Select Page

চিরঘুমে কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

চিরঘুমে কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

কিংবদন্তি গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রোববার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে তার পুত্রবধূ শাহানা মির্জা জানান।

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’- এর মত অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা মাজহারুল আনোয়ারের বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

শাহানা মির্জা বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে এসিডিটির সমস্যায় ভুগছিলেন। আমরা গতকাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছিল, আজ আরও কিছু পরীক্ষা করার কথা ছিল।”

আরো জানান, ভোরে হঠাৎ অসুস্থতা বেড়ে গেলে তার শ্বশুরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান, তার পালস পাওয়া যাচ্ছে না।

ষাটের দশকে যখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র, মাজহারুল আনোয়ার লেখেন তার প্রথম গান ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’। নাজমূল হুদা বাচ্চুর সুরে সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন।

মাজহারুল আনোয়ার ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানের জন্য গান লেখা শুরু করেন। সে সময় গানপ্রতি মিলতো ৫০ টাকা। সেই দিয়ে তার পেশাদার গীতিকারের জীবন শুরু।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে টেলিভিশনের জন্যও নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বলা হয়, তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার।

রেডিও ও টেলিভিশনে ব্যস্ততার মধ্যেই ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে ডাক পড়ে মাজহারুল আনোয়ারের। সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট সিনেমায় তার ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি শ্রোতার হৃদয়ে আজও অমলিন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার গাওয়া প্রথম গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বল কি হবে’ মাজহারুল আনোয়ারেরই লেখা।

১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা’ সিনেমার জন্য (পরে নাম বদলে হয় সংঘাত) মাজহারুল আনোয়ার লেখেন মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রেরণাদায়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আনোয়ার পারভেজের সুরে সেই গানকেই পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ আর ‘একবার যেতে দে না’- এই তিনটি গান বিবিসির এক জরিপে ২০ শতকের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।

ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের গানে খ্যাতি পাওয়া প্রায় সব শিল্পীই কখনও না কখনও মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান কণ্ঠে তুলেছেন। সেসব গানে এসেছে প্রেম আর বিরহ, দ্রোহ আর দেশপ্রেম, জীবন আর মৃত্যুচিন্তার কথা।

চোখের নজর এমনি কইরা, তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে, সাতটি রঙের মাঝে মিল খুঁজে না পাই, অনেক সাধের ময়না আমার, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, চলে আমার সাইকেল, সবাই তো ভালোবাসা চায়সহ মাজহারুল আনোয়ারের লেখা অসংখ্য গান বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে বহুকাল।

১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান মাজহারুল আনোয়ার। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়।

তার পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। এর মধ্যে রয়েছে শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, ক্ষুধা, তপস্যা, উল্কা, পরাধীন, পাষাণের প্রেম,জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, অগ্নিশিখা, জিঞ্জির, আনারকলি, বিচারপতির মত সিনেমা।

পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে সরকার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়। ১৯৭২ সালে তিনি পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক।

চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য, সেন্সরবোর্ড সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসেরও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

স্ত্রী জোহরা গাজী, ছেলে সারফরাজ আনোয়ার এবং মেয়ে দিঠি আনোয়ারকে রেখে গেছেন এই গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ গীতিকার, পরিচালকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে।


Leave a reply