Select Page

হারিয়ে যাওয়ার নন আবু তাহের

হারিয়ে যাওয়ার নন আবু তাহের

বহু পুরোনো একটা প্রবাদ হলো ‘কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালে পাজী’। বাংলাদেশের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির দিক এভাবে বলা যায়, আপনি যতদিন জীবিত আছেন এবং  কাজ করবেন ততদিন শুধু আপনাকে এই অঙ্গনের মানুষেরা ও দর্শক শ্রোতারা মনে করবে; এরপরই শেষ। আপনার কর্মগুলো যদি জীবিতাবস্থায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংরক্ষণ করেন তাহলে আপনার কর্মগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধারণা পাবে, নয়তো আপনি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন। 

রাষ্ট্র বা মিডিয়া অঙ্গন আপনাকে স্মরণ করবে না বা করলেও নামমাত্র কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোন তথ্য আপনার সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারবে না। যার ফলে এই দেশে যুগে যুগে গুণী আসে গুণী চলে যায়, কিন্তু গুণীদের কর্মগুলো থেকে কেউ শিখতে নাহি চায়। আজ তো এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছি, সেলিব্রেটির অভাব নাই কিন্তু মন ভরানো কাজের বড় অভাব। যুগ যুগ ধরে ধারণ করার মতো কালজয়ী সৃষ্টির বড় অভাব। 

আবু তাহের নামে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন এ কথা বর্তমান প্রজন্মের কতজন কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও শ্রোতারা জানেন বলতে পারবেন? আমি বিগত প্রায় দুই দশক ধরে লক্ষ্য করেছি যে আবু তাহের সম্পর্কে আমাদের প্রথম সারির ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া কাউকেই কখনো কিছু করতে দেখিনি,  কিছু বলতে শুনিনি। এমনকি তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতেও কোন আয়োজন দেখিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার কথা আর নাইবা বললাম। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ সিনেমাবোদ্ধা, সংগীতবোদ্ধা, নাটকবোদ্ধার অভাব নাই যাদের বয়স অধিকাংশ ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। আরও অবাক করার ব্যাপার হলো ‘গান বাংলা’ নামে এদেশে গানের একটা টিভি চ্যানেল আছে আছে যার কর্ণধারের ভাবসাবে মনে হয় তিনি হলেন বাংলাদেশের এ আর রহমান। সুযোগ পাইলেই মাঠে ঘাটে স্টুডিওতে শিল্পীদের পাশে পিয়ানো বাজিয়ে নিজেকে বিরাট বাংলার সুরস্রষ্টা এ আর রহমান হিসেবে জাহির করেন!  যিনি আবার ভারত থেকে সংগীতের জন্য দাদা সাহেব ফালকে পদকও অর্জন করেছেন। তো এই বাংলার বিরাট ক্ষমতাবান সুরস্রষ্টা এ আর রহমানকেও দেখিনি কখনো আবু তাহেরকে নিয়ে কোন কাজ করতে। 

আবু তাহের ও এন্ড্রু কিশোর

আবু তাহের হলেন সেই সুরকার ও সংগীত পরিচালক যিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র সংগীত পরিচালনা করে তাক লাগিয়েছিলেন। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করার পেছনে শুধু গল্প, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কৃতিত্ব ছিলো না, আবু তাহেরের অসাধারণ সুর সৃষ্টির গানগুলোরও অবদান ছিলো।  মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দী কারাগারে’ গানটি ছাড়াও চলচ্চিত্রের অন্য গানগুলো ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ (ভারতীয় গানের অনুকরণে), ‘পাহাড়িয়া সাপের খেলা’, ‘সাহেব সালাম বারে বার’-এর মতো ফোক ধাঁচের গানগুলো সেসময়কার দর্শকদের সিনেমা হলে ছবিটি দেখার সময়েই মনে গেঁথে গিয়েছিলো যার বড় একটা প্রভাব পড়েছিলো চলচ্চিত্রটির ব্যবসার ক্ষেত্রে।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবির গানের রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা হওয়ায় আবু তাহের সুর ও সংগীত পরিচালক হিসেবে ভারতের এইচএমভি কোম্পানি কর্তৃক ‘ডাবল প্লাটিনাম ডিস্ক পুরস্কার’ লাভ করেন। অথচ আজও যখন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা নিয়ে কথা উঠে কেউই আবু তাহেরের কথা বলে না; যা আমাদের সীমাবদ্ধতার পরিচয় দেয়। 

১৯৫৪ সালের ১ নভেম্বর বিক্রমপুরে  জন্মগ্রহণ করা আবু তাহের ছিলেন একুশেপদক প্রাপ্ত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ধীর আলী মিয়ার সন্তান, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন আলীর ভাতিজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হওয়ার পরেও অন্য কোন পেশায় না গিয়ে সংগীত পরিচালনাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। 

রুনা লায়লা ও অন্যদের সঙ্গে আবু তাহের

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আলম খান-আলাউদ্দিন আলী-আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল পরবর্তী যাকে মনে করা সুযোগ্য উত্তরসুরী তিনি হলেন আবু তাহের। খুব দ্রুত তিনি চলচ্চিত্রের মেধাবী সংগীত পরিচালক নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নেন। ফোক ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রের আধুনিক পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুলের প্রায় সব সুপারহিট চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন আবু তাহের। ফোক ফ্যান্টাসিতে যেমন নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন ঠিক তেমনি রোমান্টিক,  অ্যাকশন ধাঁচের চলচ্চিত্রেও নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। যার বড় একটা ট্রেডমার্ক হলো সালমান শাহ-শাবনূর জুটির প্রথম চলচ্চিত্র ‘তুমি আমার’-এর গানগুলো। তার সুর ও সংগীত পরিচালনা প্রায় সব চলচ্চিত্র হয়েছিলো সুপারহিট; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তোজাম্মেল হক বকুলের ‘শংখমালা’, ‘গাড়িয়াল ভাই’, ‘পাগল মন’, ‘বালিকা হলো বধূ’, ‘বাঁশীওয়ালা’, ‘আব্দুল্লাহ’, আলমগীরের ‘বৌমা’, এ জে রানার ‘ডন’, ‘আজকের হিটলার’,  মালেক আফসারীর ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘দুর্জয়’, ‘লাল বাদশা’, শাহ আলম কিরণের ‘রঙিন সুজন সখী’, এফ আই মানিকের ‘এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে’, তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘আশা ভালোবাসা’, জাকির হোসেন রাজুর ‘জীবন সংসার’ ও মোতালেব হোসেনের ‘ভালোবাসার ঘর’। আবু তাহেরের গানগুলোর সুর যেমন হতো আধুনিক ঠিক তেমন মেলোডিয়াস যা তার পূর্বসূরি আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো। খুব সহজেই গানগুলো দর্শক ও স্রোতাদের মনে গেঁথে যেতো। 

‘বেদের মেয়ে জোসনা’র ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানটি যেমন সারাদেশে সাড়া ফেলেছিলো ঠিক বছর ৫ পর জহিরুল হকের ‘তুমি আমার’ চলচ্চিত্রের ‘জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি কোথায় তুমি থাকো রে’ গানটি সারাদেশে সাড়া ফেলেছিলো। এ চলচ্চিত্রের সবগুলো  গান সেসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যা সেসময় বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ ও রেডিওর ‘অনুরোধের আসর’ অনুষ্ঠান দুটি খেয়াল করলেই প্রমাণ পাওয়া যেতো। ১৯৯৯ সালের ১৪  জুলাই মাত্র ৪৫ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ হয় তার। এর আগেই তিনি বাংলাদেশের প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে ফেলেন। 

আবু তাহেরের সুর করা উল্লেখযোগ্য কিছু গানের লিংক – 

আমি হ্যামিলনের সেই বাঁশীওয়ালা (শুভ্র দেব) –

https://app.box.com/s/0jqx708l4s61lu0lbjc4

চতুরদোলাতে চড়ে দেখ ঐ (কুমার বিশ্বজিৎ) –

https://app.box.com/s/193m0jqr2vj7yi0rbui8

বেদের মেয়ে জোসনা আমায় (এন্ড্রু কিশোর ও রুনা লায়লা) –

এই পথ চলি একা (এন্ড্রু কিশোর) –

এ দুটি ছোট্ট হাতে (এন্ড্রু কিশোর) –

জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি (কুমার বিশ্বজিৎ) –

জ্বালাইয়া প্রেমের বাত্তি (রুনা লায়লা) –

হাওয়ায় উড়ে হাওয়ায় ঘুরে (এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিন) –

গান আমি গেয়ে যাবো এই আসরে (এন্ড্রু কিশোর) –

প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসা (রুনা লায়লা ও আগুন) –

পৃথিবীতে সুখ বলে যদি কিছু (সাবিনা ইয়াসমিন ও আগুন) –

তুমি ছাড়া কাটে না প্রহর (এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিন) –

আমি নই ফেরেশতা নই দেবতা (খালিদ হাসান মিলু) –

আমার জন্ম তোমার জন্য (আগুন ও সামিনা চৌধুরী) –

https://app.box.com/s/g5d51auyhvs00g993i38


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন