চলচ্চিত্রের ছেঁড়া পালে নতুন ‘হাওয়া’!
টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির নন্দিত নির্মাতা হিসেবে মেজবাউর রহমান সুমন। শূন্য দশকে আমাদের টিভি নাটকে যে কয়জন ভিন্নচিন্তা এবং সমাজ বাস্তবতা নিয়ে নতুন এক ধারার সূচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি।
২০০৫ সালে ‘আমি অরূপার কাছে যাচ্ছি’ নাটক দিয়েই সুমন নিজের মেধা, দক্ষতা এবং ভিন্নধর্মী চিন্তার যে ঝলক দেখিয়েছিলেন পরবর্তীতে একে একে ‘নুসরাত,সঙ্গে একটি গল্প’, ‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’, ‘ফেরার কোন পথ নেই, থাকে না কোন কালে’, ‘তারপর পারুলের দিন’, ‘দখিনের জানালা খোলা, আলো আসে আলো যায়’, ‘কফি হাউজ’ এর মতো আরো অনেক দর্শকপ্রিয় নাটক উপহার দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এমন একজন গুণী নির্মাতা কবে চলচ্চিত্রে নিজের অসাধারণ সৃষ্টি নিয়ে হাজির হবেন সেই প্রশ্ন সাধারণ দর্শক তো বটেই অনেক তারকা শিল্পী এবং ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত কলা-কুশলীদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। অবশেষে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর ২৯ জুলাই মেজবাউর রহমান সুমন হাজির হচ্ছেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’ নিয়ে।
সুমনের প্রথম সিনেমা তাই ব্যতিক্রম একটা কিছুর অপেক্ষায় যখন আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর পার করছি তখন গত ১ এপ্রিল প্রথম পোস্টার প্রকাশ করে রীতিমতো চমকে দেন তিনি। আগ্রহ আর প্রতীক্ষার মাত্রা আরও বেড়ে যায় যখন গত ৭ জুন ২ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ট্রেলারটি রিলিজ দেয়া হয়।
ফেইসকার্ড প্রোডাকশনের ইউটিউব চ্যানেলে ট্রেলারটা দেখে মুগ্ধ হননি এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা। যারা বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে নাক সিটকান তেমন দর্শকরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হাওয়া’র ট্রেলারের ভূয়সী প্রশংসা করেন এমনকি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার কথাও বলছেন।
মেজবাউর রহমান সুমন তার পুরো টিম নিয়ে চল্লিশ দিনের বেশি সময় নিয়ে সমুদ্রে পুরো সিনেমার শুটিং সম্পন্ন করেন। তবে গভীর সমুদ্রে একেবারেই অন্যরকম এক গল্প সেলুলয়েডে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় নিয়োজিত প্রতিটা শিল্পী এবং কলাকুশলীদের পরিশ্রম, কষ্ট, ধৈর্যের পরীক্ষা আরো বাড়িয়ে দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘বুলবুল’। কোনো কিছুই নির্মাতা সুমনের প্রত্যয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
‘বুলবুল’-এর সাথে লড়াইয়ের পর শুটিং যখন সম্পন্ন তখন দুনিয়াজুড়ে হানা দেয় মরণঘাতী করোনা। তাই শুটিং সম্পন্ন হবার পুরো তিন বছর পরে দর্শকদের সামনে হাজির ‘হাওয়া’। এবং প্রমোশনের অংশ হিসেবে সিনেমার পোস্টার, ট্রেলার, গান রিলিজের পর এই ‘হাওয়া’য় ভাসেননি এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না।
ছবির প্রথম গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। পুরোপুরি ভিন্ন রকম কথা, সুর, গায়কী আর মিউজিক সব মিলিয়ে উচ্চবিত্তদের মধ্য রাতে কোটি টাকার রেসিং কার থেকে একেবারে গ্রামাঞ্চলে নিম্নবিত্ত ভ্যান গাড়ি চালকের মোবাইলেও জায়গা করে নেয়া এই গান মুগ্ধতা ছড়িয়েই যাচ্ছে।
‘হাওয়া’র গল্প নাকি একালের রূপকথা। তবে সেই রূপকথায় মানুষের সম্পর্ক, প্রতিশোধ, ভালোবাসা আর মৃত্যু রহস্য জায়গা করে নিয়েছে। সমুদ্র পাড়ের মানুষ সিনেমার প্রধান উপজীব্য হলেও ‘হাওয়া’ সমুদ্র পাড়ের গল্প না বরং এটা উত্তাল সমুদ্রের গল্প বললেই মানানসই হয়। অনেক সিনেমা বা নাটকে সমুদ্র পাড়ের গল্প তুলে ধরা হলেও সমুদ্রে চলাচলরত সেই সাহসী মানুষগুলোর সমুদ্রের মাঝের গল্প আমরা দেখি নাই। তাই একভাবে বলা যায় নানা অজানা এবং কিছু জানা কাহিনী অবলম্বনে এক মৌলিক গল্প তুলে ধরতে চলেছেন সুমন এবং তার টিম।
প্রথম সিনেমা হিসেবে কনটেন্ট বা গল্প একটু রিস্কি মনে হলেও মেজবাউর রহমান সুমন যে অচেনা পথে বা স্রোতের প্রতিকূলেই হাঁটবেন সেটি তার পরিচিত জনেরা তো বটেই সাথে সাথে যারা তার পূর্ববর্তী কাজ গুলো দেখেছেন তারাও জানেন ভালো করে। ট্রেলার দেখে যতোটুকু জানা বা বোঝা যায়- গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলারে আটজন পুরুষের মাঝে হঠাৎ করেই হাজির হয় এক সুন্দরী তরুণী। তাকে ঘিরেই আস্তে আস্তে জমাট বাঁধে রহস্য। সেই রহস্যে হাজির হয় একরাশ মায়া এবং অমানবিক নিষ্ঠুরতা। ট্রলারে সৃষ্টি হওয়া নানা উত্তেজনা এক পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। যা থেকে ঘটে রক্তারক্তি।
টিকে থাকার এ লড়াইয়ে কেউ বেঁচে যায় আবার কেউ না চাইলেও মৃত্যুকে বরন করে নেয়। আবার এমন লড়াই যে, তাদের কাছে কোনো নতুন বিষয় না সেটাও শুনতে পারা যায় একটি সংলাপে, ‘এই দুনিয়ায় আমিও দুইবার মইরা গ্যাছিলাম। আমরা লগেরগুলা মইরা ভূত হইয়া গ্যাছে। আমি শুধু বাঁইচা গ্যাছি।’ এমন সংলাপ মনে কিছু প্রশ্ন নিয়ে আসার সাথে সাথে সিনেমা দেখার যে প্রবল আগ্রহ তৈরী করে।
মেজবাউর রহমান সুমনের কাহিনী এবং সংলাপে ‘হাওয়া’র চিত্রনাট্য লিখেছেন জাহিন ফারুক আমিন, সুকর্ণ শাহেদ ধীমান ও মেজবাউর রহমান সুমন। চিত্রগ্রহণে অসাধারণ চমক দেখিয়েছেন কামরুল হাসান খসরু। জানা গেছে বঙ্গোপসাগরের উপরের সৌন্দর্যের পাশাপাশি নিচের অদেখা সৌন্দর্য আমাদের চোখের সামনে উঠে এসেছে তার অসাধারণ নৈপুণ্যতায়। কালারগ্রেডিং, বিজিএম এর যে অংশবিশেষ ট্রেলারে দেখা গেছে তাতে এটুকু বলতেই হয় এই সিনেমা বিগস্ক্রিনে দেখার জন্য নির্মিত।
সব মিলিয়ে টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টে মেজবাউর রহমান সুমন যে ছাড় দেননি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্যামেরার পেছনের গল্পের পাশাপাশি ক্যামেরার সামনে তো এককথায় তারার হাট বসিয়েছেন সুমন। চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, সোহেল মণ্ডল, নাসির উদ্দিন খান, সুমন আনোয়ার, রিজভি রিজু, বাবলু বোস, মাহমুদ হাসানের মতো দেশের শক্তিশালী অভিনেতাদের পাশাপাশি এই সময়ের অন্যতম আলোচিত এবং প্রশংসিত অভিনেত্রী নাজিফা তুষির উপস্থিতি ‘হাওয়া’ সিনেমায় যে প্রশান্তির হাওয়া এনে দিয়েছে তা এক জমজমাট অভিনয় যুদ্ধ দেখার জন্য রীতিমতো কঠিন অপেক্ষার প্রহর হয়েই ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে।
নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে যে অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো সময়ের ধারাবাহিকতায় তা আজ বিলুপ্ত হলেও সেই সময়ে ঘটে যাওয়া অঘটনের রেশ আজো কাটেনি পুরোপুরি। উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনীর হল বিমুখতার সাথে সাথে মহিলা দর্শকদের সিনেমা হলে আসা বন্ধের যে অশনি সংকেত বেজেছিলো তার খেসারত আজো দিয়ে যাচ্ছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। মাঝে হঠাৎ হঠাৎ শ্বাস নেবার মতো আয়নাবাজি, মনপুরা, টেলিভিশন, দেবী, ঢাকা অ্যাটাক, কাঠবিড়ালী, শিকারী, নবাব, মাটির প্রজার দেশে, পোড়ামন-২, কমলা রকেট, ছুয়ে দিল মন, অজ্ঞাতনামা, রেহানা মরিয়ম নূর, গোর, হালদা, ডুব, বিশ্বসুন্দরী, স্বপ্নজাল বা শিমু’র মতো সিনেমা স্বস্তি নিয়ে আসলেও একটা ইন্ডাস্ট্রির সুদিন ফেরাতে তা পর্যাপ্ত নয় তা সকলেরই জানা।
গত ঈদে রিলিজ পাওয়া শান, গলুই অথবা এই ঈদে রিলিজ পাওয়া ‘পরাণ’ এর মতো সিনেমা বক্স অফিসে সফলতার পাশাপাশি সাধারণ দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়। দর্শকদের সাথে রিলেট করতে পারে এমন গল্প আর চিত্রনাট্যের উপস্থিতি নতুন করে দেশীয় সিনেমার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে বিনোদনপ্রেমীদের এটা অবশ্যই সুখবর। বাংলা সিনেমা নিয়ে অনেকদিন পরে সবার মাঝে আগ্রহের মাত্রা বেড়ে গেছে এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তবে এই নিশ্চয়তার পালে আগামী ২৯ তারিখ রিলিজ পেতে যাওয়া সুমনের প্রথম সিনেমা ‘হাওয়া’ কতোটা সুবাতাস আনতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
গতানুগতিকের বাইরে যেয়ে বাণিজ্যিক সিনেমার দর্শকের ভাবনার জায়গা তৈরির ইচ্ছা থেকে মেজবাউর রহমান সুমনের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। শুভ কামনা রইলো দেশের এই গুণী নির্মাতার জন্য।