চেতনা: নায়ক হয়ে অমিত হাসান, মিশা সওদাগরের আবির্ভাব
অধ্যাপক আলমগীর প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি এলাকার একটি কলেজে বদলি হয়ে আসেন। আদর্শবাদী এ শিক্ষক এলাকার ছেলে-মেয়েদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করার সাহস দিতে থাকেন।
একদিন কিছু মাস্তান এক কলেজ ছাত্রীকে তুলে নিতে চাইলে রুখে দাঁড়ান আলমগীর, উদ্ধার করেন ওই ছাত্রীকে। কলেজে নতুন আসা অধ্যক্ষ আলমগীর জানতেন না এরা কারা, কে তাদের মূল হোতা। অবশ্য এসব জানার ইচ্ছাও তার ছিল না, কারণ তার কাছে একজন অপরাধীর পরিচয় শুধুই অপরাধী, অন্য কিছু নয়। কিন্তু অধ্যাপকের এই আচরণ তো আর দুর্বৃত্তদের প্রত্যক্ষ মদদদাতা এটি এম শামসুজ্জামানের পছন্দ হওয়ার কথা নয়?
তাই তো ভয়ংকর হয়ে উঠে সে, নির্মমভাবে হত্যা করে অধ্যক্ষ আলমগীরকে। তার বিরুদ্ধে কোন সাক্ষী প্রমাণ না থাকায় আদালত থেকে বেকসুর খালাসও পেয়ে যায় এটিএম শামসুজ্জামান। কিন্তু এই ব্যাপারটি ছেড়ে দিতে নারাজ আলমগীরের স্ত্রী রেহানা। রুখে দাঁড়ালেন তিনি, সঙ্গে আরও পেলেন আলমগীরের কলেজের আদর্শে গড়া অমিত হাসান, মিশা সওদাগর, দীপক, মেরীনা, হাসি ও খালিদ মোহাম্মদসহ আরও কজন ছাত্র-ছাত্রীকে। পাশে আরও দাঁড়ালেন মানবতাবাদী এক মহিলা আইনজীবী কবরী। শুরু হয় তাদের সমাজ থেকে দুষ্কৃতকারী এটিএম শামসুজ্জামানদের উৎখাত করে অধ্যক্ষ আলমগীরের একটি আদর্শ সমাজ গড়ার গল্প।
এ কাহিনি থেকে ছবির চিত্রনাট্য সংলাপ ও পরিচালনা করেছিলেন ছটকু আহমেদ সাহেব, উপহার দিয়েছিলেন ‘চেতনা’ নামের একটি সুনির্মিত চলচ্চিত্র। যা দেখেছিলাম আজ থেকে প্রায় ৩১ বছর আগে রাজশাহীর উপহার সিনেমায়, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারি।
ছবিটিতে অভিনয়ে ছিলেন আলমগীর, রেহানা জলি, খালিদ মোহাম্মদ, এটিএম শামসুজ্জামান, কবরী এবং একঝাঁক নবাগত অমিত হাসান, মিশা সওদাগর, দীপক, হাসি ,মেরিনা ও সুচিত্রা। কাহিনির প্রয়োজনেই ছবিটিতে বেশ কিছু নতুন মুখ নেওয়া হয়েছিল, যার বেশির ভাগই ছিল ১৯৮৯ সালে আয়োজিত বিএফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’র আবিষ্কার।
এদের মধ্যে অমিত হাসান ছিলেন সেবারের প্রথম, সে হিসেবে ‘চেতনা’ই ছিল অমিত হাসানের অভিষেক হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র। আরেক অভিনেতা মিশা সওদাগরেও অভিষেক ছবিও এটি, নায়ক চরিত্রে। যা আজকের নতুন জানা দর্শকদের একটু অবাকই লাগতে পারে।
ছবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ে ছিলেন খালিদ মোহাম্মদ, যিনি স্টালিন নামেও পরিচিত পান। যার সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘মাস্টার সামুরাই’ ছবিতে ক্যারাটে অ্যাকশনে মুগ্ধ হয়েছেন অনেক দর্শক। মূলত খালিদ মোহাম্মদ ছিলেন মার্শাল আর্টে (ব্ল্যাক বেল্ট) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, সে হিসেবে চলচ্চিত্রে তার মার্শাল আর্ট প্রদর্শন দারুণভাবে কাজে দিয়েছে। এই ছবিতেও তিনি মার্শাল আর্টের চমৎকার কিছু কসরত দেখিয়েছিলেন, যার মধ্যে টুনফা কুংফু অন্যতম। সম্পূর্ণ নতুন এই কুংফুটি তিনি দেখিয়েছিলেন ছবিটিতে। আবার বিশ ফুট উঁচুতে তার ফ্লাইং রাউন্ড কিক শটটি হল ভর্তি দর্শকেরা দারুণ উপভোগ করেছে!
ছবির দুই সিনিয়র শিল্পী আলমগীর ও কবরীর স্ক্রিন প্লে তেমন একটা লম্বা না হলেও মূল কাহিনিটি ছিল আলমগীরকে নিয়েই। তবে তার আগে আরেক সিনিয়র অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে একটু বলে নিই। দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। মন্দ চরিত্রে অনেকেই অভিনয় করে বা করবে তবে একমাত্র রাজীব ছাড়া একজন শামসুজ্জামানের মতো কোন মন্দ চরিত্রকে এতটা ভয়ংকরভাবে কেউ ফুটিয়ে ওঠাতে পারতো কিনা আমার সন্দেহ আছে। এখনো মনে আছে পর্দায় ওনার উপস্থিতি ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ভয়ংকর এই মানুষটির ভয়ংকর সব কার্যকলাপ যেন চোখের সামনেই ঘটছিল। এমন বাস্তবিক অভিনয় আসলেই লাজবাব। আমার দৃষ্টিতে ছবিটি এটিএম শামসুজ্জামানের উল্লেখ্ করার মতো ছবি হিসেবে হয়ে থাকবে।
যাই হোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি… একজন আদর্শবান শিক্ষকের (আলমগীর) কিছু তরুণদের নিয়ে সমাজে আদর্শ আর ন্যায় স্থাপন করাকে কেন্দ্র করেই ছবিটির কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে। এখানে একটি ব্যাপারে না বললেই নয়, সে সময়ের প্রেক্ষিতে আলমগীর-কবরী অনেক বড় তারকা, অবশ্য কবরী সিনেমায় তেমন রেগুলার না হলেও আলমগীরকে প্রধান করে কিন্তু নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছিল এবং এবং সফলও হচ্ছিল। আর সে সময়েই অনেকটা অতিথি চরিত্রে অভিনয় করলেন তারা। স্ক্রিনে কতক্ষণ থাকা না থাকাকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং প্রাধান্য দিলেন তারা ছবির চরিত্রকে। শুধু আলমগীর-কবরীরাই নয়, সে সময় সিনিয়র প্রায় সব তারকারাই ছবির চিত্রনাট্যের ওপর চরিত্রের গুরুত্ব দিতেন, যা বর্তমান সময়ে প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।
আসলে তখনকার সময়ের তারকারা চাইতেন কীভাবে একেকটি চলচ্চিত্রকে সুন্দর আকর্ষণীয়ভাবে পর্দায় উপস্থাপন করা যায়, কীভাবে একেকটি চলচ্চিত্রকে দর্শকদের মনে গেঁথে দেওয়া যায়। তাই তো তাদের সৎ ইচ্ছা আর অভিজ্ঞ সব নির্মাতাদের গুনে আমরাও হলে বসে উপভোগ করতাম একেকটি মাস্টারপিস চলচ্চিত্র, যা আজ শুধুই মধুর স্মৃতি হিসেবে ধরা দেয়।