চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি: শিল্প ও বাণিজ্য
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়েই মূলত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশমাতৃকা স্বাধীনতা লাভ করে। বলাবাহুল্য, এ বছরই কৃতী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে নির্মিত এ প্রামাণ্যচিত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যা উপস্থাপিত হয়েছে। জহির রায়হান এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে হানাদার বাহিনী পরিচালিত নারকীয় গণহত্যাকে একক বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসাবে নয়, বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই উপস্থাপন করেছেন। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গুণী এ নির্মাতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের মানবিক ও মর্মস্পর্শী দিকগুলো তুলে ধরেছেন। সেলুলয়েডের পর্দায় তিনি বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামকে মিলিয়েছেন রাশিয়ার বিপ্লবের সঙ্গে। তাই স্টপ জেনোসাইড শুধু আমাদের দেশে নয়, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ প্রামাণ্যচিত্রটিও বহুল প্রশংসিত।
১৯৭১ সালে জহির রায়হানের হাতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল; তা আজও অব্যাহত। তবে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পাঁচ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে যে গতি ছিল; তা পরে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে! পরিসংখ্যান যদিও এখানে মুখ্য নয়, তবুও বলা প্রয়োজন প্রথম পাঁচ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তিভূমি ধরে ১১টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। অন্যদিকে এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে মাত্র ২২টি চলচ্চিত্র। মোটা দাগের এ পরিসংখ্যানের বাইরে আরও অনেক চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে; যেগুলোর সংলাপে-দৃশ্যায়নে পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের আবহের উপস্থিতি কমবেশি লক্ষণীয়। কিন্তু এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কিংবা সুচারুভাবে তৎকালীন সমাজ; জীবনযাত্রা ও সামগ্রিক ভয়াবহ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ সেভাবে আমাদের চলচ্চিত্রে উঠে আসেনি। এমনকি যে মহানায়কের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জš§; সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণিল জীবন ও কর্মের খুবই ক্ষুদ্রতম অংশ তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। তাকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করার বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও বিশেষ সীমাবদ্ধতায় (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উল্লেখযোগ্য) তা হয়ে ওঠেনি। তারপরও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর বেশ কয়েকটি শিল্পমানোত্তীর্ণ এবং এর বেশ কয়েকটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা যেমন তুলনামূলকভাবে কম, তেমনি যা নির্মিত হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোতেই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নারীর তথা প্রান্তিক মানুষের উজ্জ্বল উপস্থিতির যথার্থ প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়নি। বরং কখনো কখনো এসব চলচ্চিত্রে শিল্পের চেয়ে বাণিজ্য মুখ্য হয়েছে। তাই ওরা এগারোজন; ধীরে বহে মেঘনা; অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর মতো সুনির্মিত নিপুণ ও বর্ণিল গাঁথুনির চলচ্চিত্রের বাইরে স্রেফ বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম পুঁজি ধর্ষণ অত্যন্ত কদর্যভাবে, বিকৃতভাবে ব্যবহার হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা ও বাঘা বাঙালী’ চলচ্চিত্রে। পরিচালক, চলচ্চিত্র সমালোচক আলমগীর কবির এ দুটি চলচ্চিত্র নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার সাথে লক্ষ করছি যে, এর (রক্তাক্ত বাংলা) মুখ্য উদ্দেশ্য মুক্তি আন্দোলনের কোন দিককে সততার সাথে তুলে ধরবার চেষ্টা নয় বরং রক্তাক্ত বাংলা ছবির চিত্রায়ণ দেখে মনে হয়েছে যে, পরিচালকের ব্যবসায়িক সাফল্যের পুনরাবৃত্তির চেষ্টা চালানো হয়েছে। আর প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম যে, পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণের চলচ্চিত্রায়ণের মধ্যে বিরাট একটা বাজারি সম্ভাবনা রয়ে গেছে। আর কয়েকদিনের মধ্যে সে ভয় সত্য বলে প্রমাণিত হলো। মুক্তি পেল ‘বাঘা বাঙালী’ নামক একটি ছবি, যেটিকে বাঙালি জাতির সর্বকালের লজ্জা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। চলচ্চিত্রের সস্তা স্লোগান আর নিুরুচির কতগুলো নাচ, গান জুড়ে ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যের দিকে নজর দিতে গিয়ে পরিচালক ভুলেই গেলেন মুক্তিযুদ্ধ ও তার ত্রিশ লাখ শহিদের স্মৃতির প্রতি কত বড় অবমাননা প্রদর্শন করেছেন।”
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি চলচ্চিত্রে বীরাঙ্গনাদের পরিণতি দেখানো হয় আত্মহত্যায়। কিন্তু অনেক বীরাঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্বিষহ সময়কে অতিক্রম করে ভিন্নভাবে স্বাভাবিক জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। চলচ্চিত্রে সেই সংগ্রামী জীবনের ছোঁয়া লাগেনি। আর পাকহানাদারদের ধর্ষণের দৃশ্যকে চলচ্চিত্রের দর্শক টানার উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী একটি গণমাধ্যম। অথচ এ গণমাধ্যমে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই অনেক সময় শিল্পের চেয়ে বাণিজ্য বড় হয়ে দেখা দেয়; মুক্তিযুদ্ধের বিশাল-বর্ণিল ক্যানভাস প্রাধান্য পায় না; বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয় নারীর অবমাননা, ধর্ষণ দৃশ্য।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
০১ ওরা এগারো জন- চাষী নজরুল ইসলাম, ১৯৭২
০২ বাঘা বাঙালী- আনন্দ, ১৯৭২
০৩ রক্তাক্ত বাংলা- মমতাজ আলী, ১৯৭২
০৪ অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী- সুভাষ দত্ত, ১৯৭২
০৫ আমার জন্মভূমি- আলমগীর কুমকুম, ১৯৭৩
০৬ আবার তোরা মানুষ হ- খান আতাউর রহমান, ১৯৭৩
০৭ সংগ্রাম- চাষী নজরুল ইসলাম, ১৯৭৪
০৮ আলোর মিছিল- নারায়ণ ঘোষ মিতা, ১৯৭৪
০৯ বাংলার ২৪ বছর- মোহাম্মদ আলী , ১৯৭৪
১০ কার হাসি কে হাসে- মোহাম্মদ আলী, ১৯৭৪
১১ মেঘের অনেক রং- হারুনুর রশিদ, ১৯৭৬
১২ বাঁধন হারা- এ জে মিন্টু, ১৯৮১
১৩ কলমীলতা- শহীদুল হক খান, ১৯৮১
১৪ চিৎকার- মতিন রহমান, ১৯৮২
১৫ আগুনের পরশমণি- হুমায়ূন আহমেদ, ১৯৯৪
১৬ এখনো অনেক রাত- খান আতাউর রহমান, ১৯৯৭
১৭ হাঙর নদী গ্রেনেড- চাষী নজরুল ইসলাম, ১৯৯৭
১৮ জয়যাত্রা- তৌকীর আহমেদ, ২০০৫
১৯ শ্যামল ছায়া- হুমায়ূন আহমেদ, ২০০৫
২০ খেলাঘর- মোরশেদুল ইসলাম, ২০০৬
সরকারি অনুদানে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র
২১ মেঘের পর মেঘ- চাষী নজরুল ইসলাম, ২০০৪
২২ ধ্রুবতারা- চাষী নজরুল ইসলাম, ২০০৬
তালিকার চলচ্চিত্রগুলো ছাড়া আরও কিছু চলচ্চিত্রের নাম পাওয়া যাবে। আর বিকল্পধারার নির্মাতাদের মধ্যে মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ (স্বল্পদৈর্ঘ্য), তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতি’, তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত ‘মাটির ময়না’, শামীম আখতারের ‘ইতিহাস কন্যা’ ও ‘শিলালিপি’ মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভিত্তিতে সুনির্মিত চলচ্চিত্র। বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের মান ও নির্মাণশৈলী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পসম্মত। এর পেছনে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি একটি বড় অনুঘটক। অন্যদিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকৃত অর্থ দর্শকের পকেট থেকে বের করে আনার বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে কোনো কোনো সময় শিল্পমান, শালীন-অশালীনের ভেদাভেদ হার মানে! তখনই ছিটকে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনা; উটকো রগরগে দৃশ্য দখল করে চলচ্চিত্রের পর্দা।
বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কারণ এখানে বিষয়-বৈচিত্র্য ও চলচ্চিত্র উপাদানের কমতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, এ দেশে চলচ্চিত্রের বাজার, দর্শক রুচি, শিল্প ও বাণিজ্যের মিশেল এবং পৃষ্ঠপোষকদের বাস্তব জ্ঞানের অভাবে অনেকেই পুরোপুরি সফল হতে না পেরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এর পেছনে ১৯৭১ সালের যুদ্ধদিনকে; সময়কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে যে ব্যাপক আয়োজন ও বাজেটের প্রয়োজন তার অপ্রতুলতাও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ‘১০ মণ তেলও পুড়ে না, রাধাও নাচে না’র মতো হয়ে পড়ে নির্মাণকর্ম! মেকি মনে হয় চলচ্চিত্রের উপাদানকে!
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। আবার সে অর্থ তুলে আনাও সম্ভব হয়। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণে বাঘের চোখ থেকে শুরু করে স্বর্গ-নরক সবই বাস্তবের আদলে, আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষে কখনো কখনো বাস্তবের চেয়ে একধাপ এগিয়ে দেখানো সম্ভব হয়! সেসব দেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী-কলাকুশলীরা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের লব্ধ অভিজ্ঞতা অন্যদের জানানোর জন্য নিয়মিত সভা করা ছাড়াও তথ্যবহুল পত্র-পত্রিকা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। আমাদের দেশে এমন কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যেসব নির্মাতা তাদের জীবনচরিত পাঠ ও চলচ্চিত্রের কাহিনী বিশ্লেষণ-গবেষণার দাবি রাখে। একইসঙ্গে চলচ্চিত্রগুলোর নির্মাণ ব্যয় ও ব্যবসায়িক সাফল্য-ব্যর্থতা; শিল্পগুণ ও বাণিজ্যিক উপকরণের উপস্থিতি বিষয়েও বিশদ আলোচনা ও গবেষণা হতে পারে। এসব নির্মাতাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে শিল্প ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে মতামত ও চলচ্চিত্রের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়নও নতুন প্রজš§কে জানানো প্রয়োজন।
বিশেষভাবে গবেষণার দাবি রাখে— ১) চলচ্চিত্রে শিল্পের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বেশি ব্যবহৃত হয়েছে নাকি বাণিজ্যিক কারণে মুক্তিযুদ্ধকে ট্যাগ করা হচ্ছে। ২) শিল্পসম্মত ও বাণিজ্যিক ঘরানায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোর পৃথক তালিকা ও বিস্তারিত আলোচনাও সময়ের দাবি। ৩) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ চিহ্নিত ও করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ জরুরি। ৪) একটা সময় ছিল- চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা নিয়মিত আলোচনা-সমালোচনা লিখতেন; এখন সে ধারা প্রায় বিলুপ্তির পথে! এ ধারাটি ফের সচল করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে চলচ্চিত্র সাংবাদিক, সমালোচক ও বোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ সংশ্লিষ্টরা কী কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা চিহ্নিত করা এবং এসব সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ব্যাপারে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আবার যেসব চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের বাণিজ্যিক (নেতিবাচক অর্থে ধর্ষণ; নারী নির্যাতন; পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনচিত্রের নামে অশ্লীলতার আশ্রয়) উপস্থিতি বিদ্যমান সেগুলোর কুফল-সুফল(!); শিল্পমানসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোর ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণও বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র বাজারজাতকরণে প্রযোজকসহ সংশ্লিষ্টরা কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছেন; সেসব সমস্যা সমাধানে করণীয় কী; কোন শ্রেণির দর্শক কোন ধরনের চলচ্চিত্র পছন্দ করেন; সেসব বিষয়ও চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা- নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেম জাগ্রত করার স্বার্থেই দরকারি।
ব্যাপক ও বিশাল ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা সেই ক্ষেত্র থেকে এখনো অনেক দূরে। এ ক্ষেত্রে শিল্প ও বাণিজ্যের অবস্থান কেমন হওয়া উচিত; মূলত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে কোন ধরনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দেশপ্রেম; ইতিহাস-নিষ্ঠা; ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করা; সামাজিকভাবে সচেতন করা সম্ভব— তা ঠিক করার বিকল্প নেই। একইসঙ্গে আরও কয়েকটি সম্ভাবনার দিক রয়েছে- ক. চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধিতে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনির গুরুত্ব, খ. কীভাবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের নির্মাণ বাড়ানো সম্ভব, গ. চলচ্চিত্রের গুণগত মান উন্নয়ন ও ঘ. জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতে চলচ্চিত্র শিল্পের ভূমিকা।
এর বাইরেও সুনির্দিষ্ট কয়েকটি উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। যেমন; ক. চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতাদের আগ্রহের মাত্রা নিরূপণ করা, খ. চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, গ. চলচ্চিত্র বাজারজাতকরণের সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের উপায় বের করা, ঘ. মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে নতুন প্রজš§কে উদ্বুদ্ধ করা, ঙ. শুধু সংশ্লিষ্ট মহল নয়, দেশের সব শ্রেণির দর্শককে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখতে উদ্বুদ্ধ করা এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রাখা। এর ফলে সম্ভাব্য ও উৎসাহীরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হবে। নির্মাতাদের কর্মের প্রতি আরও উদ্যমী করা সম্ভব হবে। রোধ করা যাবে ইতিহাস বিকৃতি। দেশের দর্শক-শ্রোতারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে। একইসঙ্গে প্রযোজক-লগ্নিকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। নতুন প্রজš§ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবে এবং এ বিষয়ে আগ্রহীরা আরও চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হবে।
# এ লেখায় আলোচিত হয়েছে ১৯৭১ সাল থেকে ২০০৬ সালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র