Select Page

চারটে ছবি ও বাংলাদেশের গণমানুষের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ

চারটে ছবি ও বাংলাদেশের গণমানুষের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ

এদেশের সাধারণ জনগণকে নিয়ে আমার দেখা সাম্প্রতিক কালে তৈরী চারটে চলচ্চিত্র আমাকে আশাবাদী করেছে। ছবিগুলো হচ্ছে মুহাম্মদ কাইউমের “কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া”, খন্দকার সুমনের “সাঁতাও”, সৈয়দা নিগার বানুর “নোনা পানি” ও যুবরাজ শামীমের “আদিম”।

জনগণের জন্যে শিল্পের কথা অনেক বলা হয়, বলা হয় বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রের কথাও, কিন্তু বিরূপ প্রকৃতি ও বৈষম্যমূলক এ সমাজে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের যা প্রকৃত জীবনচিত্র, এদেশের বৃহত্তম মানুষেরা যারা মূলত: গ্রামে বাস করে, তাদের জীবন আসলেই যেমন, তা নিয়ে ভালো চলচ্চিত্র এদেশে খুব বেশী তৈরী হয়নি। সে ধরণের চলচ্চিত্র তৈরী করতে হলে নির্মাতাকে মাইলের পর মাইল গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হয়, নামতে হয় ডুবন্ত ধানক্ষেতে বা নোনাপানিতে, থাকতে হয় হতশ্রী বস্তীতে। সেই কঠিন কাজগুলোই করে দেখিয়েছেন এই চার ছবির নির্মাতারা। সিলেটের গহীন হাওড় অঞ্চলে কীভাবে কৃষকের ফসল ও স্বপ্ন ডুবে যায়, কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত ও পরিশ্রমী শুটিং করে তা তুলে ধরা হয়েছে “কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া” ছবিটায়। “সাঁতাও” হচ্ছে তিস্তা পারের দরিদ্র কৃষকদের দু:খ-কষ্টের কাহিনী। যে নদী কখনও খরা, কখনও বা বন্যার রূপ নিয়ে, হয়ে যায় এক অশ্রুনদী। উত্তরবঙ্গের হাজার হাজার দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারের এই জীবনমরণ সমস্যাটি ফুটে উঠেছে ছবিটাতে। সৈয়দা নীগার বানুর “নোনা পানি” ছবিটা খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের নোনা পানিতে নিম্নবর্গের নারী-পুরুষদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের এক সংবেদনশীল ও দরদী রূপায়ন। আর “আদিম” ঢাকার অদূরে টঙ্গী স্টেশন ও আশেপাশের বস্তীর হতদরিদ্র কিছু লুম্পেন মানুষদের জীবনের এক প্রত্যক্ষ ও বলিষ্ঠ চিত্রায়ন। চলচ্চিত্র ভাষার প্রয়োগেও ছবিটা চমকপ্রদ। এই প্রতিটা ছবির সাউন্ডট্রাকেই আমরা দেখি আমাদের নিম্নবর্গের মানুষদের সংস্কৃতি ও লোকজ গানের চমৎকার কিছু ব্যবহার। আমরাও ছবি তৈরি করি। তাই জানি অনেক অনেক শ্রম, ঘাম ও নীরব অশ্রু ছাড়া এধরণের ছবি তৈরী করা সম্ভব নয়। এসব ছবির নির্মাতাদের তাই জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন।

এফডিসি-র কৃত্রিম ছবির যুগ বর্তমানে প্রায় শেষ। অন্য দিকে চলচ্চিত্রের নামে এদেশে ইদানীং যা তৈরী হচ্ছে তা মূলত: বিদেশী বহুজাতিক টেলিফোন কোম্পানীগুলোর অর্থায়নে বা পৃষ্ঠপোষকতায় কর্পোরেটগন্ধী কিছু সমাজ-অসংলগ্ন ও রাজনীতিবিমুখতার ছবি। প্রথম প্রজন্মের নাগরিক কিছু মধ্যবিত্ত ও মধ্যমেধার পরিচালকদের উপরচালাকি বা দেখানেপনাটাই হয়ে উঠেছে এসব ছবির মুখ্য বিষয়। আর কর্পোরেট পুঁজির বিজ্ঞাপনে বা তাদের অর্থায়নে চলা টিভি চ্যানেল বা পত্রিকাগুলোতে এসব ছবি তাদের প্রকৃত শিল্পমূল্যের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রচার পাওয়ার পেছনে রয়েছে মূলত: পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকদের সিনেমা সম্পর্কে খুবই স্বল্প জ্ঞান ও নির্লজ্জ ধান্ধাবাজী। আর এধরণের চলচ্চিত্রনির্মাতাদেরও যেন জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি নয়, ওটিটি বা কর্পোরেট পুঁজির রাবণের ক্ষুধাকে সেবা করা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবনির্ভর এই চারটে সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র বেশ ব্যতিক্রমী সৃষ্টিই বলব। আরো প্রশংসনীয় যে প্রায় প্রযোজকহীনভাবে বা গণ-অর্থায়নে মহাকষ্টে এসব ছবি তৈরী হয়েছে। দু:খজনক যে এসব ছবি সিনেমা হলে চালানো হয় না এবং কর্পোরেট গণমাধ্যমে কোনও প্রচারও পায় না।

এসব ছবির নির্মাতাদের কেউ কেউ আমার ছাত্র বা ছাত্রী। তাদের নিয়ে আমি গর্ব বোধ করতেই পারি। শাস্ত্রে আছে “সকলের সঙ্গে জিতবে। শুধু দু’জনের কাছে হারবে। পুত্র ও ছাত্র।” তো সৃজনে এত পরিশ্রমী, দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের প্রতি এত আন্তরিক দরদ ও ভালোবাসা, এরকম ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তো হেরেও সুখ!

আমাদের বিকল্পধারার নির্মাতাদের আজীবনের স্বপ্ন ও চেষ্টা ছিল এদেশের মানুষদের প্রকৃত জীবনসত্যকে পর্দায় তুলে ধরা। বাংলাদেশের চার প্রান্তের চারটে ছবি যেভাবে এদেশের দু:খী ও সংগ্রামী মানুষদের জীবনকে এত সৎ ও বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছে তা দেখে এদেশে জীবনমুখী শিল্প ও বাস্তবমুখী চলচ্চিত্রের ব্যাপারে, এবং আমাদের বিকল্প সিনেমার ব্যাপারেও, আবার নতুন করে আশাবাদী হতে পারছি। বিকল্প সিনেমার বৃহত্তর রণক্ষেত্রে আমি এই চার সৎ নির্মাতাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই।


Leave a reply