Select Page

ছোটপর্দায় সমসাময়িক কথাসাহিত্যের নজরকাড়া উপস্থাপন ‘বঙ্গ বব’

ছোটপর্দায় সমসাময়িক কথাসাহিত্যের নজরকাড়া উপস্থাপন ‘বঙ্গ বব’

সাহিত্য থেকে ছোট বা বড়পর্দার জন্য অ্যাডাপ্টেশন নতুন কোনো বিষয় নয়। আমাদের এখানে সাহিত্য থেকে কিছু নির্মাণ শুনলে পুরোনো দিনের জবুথবু গল্প মনে হলেও হালে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। হলিউডে এমনও দেখা যায়, বই প্রকশের আগেই মুভি স্বত্ব বিক্রি হয়ে যায়, রীতিমতো নিলাম ডেকে করা হয় আয়োজন। বাংলাদেশে সাহিত্য করে বাণিজ্য হওয়া নিয়ে নানান প্রেজুডিস আছে, আবার সাহিত্য কেন লোকে পড়ে বা পড়ে না এ নিয়ে তর্ক বহুত।

দেশি-বিদেশি বেশ কিছু স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে হাজির থাকলেও স্থানীয় কনটেন্ট উৎপাদকরা নানা কারণে পিছিয়ে আছে। আর্থিক ঝুঁকির সঙ্গে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় বাধা— টিভি নাটকের ফরমেট থেকে আলাদা হতে পারা বা ইউনিক আইডিয়া ডেভেলপ করতে না পারা। বঙ্গ বিডি’র বেজড অন বুক বা বব সে দিক থেকে সাহসী হলেও রিস্ক-ফ্রী থাকতে চায়নি। নইলে চমৎকার কনটেন্টগুলো একই দিনে চারটি চ্যানেলে প্রচারের পাশাপাশি রিলিজ হয়েছে এই প্ল্যাটফর্মে— মানে অরিজিনালের চরিত্র বজায় থাকে না।

কিন্তু ধারণাগতভাবে অবশ্য অভিনব। সমকালীন সাহিত্য থেকে গল্প ধার করা। সাহিত্য শুনলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের বাইরে মনেই আসে না, যদিও নাজিম উদ দৌলাসহ অল্প কয়েকজনের জনপ্রিয় গল্প থেকে ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে কিছু চিত্রকল্প। তবে এভাবে সিরিজ আকারে কেউ ভাবেনি। তারা সমসাময়িক সাহিত্যকে মূল ইউএসপি হিসেবে ধরেছে। আর বঙ্গ ববে স্থান পাওয়া বেশির ভাগ লেখকেরই উপন্যাস আগে ভিজ্যুয়ালে পুনরুৎপাদিত হয়নি। এবং কয়েকটি উপন্যাস অপ্রকাশিতও বটে।

বব-র প্রথম ছবিটি ছিল শাহাদুজ্জামানের দুটি গল্প নিয়ে নূর ইমরান মিঠুর ‘শহরে টুকরো রোদ’। শাহাদুজ্জামানের লেখা বরাবরই বুদ্ধিদীপ্ত ও মাপা মাপা শব্দের বুনটে বাধা। মিঠু ও শাহাদুজ্জামান জুটি পুরোনোই বটে। এর আগে দুটো গল্প নিয়ে তারা আস্ত সিনেমা (কমলা রকেট) বানিয়েছে। এখানে অবশ্য দুটো গল্প ‘শহরে’ ও ‘টুকরো রোদ’ নামে দেখা গেছে। বাংলা নাটক বা সিনেমায় উচ্চবিত্তের প্রেজেন্টেশন প্রায়ই অনুপস্থিত বা যতটুকু আছে তাতে তাদের লাইফস্টাইল ততটা ফোটে না। এ দিক থেকে ‘শহরে’ আলাদা। দ্বিতীয় ছবিটি তুলনামূলকভাবে দর্শকের কাছে অনেকটা সহজ, যেহেতু মধ্যবিত্তের নস্টালজিয়া টিভি দর্শকের সাংস্কৃতিক সঙ্গী। পুরো ছবি মিলে মিঠু টানটান একটা ভাষ্য তৈরি করেছেন। ‘শহরে’ ছবিতে আজমেরী হক বাঁধনের অভিনয় ও অভিব্যক্তি চরিত্রের শ্রেণিকে তুলে ধরেছে, লোকেশন বা অন্যদের এটিচুড দারুণভাবে ম্যানেজ করেছেন মিঠু।

শিবব্রত বর্মণের লেখা বেশ আরামের ও বিস্ময়কর। তবে প্রায়শ ফাঁপা। টানা কয়েকটা গল্প পড়া একটু কষ্টসাধ্য। কিন্তু তার লেখার ধরনকে চিত্রভাষ্যে আনা খানিকটা কঠিন বটে! অনিমেষ আইচের ‘আলিবাবা ও চালিচার’ তার ভালো উদাহরণ। নির্মাণও বোধহয় খানিকটা সেকেলে বা আমার এক বন্ধুর মতে ‘প্রাগৈতিহাসিক’। বিশেষ করে চোরদের দৃশ্যগুলো বিরক্তকর। ছবির টুইস্ট আগে থেকে অনুমতি হলেও নূর ইমরান মিঠু ও সোহেল মন্ডলের জুটি আসলেই দারুণ। আশনা হাবিব ভাবনা চরিত্রের তুলনায় বেশি স্পেস পেয়েছেন, উনাকে তো দেখতে মন্দ লাগে না! তবে আরব্য রজনীর সমসাময়িক অনুকরণ বাদে এ গল্পের তেমন সারমর্ম নাই আসলে।

বব সিরিজের প্রচারণার প্রধান মুখ ‘মরণোত্তম’। হালের বেস্টসেলার লেখক সাদাত হোসাইনের উপন্যাস হিসেবে এ কাণ্ড। অনলাইন বুক সেলার প্ল্যাটফর্মও বইটির বিজ্ঞাপনে সয়লাব করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এ সময়ের জনপ্রিয় নির্মাতা সঞ্জয় সমাদ্দার ছবির প্রধান মুখ করেন সিনেমা জগতের প্রথম সুপারস্টার ইলিয়াস কাঞ্চনকে। কিন্তু সাদাতের লেখনির সতেজতা ক্ষুণ্ন হয়েছে গল্প বয়ানে দ্বিধা ও অভিনয়ে। বিশেষ করে সিনেমার অভিনেতাদের নাটকে বা নাটকের অভিনেতাদের সিনেমায় শিফটের যে সমস্যা সেটা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয়ে। গল্পের দিক থেকে স্কুল এমপিওভুক্তির দাবির আড়ালে ধর্ষিতা ছাত্রীর আত্মহত্যার বিচার চাওয়ার দিক স্পষ্ট হয়ে উঠে নাই। তবে ইলিয়াস কাঞ্চন ও ইমতিয়াজ বর্ষণ দারুণ কিছু সংলাপ দিয়েছেন।

মারুফ রেহমানের উপন্যাস থেকে গোলাম হায়দার কিসলুর নির্মাণ ‘লাবণী’ বোধকরি এ ঈদে জনপ্রিয়তা দৌড়ে এগিয়ে থাকা ফিকশনগুলোর অন্যতম। এ গল্প চেনা মনে হবে, তবুও কত অচেনা। কিন্তু বাস্তব ও অবাস্তব দুই জগতের সম্মিলনে লেখা চিত্রনাট্য ও অভিনয়ের কম্পোজিশন অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। বিশেষ করে দুটি চরিত্রে অসাধারণ মনোজ প্রামাণিক। তার সঙ্গে ঠেক্কা দেওয়ার কেউ ছিলেন না। গল্প শেষ পর্যন্ত বড় কোনো ইঙ্গিত দেয় না, টুইস্ট নিয়ে ভাবায় বেশ, অনেক মনে রাখে— এ অর্থে সফল নির্মাণ ‘লাবণী’।

হালের জনপ্রিয় নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম ভিকি জাহেদ। ইউটিউবের জন্য শর্টফিল্ম নির্মাণ করে লাখ লাখ ভিউ পাওয়া নির্মাতা টিভিতে দারুণ ব্যস্ত। টুইস্ট তার ফিকশনের অন্যতম অবলম্বন। সে তুলনায় রাহিতুল ইসলামের উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘চরের মাস্টার’ পানসে। সারা দেশ যখন ‘উন্নয়নে’ নাভিশ্বাস তখন বারবার প্রপাগাণ্ডামূলকভাবে এ শব্দের ‘ইতিবাচক’ আসা-যাওয়া আসলেই বিরক্তিকর। শুরু ও শেষে টুইস্ট দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও ততটা জমেনি। তবে নজর কেড়েছেন খাইরুল বাসার, আজকাল উনাকে নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। খাইরুল ও ভিলেন চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ মিলে ‘চরের মাস্টার’কে পুরোপুরি ডুবতে দেননি। ‘মরণোত্তম’-এর ভিলেন শহীদুজ্জামান সেলিম অনেক বাহবা পেলেও নাটকের টিপিক্যাল ভিলেনের বাইরে যেতে পারেনি। উল্টো দিকে জর্জ, যার অভিনয়কে সত্য ভাবলে, নির্ঘাত ভয় পাবেন।

এটা বলতে হয় সিরিজ কী, পুরো ঈদের আয়োজনে বড় চমক ছিল ‘মিস্টার কে’। মাহবুব মোর্শেদের ‘নোভা স্কশিয়া’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন ওয়াহিদ তারেক। ‘অনুমানবিদ্যা’ আজব এক বিদ্যা, যাকে ঘিরে গল্প। এ বিদ্যা আমলে নিলে মৃত মানুষের লকারের পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে তার মতো জীবনযাপন করতে হবে। যেখানে মানুষ নিজের জীবনটাই যাপন করতে পারে না বলে মনে করে! এমন আজিব বিষয় নিয়ে টেলিছবি ‘মিস্টার কে’! পাসওয়ার্ড শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় কি-না সেটা বড় প্রশ্ন হলেও আসল বিষয়টা হলো অন্যের জীবনটা যাপন করা আসলে কী? আস্তে আস্তে যখন আপনি অপর কেউ হয়ে আপনার সামনে হাজির হবেন তখন কী ঘটবে? এটা তো মহাপ্রলয়ে, সামলে নিতে পারবেন! এ যন্ত্রণার অনেকটা পাওয়া যায় টেলিছবিতে। (কাছাকাছি উদাহরণ হিসেবে, যা দেখাতে ব্যর্থ ছিল ‘আয়নাবাজি’ নামের হিট সিনেমা)। সাউন্ডে সমস্যা থাকলেও ‘মিস্টার কে’ কেউ উপভোগ্য। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মিসির আলি ও রবার্ট ল্যাংডনের মতো আরেকটা চরিত্র পেল বাংলা সাহিত্য। কথাটা তত সরল নয়, যেহেতু ‘অনুমানবিদ্যা’য় নিজের মধ্যে অন্য কাউকে ধারণ করতে হয়! এ ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন পার্থ বড়ুয়া, ‘একটু রোদ’-এও ছিলেন তিনি। অন্য অভিনেতারাও ভালো। তবে চমক দিতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্য অনর্থক তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।

বিনা দাওয়াতে খেতে যাওয়ার ‘হাকুল্লা’র ইন্টারেস্টিং আইডিয়ায় যোবায়েদ আহসানের উপন্যাস থেকে ‘কেমন কী’ বানিয়েছেন নামি নির্মাতা ইফতেখার আহমেদ ফাহমি। সবার অভিনয় মুগ্ধ হওয়ার মতো এবং চমৎকার কিছু কমিক সিন থাকলেও সারমর্মহীন ও অসমাপ্ত এ ছবি নিয়ে আসলে কিছুই বলার থাকে না শেষ পর্যন্ত।

বঙ্গ বিডি’র এ প্রয়াসকে সারা দুনিয়ায় বাংলাভাষার ওটিটি কনটেন্টের দিক থেকে দেখলে আমরা এখনো ‘টুইস্ট’ ও ‘থ্রিল’-এ আটকে আছি। এর বাইরে সহজ-সরল কোনো গল্প যেন নাই আমাদের জীবনে। ববও ব্যতিক্রম নয়। প্রয়াস হিসেবে প্রশংসার যোগ্য, এখান থেকে শুরু হতে পারে আরও নতুন নতুন কিছু। হয়তো ইউনিকও। যেহেতু দর্শকের সমাদর হয়েছে বঙ্গ বিডি এগিয়ে যেতেও পারে।

গল্পের বিচারে সমসাময়িক প্রতিটি ছবি। আধুনিক সময়ের একাকীত্ব, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা নিয়ে গল্প সব। চরিত্রগুলো রীতিমতো নিজেকে শনাক্ত করতে লড়ছে। এমনকি ‘চরের মাস্টার’ বা ‘মরণোত্তম’ যুথবদ্ধতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়। এটা হয়তো সমসাময়িক ‘রাজনীতিহীনতা’র জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য। রাজনীতি নেই এমন না, স্থানীয় রাজনীতি তো আছে, তা বরং ক্লিশে ও অপরিণত। ‘চরের মাস্টার’ বা ‘মরণোত্তম’-এর খারাপ চেয়ারম্যান বা ‘কেমন কী’র রাজনীতিবিদের চিত্রায়নকে এভাবে দেখবো আমরা। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা ‘মরণোত্তম’-এ, যতটুকু নয় আরকি! তবে এ ছবিটি সমসাময়িক সমাজের চিত্র দেখায় বেশি। আবার ‘মিস্টার কে’র মধ্যে বাহামায় অর্থপাচারের একটা আভাস আছে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি-রাজনীতির ঘটনা বটে!

পুরো সিরিজের কাস্টিং বেশ মনকাড়া। বেশি ভিউর দৌড় ও টেনশন লক্ষ্য করা যাই নাই কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে। চরিত্র অনুযায়ী বাছাই দেখা গেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই।

আরও একটি দিক হলো বৈচিত্র্যের অভাব। লেখক বা নির্মাতা হিসেবে কোনো নারী নেই পুরো সিরিজে। একে ‘ইনটেনশনাল’ হিসেবে না দেখে ‘প্রথাগত’ অর্থে নেওয়া যায়। আর ‘শহরে’র আজমেরী হক বাঁধন ছাড়া নারী চরিত্রের প্রাধান্য নেই আর বা সবল কোনো নারী চরিত্রের উপস্থাপন নাই। অন্যদিকে নন গ্ল্যামারাস নূর ইমরান মিঠুকে ‘আলিবাবা ও চালিচার’-এ কাস্টিং প্রশংসাযোগ্য।

সোশ্যাল মিডিয়া সার্ফিং করে বোঝা যাচ্ছে, বঙ্গ ববের সাড়া বেশ ভালো। পুরো সিরিজসহ বেশ কিছু ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর দর্শক বা বিভিন্ন গ্রুপের তৈরি করা টপ টেনে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটি।

সাহিত্যকে ছবি আকারে সহজলভ্য করে তোলার একটা নগদ লাভ দেখতে পাচ্ছি এরই মধ্যে। আগে তো বলেছি ‘মরণোত্তম’ নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রচারণা। এখন ‘লাবণী’ সম্পর্কে কথা বলছে অনেকে। কেউ কেউ খুঁজছেন ‘নোভা স্কশিয়া’, যদিও বই আকারে এখনো প্রকাশ হয়নি, প্রকাশ হয়েছিল গত বছর একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। এ আগ্রহ ও অন্যান্য বিবেচনা মিলে ‘বব’ সফল এক উদ্যোগ, যা ঈদের বাকি আয়োজনকে এক প্রকার ম্লান করে দিয়েছে। সিরিজের পরের অধ্যায় সফল হোক। সাহিত্যও লাভজনক হোক। শ্রমসাধ্য হোক। সাহিত্যের বাণিজ্য বিষয়ক লজ্জা ও সংস্কার ভেঙে পড়ুক।


মন্তব্য করুন