বন্ধ হয়ে যায়, প্রযোজক-ডিস্ট্রিবিউটর ঝামেলা হয়ে ‘মৃত্যুপুরৗ’ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি নিজেদের মধ্যেই একাধিক ঝামেলা লেগে ‘অপারেশন অগ্নিপথ’ বন্ধ হয়ে গেলো।

যাই হোক, শূন্য প্রত্যাশা নিয়ে হলে ঢুকেছিলাম। বেরিয়েছিও শূন্য হাতেই, সাথে পকেটভর্তি হতাশা। একটা ছবি নিয়ে অভিনেতাদের মাথাব্যথা না-ই থাকতে পারে, তারা কখনোই এক ছবি টার্গেট করে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে না। কিন্তু একজন প্রযোজক কিংবা পরিচালকের মাথাব্যথা থাকা উচিত। আমার অভিনেতারা আমাকে সাহায্য করছে না, আমি অন্য উপায়ে আমার ছবিকে প্রমোট করি। টাকা তো আমার কাছে বিষয় না, ভালো প্রমোশন হলে ভালো লাভ আসবে।

যদি টাকাই মূখ্য বিষয় হয় তবে প্রযোজকদের অবশ্যই উচিত বাজার বুঝে এরপর কোটি টাকা ঢালা। কীভাবে কি করবো, লাভের অঙ্ক কীভাবে উঠবে সেসব নিয়ে যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখা; যাতে ছবিটি হল থেকে লস খেলেও অন্যান্য পার্টনারশিপের মাধ্যমে লগ্নি উঠে আসে। নাহলে ফেসবুকে হাপিত্যেশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা।

সবমিলিয়ে বলবো, ছবিটি অনেক বোরিং। এমন গল্প দিয়ে শর্টফিল্ম/টেলিফিল্ম বানানো চলে, সিনেমা বানানো খুবই কঠিন। হয়েছেও তাই, আশির দশকের মধ্যমমানের ছবির মতো। এখন ২০১৯ চলে, আশির দশকের সেই কিশোর এখন ভার্সিটি পড়ুয়া সন্তানের বাবা। সুতরাং, কালের যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বুঝতে হবে।

রেটিং : ৩/১০

ছবিটি কেন দেখবেন : বাপ্পী-মিম-আঁচল ফ্যানরা দল বেধে হই-হুল্লোড় একবার গিয়ে দেখে আসুন। একবার দেখার মতো ছবি।


মন্তব্য করুন