Select Page

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ও অনন্ত জলিল: বাণিজ্যিক ছবিতে সাফল্যের ধাঁধা

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ও অনন্ত জলিল: বাণিজ্যিক ছবিতে সাফল্যের ধাঁধা

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার ও পরিচালক। তিনি ঠিক কতগুলো বাণিজ্যিক সিনেমার কাহিনি লিখেছিলেন তা হিসেব করে বলা তাঁর পক্ষেও হয়তো সম্ভব হবে না। ঝন্টুর পরিচালিত সিনেমা ষাটের অধিক হবে; যার প্রায় সবগুলোর কাহিনী তাঁর লেখা। এর বাহিরে অন্য পরিচালকদের ব্যবসাসফল অসংখ্য সিনেমার গল্প তাঁর লেখা ছিল। 

মজার ব্যাপার হলো, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর লেখা কাহিনি দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করে অন্য পরিচালকরা জাতীয় পুরস্কার পেলেও তিনি নিজের লেখা কাহিনি দিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে জন্য একটা পুরস্কারও পাননি। ১৯৯০ সালে ঝন্টুর কাহিনি ও সংলাপে দেশের অন্যতম সেরা পরিচালক কামাল আহমেদের ‘গরীবের বউ’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। শাবানার এসএস প্রোডাকশন প্রযোজিত ব্যবসাসফল সিনেমাটি বছরের অন্যতম সেরার স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেই সময়কার দর্শক হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে ঠিক একই কাহিনি নিয়ে ‘গরীবের বউ’ যদি ঝন্টু নির্মাণ করতেন তাহলে ব্যবসায়িক সফলতা পেলেও একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেতো না। এর চেয়ে আরও অনেক ভালো গল্পে ঝন্টুর পরিচালিত সিনেমা আছে; কিন্তু সেগুলো দর্শকপ্রিয়তা পেলেও জুরি বোর্ডের মন জয় করতে পারেনি। 

ঠিক একই রকম ঘটনা আছে প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনি, সংলাপ ও গীত রচয়িতা মোতালেব হোসেন এবং এ জে মিন্টুর বেলায়ও। ১৯৮৯ সালে জাতীয় পুরস্কারে সর্বাধিক শাখায় পুরস্কারপ্রাপ্ত মিন্টুর সাড়া জাগানো ‘সত্য মিথ্যা’র কাহিনিকার ছিলেন মোতালেব হোসেন। এ ছবির কাহিনি লেখার জন্য মোতালেব হোসেন কোন পুরস্কার না পেলেও মিন্টু শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার শাখায় এবং ছটকু আহমেদ শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। অর্থাৎ একই গল্প পরিচালক, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তিনটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পেলেও কাহিনিকার/গল্পকার কোন পুরস্কার পাননি। 

মোতালেব হোসেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়ের প্রভাবশালী ও সফল প্রযোজক-পরিচালক। অথচ তাঁর লেখা কাহিনি ও পরিচালিত অনেক ব্যবসাসফল সিনেমা যেগুলো কোন জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল বলে আমার জানা নেই। কিন্তু মাস্টার মেকার হিসেবে খ্যাত এ জে মিন্টুর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত একাধিক চলচ্চিত্রের পিছনে মোতালেব হোসেনের সম্পৃক্ততা ছিল। তারা ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ জে মিন্টু চারবার শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ মোট ৬টি জাতীয় পুরস্কার পেলেও মোতালেব হোসেন একবারও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পাননি। 

আবার স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার ছটকু আহমেদের দিকে তাকান; যিনি শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেলেও পরিচালক হিসেবে একবারও পুরস্কার পাননি। এমনকি রেকর্ড ব্যবসা করা ‘সত্যের মৃত্যু নেই’-এর জন্যও ছটকু আহমেদ পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পাননি। 

ঘটনাগুলো এ জন্য বললাম যে, আজকের অনন্ত জলিল ১০০ কোটি  টাকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করুক না কেন তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো এখনও সেই ক্লাস পর্যন্ত যেতে পারেনি যেখানে দর্শক ও সমালোচক দুটো শ্রেণীকেই সন্তুষ্ট করতে পারে। এসব নিয়ে অনন্ত জলিল নিজেও চিন্তা করে বলে মনে হয় না যার ফলে প্রতিবছর যে লাউ সেই কদু পাচ্ছে দর্শক ও চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি।   

প্রযোজনা, কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা এগুলো চলচ্চিত্রের আলাদা আলাদা শাখা আবার সবগুলো শাখাকে একত্রে সুনিপুণভাবে চালিত করতে পারেন কেবল একজন দক্ষ পরিচালক যা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। একটা সাদামাটা কাহিনিকেও অসাধারণভাবে উপস্থাপন করতে পারেন একজন পরিচালক যার প্রমাণ উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো। 

দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, মোতালেব হোসেন, ছটকু আহমেদ অবশ্যই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সফল কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক বটে কিন্তু তাঁরা সবসময়ই একটা ক্লাসেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তাঁদের পরিচালনার কারণে। তাঁরা কখনও চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে পারেনি পরিচালনার দুর্বলতার কারণে। তাঁদের দুর্বলতা ফুটে উঠেছিল ইন্ডাস্ট্রিতে তখন এহতেশাম, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন,  আজিজুর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কামাল আহমেদ, মমতাজ আলী, শিবলি সাদিক, কাজী হায়াৎ, এ জে মিন্টু, শহীদুল ইসলাম খোকন, আজহারুল ইসলাম খানের মতো অসাধারণ সব মেধাবী পরিচালকেরা ছিলেন বলেই।

তখন প্রতিযোগিতাটা এতো বেশি ছিল যে সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি, কাজী মোরশেদ, কবির আনোয়ারের মতো  আন্তর্জাতিক মানের  মেধাবী পরিচালকরা পর্যন্ত নিজেদের পুরো  মেলে ধরতে পারেননি। অনন্ত জলিল, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, জাজ মাল্টিমিডিয়া আজ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ ডালভাত রান্নার মতো সহজ রেসিপি বানিয়ে ফেলেছেন  যার ফলে বর্তমান চলচ্চিত্রগুলো ইন্ডাস্ট্রির কোন উপকারেই আসছে না। নতুন নতুন সিনেমা হল নির্মিত হচ্ছে না, নতুন পরিবেশক ইন্ডাস্ট্রিতে আসছে না যার ফলে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি এখন কখনও শিল্পী সমিতি, কখনও পরিচালক সমিতির নির্বাচন নিয়েই সরগরম থাকার চেষ্টা করে। সবাই একে অপরকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে, নোংরামি করে  নিজেকে চলচ্চিত্র  ইন্ডাস্ট্রির  বিরাট ত্রাতা হিসেবে জাহির করে কিন্তু প্রত্যেকই এক একটি মাকাল ফল। 


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন